বিজ্ঞাপন
default-image

যশোরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রতিরোধ ভেঙে পরাটা ছিল যুদ্ধের সবচেয়ে কৌতূহলী ধাঁধার একটি। ভারতীয় সেনা উৎস ও অন্যান্য বিশেষজ্ঞ পর্যবেক্ষকেরা কয়েক সপ্তাহ ধরেই ধারণা করছিল, যশোর ক্যান্টনমেন্ট দখল করতে ভারতীয় বাহিনীকে মরণঘাতী অবরোধ করতে হবে, প্রাণক্ষয়ও করতে হবে অনেক। যশোর ক্যান্টনমেন্টের আয়তন কয়েক মাইল, শহরের ঠিক বাইরেই এর অবস্থান।

গত সপ্তাহের শুরুতে ভারতীয় গোয়েন্দাদের খবর অনুযায়ী যশোর ক্যান্টনমেন্ট ছিল খুবই সুরক্ষিত। পুরো এক পদাতিক ব্রিগেডের পাঁচ হাজার সৈন্য সেখানে পাহারা দিচ্ছিল। সঙ্গে ছিল ভারী গোলন্দাজ বাহিনী, ৪০টি ট্যাংক, বিশাল এলাকাজুড়ে মাইনের নেটওয়ার্ক, সুরক্ষিত বাংকার ও সাজোয়া বিধ্বংসী কামান স্থাপনের জন্য মরিচা। সব দেখেশুনে মনে হচ্ছিল, পাকিস্তানিরা মাটি আঁকড়ে যুদ্ধ করবে।

তা হলো না, বরং ভারতীয় সেনাবাহিনীর নবম ডিভিশনের আত্মতৃপ্ত কমান্ডিং কর্মকর্তা কর্নেল পি এস দেশপান্ডের হুল ফোটানো কথায় জানা গেল: ‘তারা পালিয়েছে’। ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে ভারতীয় কামান ও পদাতিক বাহিনী তা দখল করে নেয়। শুরুতে তারা ভেবেছিল, এক সপ্তাহের তুমুল লড়াইয়ের পর হয়তো তারা তা দখল করতে পারবে। গুরুত্বপূর্ণ যশোর বিমান ঘাঁটি আক্ষরিক অর্থে একটিও গুলি খরচ না করে ভারতীয়রা দখল করে নেয়। কর্নেল দেশপান্ডে পুনরাবৃত্তি করলেন: ‘এক রাউন্ড গুলিও না খরচ করে’।

এই তাক লাগানো পরাজয়ের মূল কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাদের চরম পর্যায়ের মনোবলহীনতা। গত সপ্তাহজুড়ে পাকিস্তানি বাহিনী কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই আত্মসমর্পণ করছিল। কামালপুরে ৩১ বেলুচের ১৬০ জনের একটি গ্যারিসন একটিও গুলি না করে ক্ষান্ত দেয়। যোদ্ধা হিসেবে এ ইউনিটের সুনাম ছিল। ওদিকে কুমিল্লার কাছে ২৫ ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের কমান্ডিং অফিসার তার ১০০ জন সেনাসহ ভারতের এক প্লাটুনের কাছে আত্মসমর্পণ করে, এটিও একটি ভালো যোদ্ধা ইউনিট ছিল। ঢাকার সুরক্ষায় আখাউড়া একটি কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ রেলওয়ে শহর। সেখানে পাকিস্তানিরা অতিরিক্ত সৈন্য সমাবেশ করেছিল, সামরিক বাহন ও বড় কামান জড়ো করেছিল। কিন্তু তার পরও তারা সেখানে প্রতীকী প্রতিরোধ যুদ্ধের পর আত্মসমর্পণ করে।

কর্নেল দেশপান্ডের কথার সারবত্তা খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন কোনো বিষয় ছিল না। তিনি বলেছিলেন,

‘পাকিস্তানিদের মনোবল একেবারে নিম্ন পর্যায়ে গেছে।’ গত এক পক্ষ ধরে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা তাঁদের স্ত্রী-পরিবার নিয়ে ঢাকায় পালিয়ে যাচ্ছিলেন। গুজব ছিল, একটি বিশেষ বিমানে তাঁদের পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হবে। এ খবরে সাধারণ সৈনিকদের উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিল। ভারতীয়রা নানাভাবে আঘাত হানছিল-লাউড স্পিকারে, প্রচারপত্র ছড়িয়ে, বেতারবার্তায়। তাদের বার্তা ছিল সরল, কিন্তু পরিষ্কার, ‘মুক্তিবাহিনী আপনাদের পাকড়াও করার আগেই আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করুন।’

ভারতীয় বাহিনী পৌঁছানোর আগে মুক্তিবাহিনী যেসব এলাকার দখল নিয়েছিল, সেখানকার নদীতে পাকিস্তানি সেনাদের লাশ ভেসেছে।

গত এক সপ্তাহে ভারতীয় বাহিনীর এরূপ ত্বরিত অগ্রগতি পাকিস্তানিদের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিয়েছে। কিছু কিছু জায়গায় পাকিস্তানি বাহিনী সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করেছে। ভারতীয়রা পার্বত্য অঞ্চলের ব্যাপারে একদমই নিশ্চুপ রয়েছে। সেখানে পাকিস্তানি সেনার সংখ্যা কত, তা কেউ জানে না। পাকিস্তানি সেনারা সেখানে একেবারেই বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজেদের অবস্থান ধরে রেখেছে।

যশোরের কাছাকাছি দুটি জোরালো যুদ্ধ হয়েছিল যা কর্নেল দেশপান্ডের উচ্ছ্বসিত ভাষায় ‘মারদাঙ্গা লড়াই হয়েছে’। কিন্তু এতেও ভারতীয় বাহিনীর শহর ও সেনানিবাস অভিমুখী অগ্রযাত্রা রুখতে পারেনি।

এটা পরিষ্কার, পাকিস্তানিরা ভারতীয় বাহিনীর অগ্রযাত্রার গতি ঠাহর করতে পারেনি। আর সেনানিবাসের পরিচালনা-কক্ষে চিহ্নিত যে মানচিত্র রয়েছে, তা দেখে বোঝা যায় যে পাকিস্তানিরা আশা করেনি যে ভারত একদিনের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ আক্রমণ করবে।

বুধবার তাড়াহুড়ো করে যখন প্রস্থান শুরু হয়, তখন ভারতীয়রা মাত্র ছয় হাজার গজ দূরে। পাকিস্তানিরা এত দ্রুত সে স্থান ত্যাগ করে যে প্রতিলিপি করার যন্ত্রে তখনো সেদিনের কাজের নির্দেশনামা ছাপার অপেক্ষায় ছিল এবং আধা-রান্না খাবার অফিসার মেসে পড়েছিল।

অধিকাংশ পাকিস্তানি সেনাই পালাতে সক্ষম হয়। খুলনা যাওয়ার যে সড়ক ধরে তারা পালিয়েছিল সেখানে বাধা ছিল না বললেই চলে। তারা বড় কামানগুলো সঙ্গে নিতে সক্ষম হয়েছিল। জায়গাটি ছিল সেনানিবাসের কয়েক মাইল পেছনে। সেনানিবাসে আমি মাত্র একটি পোড়া কামান দেখতে পেলাম। অন্যদিকে তারা ছয় হাজার টন গোলাবারুদ ও সাধারণ সমর সম্ভার ফেলে রেখে যায়। পশ্চাদ্ধাবনের সময় এগুলো তাদের খুব কাজে লাগত।

এক বারোয়ারি কলামের সঙ্গে আমরা যশোরে পৌঁছালাম। একইভাবে সেনানিবাসের ফটক পার হলাম। ভাঙা ট্যাক্সিতে কলকাতা থেকে ৮৫ মাইল পাড়ি দিয়ে আমরা এখানে এসে পৌঁছালাম, হাড়গোড় প্রায় ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছিল। পেট্রাপোলের সীমান্ত ফাঁড়ি পাড়ি দেওয়ার সময় উৎসাহী জনতা আমাদের ঘিরে ধরে। সেখান থেকে যশোর পর্যন্ত প্রায় ২৫ মাইল পথের ধারে উৎসাহী জনতা দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের হাতে লাল, সবুজ, সোনালি ও সাদা পতাকা ছিল। মুহুর্মুহু জয়বাংলা স্লোগানে তারা আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করছে। বাংলাদেশ এখন স্বাধীন, ফলে জয় শব্দটিতে জোর দেওয়া নতুন ফ্যাশন হয়ে দাঁড়ায়।

চমৎকার দেশটির ভেতর দিয়ে ভ্রমণ করার সময় পাকিস্তানি বাহিনীর ত্বরিত পশ্চাদপসরণের চিহ্ন দেখা গেল। বাংলাদেশ দেখতে অনেকটা ঘনসবুজ ধানগাছের নির্মিত দাবার বোর্ডের মতো। দেশটির নানা স্থানে বাদামি পানি ও গাছপালার এক দারুণ সমারোহ। পাকিস্তানি বাহিনীর বাংকারগুলো ছিল লুক্কায়িত, কোনো যুদ্ধ ছাড়াই এসব ফেলে পালিয়েছে পাকিস্তানিরা। প্রচুর অস্ত্রও আছে সেখানে।

পালানোর সময় পাকিস্তানি সেনারা সড়কও ধ্বংস করেনি বা সেখানে মাইনও পুঁতে যায়নি। ফলে ভারতীয় প্রকৌশলীদের কাজ অনেক সহজ হয়ে যায়। তাঁরা এতে কিছুটা বিস্মিতও হন। এমনকি কোনো সেতু ধ্বংস করা হলেও ভারতীয়রা গ্রামের মাটির সড়ক ধরে এগিয়ে সে বাধা অতিক্রম করতে পেরেছে। যেমন বেতনা নদীর সেতু পাকিস্তানিরা উড়িয়ে দিলেও ভারতীয়রা তা পাশ কাটিয়ে যেতে সক্ষম হয়। গোটা কয়েক সেনা লরি ও হাফ ট্রাক পুড়ছিল, শ্বাসরুদ্ধকর ধোঁয়াও উড়ছিল সেখানে।

ঝিকরগাছায় আমরা কিছু অস্বাভাবিক নিদর্শন দেখলাম। মনে হলো, বাংলাদেশের রক্তস্নান এখনো শেষ হয়নি, স্বাভাবিক অবস্থা তখনো ফিরে আসেনি। দেখলাম, রেল লাইনের ওপর হাত-পা ছড়ানো কয়েকজন লুঙ্গি পরিহিত তরুণের লাশ পড়ে আছে। তাদের চোখ বাঁধা, হাত-পা খুব শক্তভাবে পেছনমোড়া করে বাধা। তাদের গলা কাটা, সেখান থেকে রক্ত গড়িয়ে পরে মাটি বাদামি হয়ে গেছে।

গ্রামবাসীর মতে, এরা রাজাকার। তারা পাকিস্তানিদের খুন, লুটপাট ও ধর্ষণে সহায়তা করেছে। কিন্তু কেউই স্বীকার করেনি যে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের খুন করেছে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে শোনা যাচ্ছিল, মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা মারাত্মক প্রতিশোধ নেওয়া শুরু করেছে। ক্যাঙারু আদালতে বিচারের গুজবও শোনা গেছে, যেখানে সংক্ষিপ্ত বিচার শেষে আসামিদের খুন করা হয়েছে।

তবুও বাংলাদেশের অনেক স্থানের মতো ঝিকরগাছার মানুষেরও নিজেদের ঘৃণা চরিতার্থ করার কারণ ছিল। পাকিস্তানিরা গত সপ্তাহে পাততাড়ি গোটানো শুরু করলেও যাওয়ার পথে বর্বরতার শেষ নিশানা হিসেবে অন্তত ১০০টি গ্রাম লন্ডভন্ড করে দিয়ে গেছে।

সানডে টাইমস থেকে প্রতীক বর্ধনের অনুবাদ

ফিলিপ জ্যাকবসন: ১৯৭১ সালে সানডে টাইমস -এর সংবাদদাতা

সূত্র: ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত