বিজ্ঞাপন
default-image

বহু যুগ পরে বাংলাদেশের মানুষ একটি স্লোগানকে বড় আপন করে নিল: বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো। নিজের দেশের জন্য, নিজেদের স্বাধীনতার জন্য সেই অস্ত্রধারণ ছিল বড় চমকপ্রদ ঘটনা।

দুনিয়ার মুক্তিকামী মানুষের শুভকামনা, দেশের তরুণদের শৌর্যবীর্য ও আত্মদান এবং ভারতের সামরিক সহযোগিতা ও সোভিয়েত শিবিরের কূটনৈতিক সমর্থনের ফলে আশাতীত অল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করল। ষোলই ডিসেম্বর ১৯৭১ পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের পর বাংলাদেশের স্বাধীনতা আপাতদৃষ্টিতে প্রতিষ্ঠিত হলো।

গত ছত্রিশ বছরে সেই স্বাধীনতার মর্যাদা আমরা রক্ষা করতে পারিনি। দেশের প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানেন না, শোনেন না, হুট করে আধা-সামরিক চুক্তি সাধিত হয়। না চাইতেই শক্তিধর দেশকে আকাশসীমায় চলাচলের সুবিধা দেওয়া হলো। সে দেশের মাদকপাচারকারীকে রাষ্ট্রপতি অশোভন দ্রুততায় সরকারের পরামর্শে ক্ষমা প্রদর্শন করলেন। সে দেশের গোয়েন্দা বিভাগের হাতে বাংলাদেশি নাগরিককে সমর্পণ করা হলো। অবশ্য এ ধরনের সহযোগিতা না করলে বঙ্গবন্ধু হত্যার আসামি মহিউদ্দিনকে আমরা বিচারের জন্য পেতাম না।

আর্থিক সাহায্যের জন্য যেভাবে আমরা ভিখারি সাজলাম তাতে লজ্জায় মাথা নুয়ে আসে। আমাদের দেশের যুবকদের সামান্য আর একটু প্রশিক্ষণ বা শিক্ষা দিলে বিদেশে তারা আরও বেশি উপার্জন করে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার অভাব দূর করতে পারত।

পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে মুক্ত বাজার মনে হয় বাংলাদেশ। সরকার ও ভোক্তা উভয়েই ওই বাজারের হাতে বন্দী হয়ে আছে, তার নিয়ন্ত্রণে সেনা-বিডিআর ঠুঁটো জগন্নাথ। অ্যাডাম স্মিথের ইনভিজিবল হ্যান্ড বা অদৃশ্য হস্তের তো আমরা কোনো হদিস পাচ্ছি না। টাকার মূল্যমান ক্রমাগতভাবে নেমে এসেছে। কিন্তু দ্রব্যমূল্যের হার যে দুই অঙ্কের কোঠায় গিয়ে ঠেকেছে, তাকে কে নিয়ন্ত্রণ করবে?

অন্যান্য অনানুষ্ঠানিক ব্যবসার সঙ্গে ঠগদের ব্যবসা টিকে থাকলেও আমি এখনো বিশ্বাস করি না ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে যাবে। আমি এখনো বিশ্বাস করি না যে, যে যায় লঙ্কায় সে-ই রাবণ হয়। লঙ্কায় গিয়ে রাম রাবণকে হত্যা করেছিল। প্রতিটি রাবণ অপঘাতে মৃত্যুর ভয়ে শঙ্কিত থাকে।

দরিদ্র, দুস্থ ও প্রায়-অশিক্ষিত দেশ হিসেবে বিদেশিরা আমাদের করুণা করে থাকে। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বা সামরিক শাসন তুলে নিলে পশ্চিমা গণতন্ত্রের দেশ অভিনন্দন জানায়। আবার সংবিধানে ইসলামি নীতিমালা সংযোজন করলে কোনো কোনো মুসলমান অধ্যুষিত দেশ অভিনন্দন জানায়। ১৬ মে ১৯৭৭ সৌদি আরবের বাদশাহ খালেদ আমাদের তত্কালীন প্রেসিডেন্টকে (উনি ‘রাষ্ট্রপতি’র চেয়ে ‘প্রেসিডেন্ট’ শব্দটা বেশি পছন্দ করতেন) অভিনন্দন জানান।

আমরা অনেক সময় বলে থাকি, বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে কোনো সুযোগ দেওয়া হয়নি। মাসুম বাচ্চা গণতন্ত্রের জন্য আমাদের কত মায়া! আসলে আমরা গণতন্ত্র আমল করিনি। আমরা গণতন্ত্রের পরীক্ষায় শুধু ব্যর্থ নই, ফেল করেছি। অনেক সময় বিদেশি শব্দ না হলে আমরা সম্পূর্ণ ভাব প্রকাশ করতে পারি না, তাই বললাম, ‘ফেল’ করেছি। মৃত্যু বা অপঘাতে মৃত্যুর পর গণতন্ত্র পুনরুজ্জীবিত হলো এবং তারপর তার পুনর্বার মৃত্যু ঘটল। এভাবে আমাদের দেশে গণতন্ত্র পরিবর্তনে দুখানিচ সুখানিচ। এখন অবাধ, সুষ্ঠু ও সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে গণতন্ত্রের জন্য রেকি করা হচ্ছে। বৈঠকখানায় নানা সংস্কার-কথায় গণতন্ত্রের ইকেবানা সাজানো হচ্ছে। জাপান নকল করে গণতন্ত্র ধাতস্থ করেছে যেমন ধাতস্থ করেছিল চৈনিক সভ্যতা ও বৌদ্ধধর্ম এবং আত্মস্থ করেছে আধুনিককালের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি। আমাদের নকল করার মেধা মন্দ নয়, কিন্তু নকলের চেয়ে ভেজাল দেওয়ার মেধা বেশি। একদলীয় গণতন্ত্র থেকে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের সোনার পাথরবাটির জন্য কত তরুণ যে অকালে ঝরে পড়েছে এবং দেশ দিশেহারা হয়েছে গত ছত্রিশ বছরে! এখনো নিজেদের ওপর আমরা ভরসা হারাইনি। নির্ভরসায় কী বাঁচা যায়?

আমাদের তরুণদের এক অংশ অতি দুর্বিনীত। স্থান-কাল-পাত্র তাদের বিবেচনায় নেই। ১৯৯৮ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনারে তারা এক তাণ্ডবে মেতে ওঠে। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার ও অন্যদের নিবেদিত পুষ্পস্তবক পদদলিত করে লণ্ডভণ্ড করে। এইসব তরুণের সামান্য একটা অংশ বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে অস্থিরতার সৃষ্টি করে। দেশে স্বাভাবিক অবস্থা দ্রুত প্রতিষ্ঠিত না হলে কবন্ধরা সেখানে নৃত্য করতে থাকবে।

সমাজে অস্বাভাবিকভাবে যে নৃশংসতা বৃদ্ধি পেয়েছিল তার কিছুটা হলেও এখন রুদ্ধ হয়েছে। গণপিটুনি, চোখ উপড়ে নেওয়া, এসিড নিক্ষেপ, জবাই করে হত্যার ঘটনা দিন দিন বাড়ছে। ধর্ষক বা ঘাতক ধর্ষণ বা হত্যায় ক্ষান্ত হতো না, নিহত ব্যক্তির লাশ টুকরো টুকরো করে বীভত্সতায় মেতে উঠত। অফিস-আদালতের দুর্নীতি, অপরাধজগতের নৃশংসতা ও বিনোদন জগতের অশ্লীলতা যেন একই সূত্রে বাঁধা।

সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও ফ্রান্সের গোয়েন্দা সংস্থা ও পুলিশের রিপোর্টে বাংলাদেশ বিপজ্জনক দেশ হিসেবে চিহ্নিত। শান্তিময়তার ক্ষেত্রে ১২১ দেশের মধ্যে প্রথম দেশ নরওয়ে এবং এশিয়ায় ভুটানের পর বাংলাদেশ ৮৬। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যা: আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদে কোনো বাংলাদেশি জড়িত থাকার এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। শুধু বাংলাদেশ নয় আরও কয়েকটি দেশকে ‘বিপজ্জনক’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। দেশের সাধারণ মানুষ এসব কথায় কোনো সান্ত্বনা বা স্বস্তি পায় না।

বন্যা, প্লাবন, জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডোর মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা সামরিক শাসনের মতো রাজনৈতিক দুর্যোগ বা অপদার্থ নির্বাচিত সরকারের নৈরাজ্যের মতো দুর্ভোগ কাটিয়ে বাংলাদেশের মানুষ একাধিকবার গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ এই দেশে এবার বন্যা, ভূমিকম্প এবং সাইক্লোন একে একে আঘাত হেনেছে। দেশগঠন বা পুনর্নির্মাণের পর হিসেব যেখানে ওলোট-পালোট হয়েছে সেখানে আমাদের ধৈর্যের পরিচয় দিতে হবে। বিজয় দিবসে দুঃখের পাঁচালি গাওয়া ঠিক নয়। আমাদের দেশের যোগচিহ্ন চোখের সামনে রাখতে হবে তা না হলে মাতম করে আমরা ফতুর হয়ে যাব।

স্বাধীনতার পর দেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বছরের প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশ, গত ছত্রিশ বছরে সর্বোচ্চ। এর সঙ্গে মনে রাখতে হবে এ বছরে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে দুই অঙ্কের।

১৯৭৩-৭৪ সালে যখন প্রথম দারিদ্র্যের ওপর জরিপ করা হয় তখন ৭০ জন মানুষকে দু’বেলা পেটপুরে আহার জোগাতে প্রাণান্ত চেষ্টা করতে হতো। ১৯৯১-৯২ সালে এমন দুস্থ মানুষের সংখ্যা হ্রাস পেয়ে শতকরা ৫৮.৮ এবং ১৯৯৯-২০০০ সালে তা আরও হ্রাস পেয়ে শতকরা ৪৯.৮-এ দাঁড়ায়। এখন আমাদের দারিদ্র্যরেখা শতকরা ৪০ ভাগে নেমেছে। ১৫ কোটি মানুষের মধ্যে এই অবস্থান সুখকর না হলেও দারিদ্র্য হ্রাসের এই পরিসংখ্যান আশাপ্রদ বলতে হবে। দেশে ১৯৭২ সালে শিশুমৃত্যুর হার ছিল ৬.৪ ভাগ, ১৯৯৯-২০০০ সালে তা কমে হয়েছে ৩.০৩ ভাগে। ১৯৭১ সালে জনবৃদ্ধির হার ছিল ৩ শতাংশ। ২০০১ সালে তা ১.৪৮-এ নেমেছে।

বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বেশকিছু ভালো কাজ হয়েছে। যে চট্টগ্রাম ছিল বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিপজ্জনক বন্দর সেখানে অনাচার কমেছে। যেখানে পুলিশের সোর্স খুন হতো, ট্রাফিক পুলিশ ট্রাক-চাপা পড়ত, পুলিশ এক টাকাও ঘুষ নিত, সেখানে আইন-শৃঙ্খলার অবস্থা আগের চেয়ে ভালো মনে হলেও চোরাগোপ্তা মারামারি ও প্রাণহানি চলছে দেখা যায়। বহু দীর্ঘসূত্রতার পর বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করা হয়েছে। তথ্যের অধিকারের ক্ষেত্রে আইন তৈরি হচ্ছে। স্থানীয় সরকারের প্রয়োজনীয়তা স্বীকৃতি পেয়েছে।

অপরাধ দমন, অপরাধের তদন্ত ও অপরাধীকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর দায়িত্ব সরকারের। সরকারের কাজ সরকারকে করতে হবে, না-হলে সরকারের যেমন অমঙ্গল হবে তেমনই প্রজার মনে বিক্ষোভ ধূমায়িত হবে। সরকার যখন চায় যে সরকারের কাজ ফরিয়াদি করবে, তখন অপরাধ দমনের ক্ষেত্রে এক অগ্রহণযোগ্য বেসরকারিকরণ ঘটে।

দুজন বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান ও হামিদুর রহমান আজ বাংলাদেশের মাটিতে শায়িত। আমরা শান্তি পাই যখন ভাবি যে আমাদের সাতজন বীরশ্রেষ্ঠের সমাধি এখন আমাদের মধ্যে বিরাজ করছে।

আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলন, তার বিনিয়োগ ও ব্যবহার সম্বন্ধে যে স্বচ্ছতার প্রয়োজন তা এখনো আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়। শিক্ষাক্ষেত্রে আমরা একমুখী শিক্ষা প্রবর্তন করব কি না, তা ঠিক না করে ব্যাপারটি মুলতবি রেখেছি।

আমাদের দেশের তথ্য-বিতথ্য মনে হয় ইতিহাসে ফিরেছে। আমাদের দুই নেতা স্বাধীনতার ঘোষক ও স্বাধীনতা ঘোষণার পাঠক দুজনেই নিহত হন। ভাষার বা দেশের জন্য যাঁরা প্রাণ দেন তাঁদেরকে শহীদ বলতে যাঁরা নারাজ তাঁরাই আবার ক্ষমতার দ্বন্দ্বে যিনি অঘোরে প্রাণ দেন তাঁকে শহীদ বলতে উচ্চকণ্ঠ। ধর্মের ঝোলটা তেমন গাঢ় নয়, সকলেই নিজের পাতে টানতে পারেন। সুকুমার শিশু-কিশোরদের ওপর মায়া করে আর বিতর্ক না হয় আমরা নাইবা বাড়ালাম। এক বিজয় দিবসে একটা বিনীত প্রস্তাব করে আমি উত্তপ্ত বিতর্কের সৃষ্টি করেছিলাম তা স্মরণ করেই এই সামান্য প্রস্তাব।

আমরা সরকারকে অবিশ্বাস করি না। সরকার কোনো আইনি অন্যথা করলে আমরা আদালতের দ্বারস্থ হব। নিজের পাতে ঝোল টানার মতো টেনেটুনে সংবিধানের ব্যাখ্যা দেওয়া হলেও আমরা তা নিয়ে এখন কোনো বিতর্ক সৃষ্টি করতে চাই না। আমরা অপেক্ষা করতে চাই। তেমন ভরসা করতে না পারলেও আমরা আশা করি, আগামী বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে দেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে নির্বাচিত সরকার অধিষ্ঠিত হবে। বর্তমান সরকারের জন্য সে হবে তার ইমানের পরীক্ষা। সম্ভব হলে সেই নির্বাচন ষোলই ডিসেম্বরের আগেই অনুষ্ঠিত হতে পারে, যাতে করে নির্বাচিত সরকারের সময় আগামী বিজয় দিবস আমরা সোত্সাহে ও নির্বিঘ্নে পালন করতে পারি, যেমনটি আমরা পালন করেছিলাম ১৯৯৬ সালে। আর তা না হলে সিডরের চেয়ে ভয়াবহ এক দুর্যোগ এই দুর্যোগপ্রবণ দেশে আবার ছোবল দেবে। পরস্পর খেয়োখেয়িতে আমরা শেষ হয়ে যাব। খোদা না করুন, সে বিপদ আমাদের দেখতে হয়। আশা করি আল্লাহ না বলার জন্য সৃষ্টিকর্তা আমার প্রতি নারাজ হবেন না। জয় বাংলা।

সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০০৭ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত