বিজ্ঞাপন
default-image

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র ২৩ আগস্ট দিল্লিতে সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশের সমস্যা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে কীভাবে পেশ করা যায় বা আদৌ পেশ করা যায় কি না, তা নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশ সরকারের উচ্চপর্যায়ের নেতাদের মধ্যে আলাপ শুরু হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ধারণা, কোনো না কোনো দেশ কোনো না কোনোভাবে বিষয়টি সাধারণ পরিষদে বা সংশ্লিষ্ট কমিটিগুলোতে তুলবেই। পর্যবেক্ষকেরা বলেন, দুই সরকারের মধ্যে আলোচনার ধরনে মনে হচ্ছে, ভারত বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার নিকটতম ধাপে পৌঁছেছে।

ভারতের বাম রাজনৈতিক দল

সিপিএমের পলিটব্যুরো বাংলাদেশে আন্দোলন দমনে পাকিস্তানি সামরিক সরকারকে চীনা সমর্থনের সমালোচনা করে বলে, এটি জাতীয় আন্দোলনের প্রতি বিরাট বিশ্বাসঘাতকতা। বেঙ্গালুরু পলিটব্যুরোর আলোচনার পর সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সুন্দরিয়া সাংবাদিকদের বলেন, একটি জাতীয় আন্দোলন সমর্থনে চীনের ব্যর্থতা খুবই অদ্ভুত।

উ থান্টের হস্তক্ষেপ কামনা

যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশ সরকারের দূত এবং আন্তর্জাতিক মানবিক অধিকার কমিশনের সদস্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বাংলাদেশে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘন সম্পর্কে আলোচনা করার উদ্দেশ্যে অবিলম্বে মানবাধিকার কমিশনের জরুরি সভা ডাকতে এদিন জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টকে অনুরোধ জানিয়ে তারবার্তা পাঠান। তারবার্তায় তিনি বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার করার আইনগত অধিকার পাকিস্তানের নেই।

টাইম ম্যাগাজিনের ২৩ আগস্ট সংখ্যায় ‘পাকিস্তান: মুজিবের গোপন বিচার’ (পাকিস্তান: মুজিব’স সিক্রেট ট্রায়াল) শিরোনামে একটি প্রতিবেদন বেরোয়। এতে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতার জন্য মুজিবকে অভিযুক্ত করা হলেও প্রকৃতপক্ষে রক্তগঙ্গা বইতে শুরু করার আগপর্যন্ত তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি।

পাকিস্তানি কাণ্ড

রাওয়ালপিন্ডিতে একজন সরকারি কর্মকর্তা সাংবাদিকদের জানান, পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর পদ থেকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানকে সরিয়ে তাঁর জায়গায় একজন অসামরিক বাঙালিকে বসানোর কথা সামরিক সরকার ভেবে দেখছে। এ ব্যাপারে ডা. আবদুল মোত্তালিব মালিকের কথা ভাবা হচ্ছে। তিনি পূর্ব পাকিস্তানে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। সরকারি কর্মকর্তা আরও বলেন, এর প্রধান উদ্দেশ্য পূর্ব পাকিস্তানে এমন পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা করা, যাতে ভারতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীরা নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে আসেন।

অবরুদ্ধ বাংলাদেশে পাকিস্তান অনুগত প্রাদেশিক সরকারের একজন মুখপাত্র বলেন, বেআইনি ঘোষিত আওয়ামী লীগের টিকিটে নির্বাচিত সব সদস্যকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ৮৮ জন জাতীয় পরিষদ সদস্য (এমএনএ) এবং ৯৪ জন প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যের (এমপিএ) বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি। ফলে তাদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এই সংকট মুহূর্তে অর্পিত দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসতে তাদের দ্বিধাবোধ করা উচিত নয়। সরকার তাদের পূর্ণ নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিয়েছেন।

পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর নেতা অধ্যাপক গোলাম আযম লাহোরে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় চরদের (মুক্তিযোদ্ধা) প্রধান শিকার জামায়াতে ইসলামীর কর্মীরা। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের (আওয়ামী লীগ) বিরোধিতা করার জন্য সেখানে বহু জামায়াতকর্মী দুষ্কৃতকারীদের (মুক্তিযোদ্ধা) হাতে প্রাণ হারিয়েছে। একমাত্র জামায়াতে ইসলামী প্রদেশের প্রতিটি অংশে দুষ্কৃতকারীদের মোকাবিলা করছে।

মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা অভিযান

কুমিল্লায় মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল চিয়ারা গ্রামে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা ছত্রভঙ্গ এবং বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা ও তাদের সহযোগী রাজাকার হতাহত হয়। বাকি পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারেরা পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি দল এদিন কুমিল্লার জগন্নাথদিঘীতে পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিরক্ষা অবস্থানে আক্রমণ করে। এই আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনীর দুই-তিনটি বাংকার ধ্বংস এবং কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি দল সেনেরবাজার এলাকায় নৌকায় থাকা পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে দুই-তিনজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত এবং বাকি সেনারা নৌকাটিকে তাড়াতাড়ি তীরে ভিড়িয়ে নৌকা থেকে নেমে গ্রামের দিকে পালিয়ে যায়।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মুক্তিযোদ্ধারা নয়নপুর রেলস্টেশন এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানের ওপর মর্টার এবং ১০৬-রিকোয়েললেস রাইফেল দিয়ে অতর্কিত আক্রমণ চালায়। আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনীর শক্ত বাংকার বিধ্বস্ত এবং কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।

চাঁপাইনবাবগঞ্জে একদল মুক্তিযোদ্ধা কানসাটে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায়। প্রায় চার ঘণ্টা স্থায়ী যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানের ব্যাপক ক্ষতি এবং কয়েকজন হতাহত হয়।

সূত্র:

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর এক, দুই ও সাত; মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালি: যুক্তরাজ্য, আবদুল মতিন, সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা; দ্য গার্ডিয়ান, ২৩ আগস্ট ১৯৭১; মর্নিং স্টার, ২৪ আগস্ট ১৯৭১; টাইম, ২৩ আগস্ট ১৯৭১; দৈনিক পাকিস্তানআজাদ, ২৪ আগস্ট ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকাযুগান্তর, ভারত, ২৪ ও ২৫ আগস্ট ১৯৭১।

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান