বিজ্ঞাপন
default-image

মিরপুর ব্রিজ, ঢাকা, সকাল আটটা

১০১ কমিউনিকেশন জোনের কমান্ডার মেজর জেনারেল জি এস নাগরা ও ৯৫ মাউনটেন ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার এইচ এস ক্লার মিরপুর ব্রিজের পশ্চিম মাথায় এসে পৌঁছালেন। ব্রিগেডিয়ার ক্লার ভোর চারটার দিকে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল কমান্ডার লে. জেনারেল এ এ কে নিয়াজির একটি বেতারবার্তা ইন্টারসেপ্ট করে জানতে পেরেছেন যে জেনারেল নিয়াজি তাঁর অধীনের সবাইকে ভোর পাঁচটা থেকে অস্ত্রবিরতির আদেশ দিয়েছেন। সকাল সাতটার দিকে জেনারেল নাগরা মৌচাক স্কাউট ক্যাম্পের কাছে ৯৫ মাউনটেন ব্রিগেড সদরে পৌঁছালে ব্রিগেডিয়ার ক্লার বিষয়টি তাঁকে জানালেন। জেনারেল নাগরা ব্রিগেডিয়ার ক্লারকে নিয়ে হেলিকপ্টারে চেপে আমিনবাজার পৌঁছালেন। তাঁদের সঙ্গে আরও ছিলেন কাদের বাহিনীর প্রধান কাদের সিদ্দিকী। এর আগে ১৪ ডিসেম্বর রাতে ঢাকার আমেরিকান কনসাল জেনারেল হার্বার্ড ডি স্পিভাকের মাধ্যমে জেনারেল নিয়াজি জেনারেল মানেক শ’র কাছে অস্ত্রবিরতির অনুরোধ পাঠিয়েছিলেন। ১৫ ডিসেম্বর দুপুরে জেনারেল মানেক শ ১৬ ডিসেম্বর সকাল নয়টা পর্যন্ত অস্ত্রবিরতিতে (শুধু বিমান হামলা) সম্মত হন এবং জেনারেল নিয়াজিকে পাকিস্তানি বাহিনী যেখানে যে অবস্থায় আছে সে অবস্থায় ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের পরামর্শ দেন, পরবর্তীকালে জেনারেল নিয়াজির অনুরোধে পূর্বাঞ্চল (ভারত) কমান্ডার লে. জেনারেল জগজিত্ সিং অরোরা এ সময়সীমা ১৬ ডিসেম্বর বিকেল তিনটা পর্যন্ত বাড়িয়ে দেন।

শীতের সকাল, মিরপুর ব্রিজের আশপাশে কুয়াশা তখনো ভালোভাবে কাটেনি। জেনারেল নাগরা সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে সকাল সাড়ে আটটায় তাঁর এডিসি ক্যাপ্টেন মেহতা এবং ২ প্যারা ব্যাটালিয়নের অ্যাডজুটেন্ট ক্যাপ্টেন নির্ভয় কুমারকে জিপে করে জেনারেল নিয়াজির জন্য একটি বার্তাসহ ঢাকা সেনানিবাসে পাঠালেন। ভারতীয় হিসেবে এ দুজনই প্রথম ঢাকায় প্রবেশ করলেন। শান্তির প্রতীক হিসেবে জিপে ছিল সাদা পতাকা। বার্তায় জেনারেল নাগরা লিখলেন, ‘প্রিয় আবদুল্লাহ, আমি এখন মিরপুর ব্রিজে। খেলা শেষ। লড়াই খতম করার ব্যাপারে তুমি ভালো ভূমিকা রেখেছ। আমার পরামর্শ হলো, এখন তুমি বিরতি নাও। আমাকে স্বাগত জানানোর জন্য অন্য কাউকে পাঠাও।’ নয়টার সময় জেনারেল নাগরার বার্তা জেনারেল নিয়াজির হাতে পৌঁছাল।

ফোর্ট উইলিয়াম, কলকাতা, সকাল নয়টা

ফোর্ট উইলিয়ামে ভারতীয় পূর্বাঞ্চল বাহিনীর সদর দপ্তরে স্টাফ ব্রিফিং বা প্রাতঃকালীন সভা চলাকালে জেনারেল অরোরা জেনারেল নিয়াজির তারবার্তা পেলেন। বার্তাটি ছিল—জেনারেল নিয়াজি যুদ্ধবিরতির জন্য প্রস্তুত এবং এ বিষয়ে আলোচনার জন্য তিনি ঢাকায় একজন স্টাফ অফিসার পাঠানোর অনুরোধ করেছেন। ১৫ ডিসেম্বর জেনারেল মানেক শ যুদ্ধবিরতি বা আত্মসমর্পণের প্রয়োজনে পূর্বাঞ্চল (ভারতীয়) বাহিনীর বেতার ফ্রিকোয়েন্সি জেনারেল নিয়াজিকে দিয়ে রেখেছিলেন। জেনারেল অরোরা উপস্থিত অফিসারদের যুদ্ধজয়ের সংবাদ দিলেন এবং তাঁদের অভিনন্দন জানালেন। জেনারেল নিয়াজির আত্মসমর্পণ এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র, আগের দিনই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল, কীভাবে আত্মসমর্পণ হতে পারে তার প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছিল। ১৫ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণের দলিলের খসড়া তৈরি করে দিল্লি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। খসড়াটি তৈরি করেছিলেন পূর্বাঞ্চল (ভারতীয়) বাহিনীর চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব, তাঁকে সহযোগিতা করেছিলেন ব্রিগেডিয়ার এ এম সেথনা।

সামরিক নিয়ম অনুযায়ী, বিজিত কমান্ডার বিজয়ী কমান্ডারের সদর দপ্তরে এসে আত্মসমর্পণ করেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জাপানি কমান্ডার আমেরিকান কমান্ডার জেনারেল ম্যাকার্থারের জাহাজে (সদর দপ্তর) এসে আত্মসমর্পণ করেছিলেন, যদিও ম্যাকার্থারের জাহাজ জাপানের সমুদ্রসীমাতেই ছিল। কিন্তু জেনারেল অরোরা ব্যতিক্রম করলেন, তিনি রমনা রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) সর্বসাধারণের সামনে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করলেন। ইতিহাসে এর আগে কখনো জনসমক্ষে এ ধরনের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠিত হয়নি। বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারকে এ বিষয়ে তখনো কিছু জানানো হয়নি—সম্ভবত নিরাপত্তার স্বার্থে। আত্মসমর্পণ বিষয়ে আলোচনার জন্য জেনারেল জ্যাকব দুপুর ১১টায় হেলিকপ্টারযোগে যশোর হয়ে ঢাকা রওনা দিলেন, জেনারেল জ্যাকবের সঙ্গে ছিলেন এয়ার কমোডর পুরুষোত্তম এবং কর্নেল এম এস খারা।

স্টাফ ব্রিফিং শেষে জেনারেল অরোরা একজন স্টাফ অফিসারকে কলকাতা নিউ মার্কেটে পাঠালেন মজবুত ও মোটা একটা ফাউনটেন কলম কেনার জন্য। ওই অফিসার একটা শেফার কলম কিনে আনলেন।

কুর্মিটোলা সেনানিবাস, ঢাকা, সকাল সাড়ে নয়টা

ক্যাপ্টেন নির্ভয় কুমার ও ক্যাপ্টেন মেহতা জেনারেল নিয়াজিকে জেনারেল নাগরার বার্তা পৌঁছে দিলেন। ওই সময় ওখানে উপস্থিত ছিলেন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী, মেজর জেনারেল মুহাম্মদ জামসেদ খান, রিয়ার অ্যাডমিরাল মুহাম্মদ শরীফ, ব্রিগেডিয়ার বাকের সিদ্দিকী। জেনারেল নিয়াজি ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলেন না যে এ মুহূর্তে তাঁর কী করণীয়, যদিও কিছুক্ষণ আগেই তিনি জেনারেল অরোরাকে অস্ত্রবিরতির জন্য প্রতিনিধি পাঠানোর অনুরোধ করেছেন। জেনারেল রাও ফরমান জেনারেল নিয়াজির কাছে জানতে চাইলেন যে ঢাকা রক্ষা করার মতো যথেষ্ট শক্তি তার আছে কি না। জেনারেল নিয়াজি উত্তরের জন্য ঢাকা এলাকার প্রতিরক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত জেনারেল জামসেদের দিকে তাকালেন। জেনারেল জামসেদ মাথা নাড়লেন—তিনি ঢাকাকে রক্ষা করতে অক্ষম। নিয়াজি আর বাক্য ব্যয় না করে জেনারেল জামসেদকে জেনারেল নাগরার সঙ্গে দেখা করতে মিরপুরে পাঠালেন। এদিকে ভারতীয়দের আগমন উপলক্ষে পূর্বাঞ্চল (পাকিস্তান) বাহিনীর সদর দপ্তরের মানচিত্রগুলো খুলে ফেলা হলো; অফিসার মেসে বলা হলো ভারতীয় অফিসারদের জন্য অতিরিক্ত রান্নার আয়োজন করতে।

জেনারেল জামসেদ কিছু পাকিস্তানি অফিসারকে সঙ্গে নিয়ে জেনারেল নাগরাকে অভ্যর্থনা জানাতে মিরপুর ব্রিজে পৌঁছালেন। পৌনে ১১টার দিকে জেনারেল নাগরা কিছু ভারতীয় সৈনিকসহ বিজয়ীর বেশে ঢাকায় প্রবেশ করলেন। সঙ্গে ছিলেন ব্রিগেডিয়ার সান সিং, ব্রিগেডিয়ার ক্লার ও কাদের সিদ্দিকী। প্রথমে তাঁরা জেনারেল জামসেদের ইপিসিএএফ সদর দপ্তর (মোহাম্মদপুর মডেল স্কুল) গেলেন, সেখান থেকে পূর্বাঞ্চল (পাকিস্তান) সদর দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করে কুর্মিটোলা সেনানিবাস রওনা হলেন। জেনারেল নাগরাকে জেনারেল নিয়াজির অফিসে নিয়ে যাওয়া হলো। নিয়াজি আর নাগরা পূর্বপরিচিত ছিলেন, যুদ্ধপরিস্থিতি ভুলে গিয়ে তাঁরা হালকা মেজাজের গল্পে জমে গেলেন। জেনারেল নাগরা রেডক্রস ঘোষিত নিরপেক্ষ এলাকা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের (বর্তমানের শেরাটন হোটেল) নিরাপত্তার জন্য পাঠালেন ব্রিগেডিয়ার ক্লারকে।

থিয়েটার রোড, কলকাতা, সকাল ১১টা

ভারতীয় সামরিক বাহিনীর লিয়াজোঁ অফিসার কর্নেল পি দাস প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর ব্যক্তিগত সচিব ফারুক আজিজ খানের মাধ্যমে বিকেলে অনুষ্ঠেয় পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের খবর জানান। প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ বাহিনীর প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম এ জি ওসমানীর খোঁজ করতে গিয়ে জানতে পারলেন কর্নেল ওসমানী ব্রিগেডিয়ার উজ্জ্বল গুপ্ত (ভারতীয় বাহিনী) এবং লে. কর্নেল আব্দুর রবকে নিয়ে সিলেটের দিকে মুক্ত এলাকা পরিদর্শনে গেছেন। প্রধানমন্ত্রী গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকারকে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ বাহিনীর প্রতিনিধিত্ব করার জন্য জেনারেল অরোরার সঙ্গে ঢাকা যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। এ সময় এ কে খন্দকার সরকারি কাজে তাঁর অফিসের বাইরে ছিলেন। ফারুক আজিজ খান এবং প্রধানমন্ত্রীর মিলিটারি লিয়াজোঁ অফিসার মেজর নূরুল ইসলাম তাঁকে চারদিকে খুঁজতে শুরু করেন। গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দকার ফিরে আসা মাত্র প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে জনাব ফারুক ও মেজর ইসলামকে নিয়ে দমদম বিমানবন্দরের দিকে ছুটলেন; সামরিক পোশাক পরার সময়ও তিনি পেলেন না।

গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দকার বিমানবন্দরে পৌঁছানোর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মিসেস ও জেনারেল অরোরা বিমানবন্দরে পৌঁছালেন। জেনারেল অরোরার পরনে ছিল ধূসর রঙের ফুলপ্যান্ট ও জামা, মাথায় শিখদের ঐতিহ্যবাহী পাগড়ি; মিসেস বান্তি অরোরা পরেছিলেন বেগুনি রঙের শাড়ি। গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দকার জেনারেল অরোরাকে নিজের পরিচয় দেওয়ার পর জেনারেল অরোরা মুক্তিবাহিনীর প্রতিনিধি হিসেবে গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দকারকে আগে ট্রান্সপোর্ট প্লেনে আরোহণের জন্য আহ্বান করলেন। মিসেস অরোরা প্রথমে ট্রান্সপোর্ট প্লেনে উঠলেন এরপর গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দকার এবং শেষে জেনারেল অরোরা। প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই ট্রান্সপোর্ট প্লেন বাংলাদেশের ওপর দিয়ে আগরতলার উদ্দেশে রওনা হলো। আগরতলায় এসে ট্রান্সপোর্ট প্লেন থেকে নামলেন সবাই। তাঁরা আগে থেকে প্রস্তুত কয়েকটি হেলিকপ্টারে আরোহণ করলেন। এখানে জেনারেল অরোরার সঙ্গে যোগ দিলেন চতুর্থ কোর কমান্ডার জেনারেল সাগাত্ সিং এবং ওই কোরের অন্য ডিভিশন কমান্ডাররা। হেলিকপ্টারগুলো আড়াইটার দিকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিল।

তেজগাঁও বিমানবন্দর, ঢাকা, দুপুর একটা

জেনারেল জ্যাকব তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণ করলেন। পূর্বাঞ্চল (পাকিস্তান) বাহিনীর চিফ অব স্টাফ ব্রিগেডিয়ার বাকের সিদ্দিকী এবং জাতিসংঘের ঢাকা প্রতিনিধি তাঁকে অভ্যর্থনা জানালেন। জেনারেল জ্যাকব লক্ষ করলেন, পাকিস্তান বাহিনীর দুটি অ্যালভেট থ্রি হেলিকপ্টার উড়ে পূর্ব-দক্ষিণ দিকে চলে গেল। পরে জানা গেছে, এ দুটি হেলিকপ্টার বার্মা হয়ে পাকিস্তান পালিয়ে গেছে। একইভাবে ১৫-১৬ ডিসেম্বর রাতে আরও চারটি পাকিস্তানি হেলিকপ্টার মিয়ানমার পালিয়ে গিয়েছিল। ব্রিগেডিয়ার বাকের জেনারেল জ্যাকব ও কর্নেল খারাকে নিয়ে কালো সেভ্রলেট গাড়িতে চেপে পূর্বাঞ্চল (পাকিস্তান) বাহিনীর সদর দপ্তরে রওনা হলেন। এয়ার কমোডর পুরুষোত্তম বিমানবন্দরে থেকে গেলেন জেনারেল অরোরা ও অন্যদের জন্য আয়োজন করতে।

জেনারেল নিয়াজির অফিসে এসে জেনারেল জ্যাকব লক্ষ করলেন, নিয়াজি আর জেনারেল নাগরা পাঞ্জাবি ভাষায় পরস্পরকে একটার পর একটা স্থূল আদিরসাত্মক কৌতুক উপহার দিচ্ছেন। এখানে আরও উপস্থিত ছিলেন জেনারেল রাও ফরমান আলী, জেনারেল জামসেদ, বিয়ার এডমিরাল শরিফ ও এয়ার ভাইস মার্শাল ইনাম উল হক; ছিলেন ভারতীয় বাহিনীর জেনারেল নাগরা ও ব্রিগেডিয়ার ক্লারও। নিয়াজির সঙ্গে আলোচনার আগে জ্যাকব জেনারেল নাগরাকে আলাদাভাবে ডেকে নিয়ে প্রয়োজনীয়সংখ্যক ভারতীয় সৈনিক ঢাকায় আনার নির্দেশ দিলেন এবং ঢাকার নিরাপত্তা, আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের খুঁটিনাটি যেমন গার্ড অব অনার, টেবিল-চেয়ার ইত্যাদির ব্যবস্থা করতে পাঠিয়ে দিলেন।

এরপর আত্মসমর্পণ নিয়ে আলোচনা শুরু হলো দুই পক্ষের মধ্যে। পিনপতন নীরবতার মধ্যে কর্নেল খারা আত্মসমর্পণের শর্তগুলো পড়ে খসড়া কপিটি জেনারেল নিয়াজিকে দিলেন। পাকিস্তানিদের মধ্যে অস্থিরতা দেখা দিল। তাঁদের ধারণা ছিল, ১৪ ডিসেম্বর তাঁদের প্রেরিত প্রস্তাবের আলোকে যুদ্ধবিরতির ব্যবস্থা হবে—আত্মসমর্পণের নয়। জেনারেল ফরমান আলী যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের বিরোধিতা করলেন, তিনি ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের পক্ষে মত দিলেন। জেনারেল নিয়াজি দলিলটি অন্যদের দিলেন দেখার জন্য। কেউ কেউ কিছু পরিবর্তনের কথা বললেন। নিয়াজি দলিলটিকে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ হিসেবে বর্ণনা করলেন।

জেনারেল জ্যাকব জানালেন, দলিলে পাকিস্তানিদের পক্ষে বেশ কিছু শর্ত আছে, যেমন পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী আচরণ করা হবে এবং সার্বিক নিরাপত্তাও নিশ্চিত করা হবে। এমনকি পাকিস্তানপন্থী সকল বেসামরিক জনগণের নিরাপত্তার বিষয়ও দলিলে উল্লেখ আছে, যা আগে কখনো কোনো আত্মসমর্পণের দলিলে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। জ্যাকব জানালেন, এই দলিলে যথেষ্ট উদারতা দেখানো হয়েছে এবং এতে কোনো পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়।

চিন্তা করার জন্য পাকিস্তানিদের কিছু সময় নেওয়ার কথা বলে জেনারেল জ্যাকব ও কর্নেল খারা ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। ঢুকলেন আধাঘণ্টা পর। নিয়াজিকে দলিলের গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন জ্যাকব। নিয়াজি উত্তর দিলেন না। জ্যাকব আরও দুবার একই কথা জিজ্ঞাসা করলেন, তার পরও নিয়াজি কোনো উত্তর না দিয়ে দলিলটি জ্যাকবকে ফেরত দিলেন। জেনারেল জ্যাকব এটাকে সম্মতি হিসেবে গ্রহণ করলেন। জেনারেল নিয়াজির চোখ বেয়ে অশ্রু নেমে এল।

এরপর আত্মসমর্পণের পদ্ধতি নিয়ে আলাপ শুরু হলো। জেনারেল জ্যাকব জানালেন, আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান হবে রেসকোর্স ময়দানে। সেখানে প্রথমে ভারত ও পাকিস্তান বাহিনীর সম্মিলিত দল জেনারেল অরোরাকে গার্ড অব অনার প্রদান করবে। এরপর আত্মসমর্পণের দলিল স্বাক্ষর হবে এবং শেষে জেনারেল নিয়াজি তার অস্ত্র ও পদবির ব্যাজ খুলে জেনারেল অরোরাকে হস্তান্তর করবেন। আত্মসমর্পণ পদ্ধতির কিছু কিছু ব্যবস্থায় জেনারেল নিয়াজি গররাজি ছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান তার অফিসেই হোক। শর্তগুলোর বিষয়ে জেনারেল জ্যাকবের অনড় অবস্থানের কারণে শেষে তিনি সবই মেনে নেন তবে আত্মসমর্পণের পরও নিরাপত্তার জন্য তার অফিসার ও সৈনিকদের ব্যক্তিগত অস্ত্র নিজেদের কাছে রাখার অনুমতি চাইলেন। জ্যাকব তা মেনে নিলেন।

পাকিস্তানিরা প্রকৃত অর্থে ঢাকায় অন্ত্র সমর্পণ করে ১৯ ডিসেম্বর দুপুর ১১টায়, কুর্মিটোলা গলফ গ্রাউন্ডে। সমঝোতার পর আত্মসমর্পণের খসড়া দলিলে উভয় পক্ষ স্বাক্ষর করলেন। নিয়াজির সঙ্গে আত্মসমর্পণ বিষয়ে আলোচনা এবং সিদ্ধান্তগুলো জ্যাকব পাকিস্তানি বেতারযন্ত্রের সাহায্যেই ফোর্ট উইলিয়ামে জানিয়ে দিলেন। এরপর জেনারেল জ্যাকব জেনারেল নিয়াজির দাওয়াতে অফিসার মেসে দুপুরের খাওয়ার খেতে গেলেন। এ দাওয়াত অবশ্য তিনি কলকাতা থেকে রওনা হওয়ার আগেই পেয়েছিলেন।

ডেমরা, ঢাকা, দুপুর দুইটা

এস ফোর্স কমান্ডার লে. কর্নেল কে এম সফিউল্লাহকে ৩১১ ইনফেন্ট্রি ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার মিশ্রা অনুষ্ঠেয় আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের সংবাদ দিলেন। তিনি আরও জানালেন, কর্নেল সফিউল্লাহকে ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য ৫৭ মাউনটেন ডিভিশন থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ডেমরা থেকে ঢাকা পর্যন্ত রাস্তায় পাকিস্তান বাহিনীর অনেক প্রতিরক্ষা অবস্থান ছিল। যদিও কিছুক্ষণ আগেই স্থানীয় পাকিস্তানি কমান্ডার লে. কর্নেল খিলজি ডেমরায় যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে তবুও নিরাপত্তার স্বার্থে কর্নেল সফিউল্লাহ্ পাকিস্তানি জিপে করেই পাকিস্তানি গার্ডসহ বিকেল তিনটার দিকে ঢাকা রওনা দিলেন। জিপ চালালেন কর্নেল খিলজি। তাঁরা বিকেল পৌনে চারটার দিকে তেজগাঁও বিমানবন্দরে এসে পৌঁছালেন।

তেজগাঁও বিমানবন্দর, ঢাকা, বিকেল চারটা

পূর্বদিক থেকে এসে চারটি এমআই-৪ আর পাঁচটি অ্যালভেট হেলিকপ্টার ক্ষত-বিক্ষত তেজগাঁও বিমানবন্দরের মূল রানওয়ের পাশে টারমাকে অবতরণ করল। এক এক করে নেমে এলেন জেনারেল অরোরা, এয়ার ভাইস মার্শাল দিওয়ান, ভাইস এডমিরাল এন কৃষ্ণান, লে. জেনারেল সাগাত্ সিং এবং উইং কমান্ডার এ কে খন্দকার। জেনারেল নিয়াজি এবং জেনারেল জ্যাকব জেনারেল অরোরাকে সামরিক কায়দায় অভ্যর্থনা জানালেন। বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছিল হাজার হাজার উত্ফুল্ল বাঙালি, বিভিন্ন স্লোগানের মাধ্যমে তাঁরা জেনারেল অরোরাকে স্বাগত জানাল। কিছু সাংবাদিকও সেখানে উপস্থিত ছিলেন, যাঁরা জেনারেল অরোরার সাক্ষাত্কার নেওয়ার বা প্রতিক্রিয়া জানার চেষ্টা করলেন।

অল্প সময়ের মধ্যে আগতদের অভ্যর্থনা জানিয়ে অপেক্ষমাণ মোটরগাড়িতে নিয়ে যাওয়া হলো। জেনারেল অরোরা ছাড়া বাকি সবাই ভারতীয় ও পাকিস্তানি সামরিক যানে করে রেসকোর্স ময়দানে রওনা হলেন। শেষে জেনারেল অরোরাকে নেওয়া হলো জেনারেল নিয়াজির মার্সিডিজ গাড়িতে। অরোরা, মিসেস অরোরা এবং দিওয়ান গাড়ির পেছনের আসনে বসলেন, নিয়াজি বসলেন সামনের সিটে চালকের পাশে। জেনারেল নিয়াজির পাইলট জিপকে সামনে রেখে কমান্ডারদের মার্সিডিজ গাড়ি রেসকোর্স ময়দানের উদ্দেশে রওনা দিল।

রেসকোর্স ময়দান, ঢাকা, বিকেল সাড়ে চারটা

বিজয়ী কমান্ডার জেনারেল অরোরা রেসকোর্স ময়দানে পৌঁছালে তাঁকে যৌথভাবে ভারত ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সেনাদল গার্ড অব অনার দেয়। এরপর জেনারেল অরোরা এবং জেনারেল নিয়াজি জিমখানা ক্লাবের পূর্বদিকের খোলা মাঠে পশ্চিমমুখী করে বসানো ছোট্ট কাঠের টেবিল ও দুটি চেয়ারের কাছে এসে দাঁড়ালেন। চেয়ার-টেবিল দুটি সেনানিবাসের অফিসার মেস থেকে আনা হয়েছিল। জেনারেল অরোরা সঙ্গে আনা সাইক্লোস্টাইল করা আত্মসমর্পণের দুই কপি দলিল থেকে একটি জেনারেল নিয়াজিকে দিলেন। জেনারেল নিয়াজি দলিলটি তিন-চার মিনিট ধরে দেখলেন, তারপর বাম দিকের চেয়ারে বসে পড়লেন স্বাক্ষর দেওয়ার জন্য। জেনারেল অরোরা বসলেন ডানের চেয়ারটিতে।

জেনারেল নিয়াজির সঙ্গে কোনো কলম ছিল না। অরোরা সকালে কেনা সেফার কলমটি নিয়াজির দিকে বাড়িয়ে দিলেন। জেনারেল নিয়াজি কলমটি নিয়ে স্বাক্ষর করতে গিয়ে দেখেন কলমে কালি সরছে না। হাত বাড়িয়ে অরোরা কলমটি হাতে নিলেন তারপর কয়েকবার ঝাঁকি দিয়ে আবার নিয়াজির হাতে ধরিয়ে দিলেন। জেনারেল নিয়াজি দুটি দলিলেই স্বাক্ষর করলেন, তাঁর স্বাক্ষরের পর বিজয়ী কমান্ডার জেনারেল অরোরা প্রতিস্বাক্ষর করলেন। দলিলে আত্মসমর্পণের সময় হাতে লেখা হলো ১৬৩১ (ভারতীয় সময়) অর্থাত্ বাংলাদেশি সময় বিকেল পাঁচটা এক মিনিট। এ দুটি দলিলের একটি ফোর্ট উইলিয়ামে অপরটি জেনারেল অরোরার নিউ দিল্লির বাসায় সংরক্ষিত হচ্ছে। আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করার পর জেনারেল নিয়াজি উঠে দাঁড়ালেন। তিনি তার .৩৮ রিভলবারের গুলিসমূহ বের করে লাইনিয়ার্ডসহ জেনারেল অরোরার হাতে তুলে দিলেন, এরপর তাঁর পদবির ব্যাজ খুলে দিলেন জেনারেল অরোরার হাতে। নিয়াজির চোখের কোণে অশ্রু চিকচিক করছিল। জেনারেল অরোরা জেনারেল নিয়াজিকে সান্ত্বনা দিলেন।

১৬ ডিসেম্বর রেসকোর্স ময়দানে জেনারেল নিয়াজি আত্মসমর্পণ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে খলনায়ক হিসেবে চিহ্নিত থাকলেন। এর ঠিক ৪০০ বছর আগে রেসকোর্স ময়দান থেকে ৪০ মাইল দূরে এগারোসিন্ধুতে তাঁর পূর্বপুরুষ ঈসা খাঁ মোগল সেনাপতি মানসিংহকে পরাজিত করে বাংলার ইতিহাসে নায়ক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিলেন।

সামরিক ঐতিহ্য হিসেবে বিজিত কমান্ডার বিজয়ী কমান্ডারের কাছে তরবারি সমর্পণের মাধ্যমে প্রকাশ্য ও শারীরিক আত্মসমর্পণ করেন। জেনারেল নিয়াজির কোনো তরবারি ছিল না; পাকিস্তানি সিনিয়র অফিসাররা কোনো অস্ত্র সঙ্গে রাখতেন না। নিয়াজি যে অস্ত্র জমা দিলেন সেটি ছিল কোনো এক মিলিটারি পুলিশের একটা অপরিচ্ছন্ন রিভলবার, ছেঁড়া ও পুরাতন লাইনিয়ার্ডসহ নিয়াজি সেটা অরোরার হাতে তুলে দেন। এই পিস্তলটি এখন দেরাদুন মিলিটারি একাডেমি জাদুঘরে ভারতীয় বাহিনীর বিজয়ের স্মারক হিসেবে সংরক্ষিত আছে।

জেনারেল অরোরা কিছুটা হেঁটে সাধারণ মানুষের কাছাকাছি এলেন, তারা তাঁকে কাঁধে তুলে তাদের আনন্দ প্রকাশ করল। জেনারেল অরোরা হানাদার বাহিনীকে চতুর্থ কোরের কমান্ডার লে. জেনারেল সাগাত্ সিংয়ের অধীনে রেখে তেজগাঁও বিমানবন্দরে রওনা হলেন। এ সময় বাঙালিরা পাকিস্তান আর জেনারেল নিয়াজির বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে শুরু করে; ভারতীয় কমান্ডাররা জেনারেল নিয়াজিকে তাঁদের নিরাপত্তা বেষ্টনীতে নিয়ে ভারতীয় বাহিনীর জিপে করে ঢাকা সেনানিবাসে পৌঁছে দেন।

বিকেল পাঁচটা। প্রায় এক লাখ বাঙালি ১৬ ডিসেম্বরের পড়ন্ত বিকেলে হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ আর নিজেদের বিজয়ের ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে থাকলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে ১৬ ডিসেম্বরের সূর্য অস্ত গেল। ১৭ ডিসেম্বর সূর্যোদয় হলো একটি নতুন দেশে—নাম বাংলাদেশ।

[email protected]

সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০০৭ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত