সেই পঞ্চাশ দশকের শুরু থেকে তত্কালীন পূর্ব বাংলায়-বাংলাদেশে-বাংলা ভাষা, গণতন্ত্র, স্বায়ত্তশাসন আর স্বাধিকারের সংগ্রামের শুরু থেকেই কবি, শিল্পী, গায়ক বা অন্যান্য মাধ্যমের সকল সংস্কৃতিসেবীর স্মরণীয় অবদানের কথা আমরা জানি। বলতে গেলে, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকেই দেশের রাজনৈতিক সংগ্রামের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক আন্দোলনও একটি স্বতন্ত্র বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছে, সর্বস্তরের মানুষকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। পরসঙ্রকে পরিপুষ্ট করেছে এই দুই ধারা।
বাংলা ভাষা, গান, রবীন্দ্রসঙ্গীত, কবিতা, নাটক নিয়ে আন্দোলনের সঙ্গে সংস্কৃতিজগতের প্রায় সকলেই নিজেদের যুক্ত করেছেন। পঞ্চাশের পর ষাটের দশকে কোনো কোনো সময়ে এ ধারা শুধু বেগবানই হয়নি, কখনো মুখ্য প্রভাবশালী ধারায় পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে বাঙালি-হূদয়ের সবচেয়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী দিন একুশে ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে দেশের মূল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ধারাটি বেগবান হয়েছে। এ প্রসঙ্গে মুনীর চৌধুরীর নাটক, শহীদুল্লাহ কায়সারের উপন্যাস, আলতাফ মাহমুদের গান, জহির রায়হানের সিনেমাসহ সকলের অবদানের কথা আমরা স্মরণ করতে পারি।
দীর্ঘ দুই দশকের বেশি সময়ের সংগ্রাম আর আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে সেই একাত্তরে, দেশবাসী যখন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মরণপণ সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ, তখন আমাদের দেশের প্রায় সকল সংস্কৃতিসেবী ও বুদ্ধিজীবী এ লড়াইয়ের সঙ্গে শুধু সহমর্মিতা প্রকাশ করেই তাদের দায়িত্ব পালন শেষ করেননি, প্রত্যক্ষভাবে এ লড়াইয়ে অংশও নিয়েছেন। কবিতা, গান, চিত্রকলা, সিনেমাসহ বিভিন্নভাবে দেশের অভ্যন্তরে অবরুদ্ধ অথবা ক্যামঙ্ বা অন্যত্র সমবেত মানুষকে তারা উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করেছেন। ওয়াহিদুল হক আর সন্জীদা খাতুনের নেতৃত্বে বাংলাদেশের সংগ্রামী শিল্পীদল শরণার্থী ও মুক্তিযোদ্ধাদের শিবিরে ও বিভিন্ন জমায়েতে গিয়ে গান করেছেন। কামরুল হাসানের নেতৃত্বে শিল্পীরা এঁকেছেন ছবি, তৈরি করেছেন নানা পোস্টার।
গণহত্যার বিরুদ্ধে বিশ্ববিবেক জাগ্রত করতে জহির রায়হান তৈরি করেছেন স্বল্পদৈর্ঘ্যের প্রামাণ্যচিত্র স্টপ জেনোসাইড। অবরুদ্ধ ঢাকা নগরীতে বাস করেও স্বাধীনতার জন্য গান তৈরি করেছেন আলতাফ মাহমুদ, কবিতা লিখেছেন শামসুর রাহমান বা উপন্যাস রচিত হয়েছে শহীদুল্লাহ কায়সারের ক্ষিপ্র হস্তে। বেগম সুফিয়া কামাল অবরুদ্ধ ঢাকার প্রতিদিনের ডায়েরি লিখেছেন। ডায়েরি লিখেছেন জাহানারা ইমাম। এভাবেই আমাদের দেশের সকল সংস্কৃতিসেবী দেশের স্বাধীনতার জন্য, মুক্তির জন্য উজ্জ্বল এক অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করে এসেছেন। আর, এ জন্যই শুধু আলতাফ মাহমুদ, মুনীর চৌধুরী আর শহীদুল্লাহ কায়সার নন, দেশের সেরা বুদ্ধিজীবী-লেখকদের নৃশংসভাবে হত্যা করেছে স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠীগুলো।
দেশের অভ্যন্তরে বা সাহায্যকারী প্রতিবেশী দেশ ভারতে বাংলাদেশের সাহসী সংস্কৃতিসেবীরা যখন তাদের সকল শ্রম দিয়ে অনুপ্রেরণা সৃষ্টির কাজ করে যাচ্ছেন, তখন আমরা দেখি আন্তর্জাতিক পরিসরেও দেশে দেশে বিশ্বনন্দিত শিল্পী, সাহিত্যিক, কবি বা গায়করা একইভাবে আমাদের স্বাধীনতার সমর্থনে মহতী ভূমিকা পালন করেছেন। তারা কবিতা পাঠ করে, কনসার্টে গান গেয়ে, ছবি এঁকে আমাদের মহা বিপর্যয়ের দিনগুলোতে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। সভা-সমাবেশ বা মিছিল করে নিজ নিজ দেশের মানুষের মধ্যে আমাদের জন্য সহানুভূতি সৃষ্টি আর সমর্থন আদায়ের জন্য দৃঢ় হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। এভাবেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে আন্তর্জাতিক সংহতি আন্দোলনে তারা বিশাল অবদান রেখেছেন। তাদের সেসব কবিতা ও গান শুনে, সে সময়ে তাদের আরো নানা ভূমিকার নতুন নতুন তথ্য পেয়ে আমাদের হূদয় আজও উদ্বেল হয়, আমরা অনুুপ্রাণিত বোধ করি। তাদের অনেক কথা হয়তো এখনো আমাদের অজানা। সেসব দিনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতিসেবীদের অবদানের সব কথা কি আমরা আর কখনো জানতে পারব? আমরা জানি কেবল অল্প কজনের কথা। তাদের মধ্যে প্রথম সারির যাদের কথা স্মরণ করতে হয়, তারা হলেন আর্জেন্টিনার খ্যাতনামা লেখক ও রবীন্দ্র-অনুরাগী ভিক্টোরিয়া ওকামেঙ্া, ফ্রান্সের প্রখ্যাত মানবতাবাদী সংগ্রামী লেখক আঁঁদ্রে মালরো, ভারতের পণ্ডিত রবিশঙ্কর, ‘বিটল্স্’-এর গায়ক জর্জ হ্যারিসন ও রিঙ্গো স্টার, মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ, রুশ কবি আন্দ্রেই ভজনেসেনিস্ক, মার্কিন গায়িকা জোয়ান বায়েজ ও বব ডিলান প্রমুখের কথা।
প্রতিবেশী ভারতের প্রায় সব ভাষার সে সময়কার প্রায় সব শিল্পী, সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিসেবীর ঐশ্বর্যমণ্ডিত ভূমিকা কি আমরা কোনোদিন ভোলা সম্ভব? সত্যজিত্ রায়, লতা মুঙ্গেশকর, হীরেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, বিষ্ণু দে, মকবুল ফিদা হুসেন, রাজ কাপুর, মুলকরাজ আনন্দ, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, দেবব্রত বিশ্বাস, ঋত্বিক ঘটক, সুচিত্রা মিত্র, ভূপেন হাজারিকা, সলিল চৌধুরী, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, মৈত্রেয়ী দেবী, দীপেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় এবং আরো অনেকে ‘জয়বাংলা’র সংগ্রামের সঙ্গে সহমর্মিতা জানিয়েছেন, নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন। সাধ্যমতো সবকিছুতেই তারা অংশ নিয়েছেন। এখনো মনে পড়ে, একাত্তরের এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে ঢাকা থেকে বেরাইদ হয়ে নৌকায় যাচ্ছি কমরেডদের নিয়ে, হঠাত্ কলকাতা রেডিওতে বেজে উঠল দেবব্রত বিশ্বাসের কণ্ঠে সেই দারুণ প্রণোদনাময় গান ‘আমার প্রতিবাদের ভাষা, আমার প্রতিরোধের আগুন, জ্বলে দ্বিগুণ দারুণ প্রতিশোধে...।’ সে গানের কথা, সে গানের সুর এখনো বুকে বাজে, শুনলে নতুন করে উদ্দীপ্ত হই।
কলকাতার রবীন্দ্রসদনে সুচিত্রা মিত্র গাইছেন ‘আমার সোনার বাংলা’ আর তাঁর দু চোখ বেয়ে অবিরল ঝরছে অশ্রুধারা-প্রত্যক্ষদর্শী বন্ধু আবুল হাসনাতের কাছ থেকে শোনা এই দারুণ আবেগপূর্ণ দৃশ্যের কথা যখনই মনে হয়, শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে, তাঁকে সহস্রবার শুভেচ্ছা জানাই। সেই একাত্তরে পঞ্চাশোর্ধ্ব কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়-যেন টগবগে তরুণ-বক্তৃতা করছেন, সীমান্তে যাচ্ছেন, মুক্তাঞ্চলে ঢুকে পড়ছেন, লিখছেন এবং আরো কত কী না করছেন। সেসব দিনের অভিজ্ঞতায় পূর্ণ কবি সুভাষের রিপোর্টাজ গ্রন্থ ওদের ক্ষমা নেই এখন কোথাও পাওয়া যায় না। জীবদ্দশায় তাঁর সঙ্গে যতবার দেখা হয়েছে তিনি সেসব দিনের কথা বলতেন। বারবার বলতেন জহির রায়হানের কথা।
বিগত বছরগুলোয় কলকাতায় যেসব কবি বা শিল্পীর সঙ্গে দেখা হয়েছে, তারাও বলেছেন সে সময়ে তাদের কর্মকাণ্ডের কথা। অন্তত দুজন প্রথম সারির শিল্পী কে জি সুব্রাহ্মানিয়াম ও যোগেন চৌধুরী আমাদের একাত্তরের সংগ্রাম নিয়ে যে শিল্পকর্ম করেছিলেন, তা বাংলাদেশের কোনো জাতীয় সংগঠনকে উপহার দিতে চেয়েছিলেন। আর, বেশ কয়েক বছর আগে সাপ্তাহিক সচিত্র সন্ধানীতে বন্ধু আলমগীর সাত্তারের এক লেখায় জেনেছিলাম, মুম্বাই চলচ্চিত্র ও সঙ্গীত জগতের অনেক শিল্পী বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছিলেন বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। মুম্বাই বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির দুই সহসভানেত্রী ছিলেন অভিনেত্রী ওয়াহিদা রেহমান ও শর্মিলা ঠাকুর।
একাত্তরে লাতিন আমেরিকার দেশ আর্জেন্টিনায় বাংলাদেশের সংহতি আন্দোলনের সামনে ছিলেন লেখক, শিল্পী ও ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ। একাত্তরের ১১ জুন তাদের একটি প্রতিনিধিদল আর্জেন্টিনার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে দেওয়া এক স্মারকলিপিতে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামীদের জন্য সাহায্য পাঠানোর দাবি জানিয়েছিলেন। এই দাবিনামায় যারা স্বাক্ষর করেছিলেন, তাদের মধ্যে প্রথমেই ছিলেন আশি-ঊর্ধ্ব ভিক্টোরিয়া ওকামেঙ্ার নাম। তাঁর সঙ্গে ছিলেন খ্যাতনামা সাহিত্যিক হোর্হে লুইস বোর্হেসসহ আর্জেন্টিনার সেরা লেখক ও শিল্পীদের অনেকে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বিজয়া’-ভিক্টোরিয়ার নামের এই বাংলা প্রতিশব্দ করেছিলেন কবি নিজে-ভিক্টোরিয়া ওকামেঙ্া বাংলাদেশের সমর্থনে রাজধানী বুয়েনোস এইরেসের একটি মিছিলের পুরোভাগে ছিলেন। শুধু এটুকুই নয়, ১৯৮৭ সালে ভারতীয় কূটনীতিক শিবনাথ রায়ের কাছ থেকে শুনেছিলাম, তিনি একাত্তর সনে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে কাজ করতেন, ভিক্টোরিয়ায় ওকামেঙ্া একবার বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের প্রতি আমার সমর্থন অত্যন্ত স্বাভাবিক। কারণ, বাংলাদেশের মানুষের ভাষা বাংলা। বাংলা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরও ভাষা। আর তিনি (রবীন্দ্রনাথ) বহু সময় কাটিয়েছেন বাংলার ওই অংশে। সে জন্য এই অঞ্চলের মানুষের সংগ্রামের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ আমার কর্তব্য বলে মনে করেছি।’ ভিক্টোরিয়া ওকামেঙ্ার এই ভূমিকা আমাদের অনুপ্রাণিত করবে আগামী দিনগুলোতেও। শিবনাথ রায়ের দেওয়া এ তথ্য সেদিন আমাকে গভীরভাবে আলোড়িত করেছিল।
শুধু ভিক্টোরিয়া ওকামেঙ্া নয়, বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম ব্যক্তিত্ব ফ্রান্সের আঁঁদ্রে মালরো বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সময় গর্জে উঠেছিলেন প্রবল বিক্রমে, বাংলাদেশের জন্য সশস্ত্র যুদ্ধে যোগদানের প্রতীকী অঙ্গীকার ঘোষণা করেছিলেন। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে এ দেশ ঘুরে গিয়েছিলেন মঁশিয়ে মালরো। সেই ঘোর অমানিশার দিনে তাঁর দুঃসাহসী কণ্ঠস্বর বিপুল প্রেরণা জুগিয়েছিল।
একাত্তরের ২০ নভেম্বর সন্ধ্যা ৭টায় নিউইয়র্কে সেন্ট জর্জ চার্চে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে সে সময়ে বিভক্ত বিশ্বের দুই প্রধান কবি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যালেন গিন্সবার্গ ও রাশিয়ার আন্দ্রেই ভজনেসেনিস্ক প্রথমবারের মতো একই মঞ্চ থেকে কবিতা পাঠ করেছিলেন। এ রকম একটি দৃশ্য ভাবতে এখনো শিহরণ জাগে আমাদের হূদয়ে। তাঁদের সঙ্গে আরো ছিলেন গ্রেগরি করসো, পিটার অরলভিস্ক, কেনেথ কচ, এড স্যান্ডার্স প্রমুখ কবি। এই কবিতা পাঠের অনুষ্ঠানটির আয়োজন করেছিল ‘আমেরিকানস ফর বাংলাদেশ’। সে সময়ে তারা বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সৃষ্টি ও অর্থ সংগ্রহের কাজ করেছে।
বিট বংশের উদ্যোক্তা কবি অ্যালেন গিন্সবার্গকে বাংলাদেশের একাত্তরের ট্র্যাজেডি গভীরভাবে আলোড়িত করেছিল। বাংলাদেশের লাখো-কোটি মানুষের দুর্দশা স্বচক্ষে দেখতে তিনি ভারতে এসেছিলেন একাত্তরের সেপ্টেম্বরে, বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরের নিদারুণ অভিজ্ঞতা তিনি বাণীবদ্ধ করেছিলেন ‘যশোর রোডে সেপ্টেম্বর’ নামের দীর্ঘ কবিতায়। এর একটি অংশ এ রকম : ‘লক্ষ শিশু দেখছে আকাশ অন্ধকার/উদর স্ফীত, বিস্ফোরিত চোখের ধার/ যশোর রোডে বিষণ্ন সব বাঁশের ঘর/ধুকছে শুধু, কঠিন মাটি নিরুত্তর।’
কলকাতার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি লেখা থেকে আমরা জেনেছি, অ্যালেন গিন্সবার্গ তাঁর এই কবিতাটিতে সুর দিয়ে গান করেছিলেন। নিজেই হারমোনিয়াম বাজিয়ে গেয়েছেন বহুবার। এই কবিতা, এই গান গিন্সবার্গের খুব প্রিয় ছিল। এখন আমরা যখন মৌসুমি ভৌমিকের কণ্ঠে অ্যালেন গিন্সবার্গের ‘যশোর রোডে সেপ্টেম্বর’ গানটি শুনি তখন সেদিনগুলোর দুঃখ-বেদনা-লড়াইয়ের কথাগুলো বড় বেশি মনে পড়ে।
একাত্তরে বাংলাদেশ নিয়ে গায়ক-শিল্পীদের সবচেয়ে বিশাল সংগঠিত আয়োজন ছিল নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে ১ আগস্টে অনুষ্ঠিত অবিস্মরণীয় সঙ্গীতসন্ধ্যাটি। এ অনুষ্ঠানের মূল উদ্যোক্তা ছিলেন বিশ্ববিখ্যাত সেতারবাদক পণ্ডিত রবিশঙ্কর। বাংলাদেশের জনগণের সাহায্যে কিছু করার জন্য তিনি প্রথম যোগাযোগ করেন জনপ্রিয় ‘বিটল্স্’-এর অন্যতম সদস্য জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে। হ্যারিসন এগিয়ে আসেন এবং উদ্যোগী হয়ে অন্যান্য শিল্পীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ৪০ হাজার শ্রোতা-দর্শক এ অনুষ্ঠানে সমবেত হয়েছিলেন। ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ নামের এ অনুষ্ঠান থেকে উদ্যোক্তারা ২,৪৩,৪১৮.৫০ ডলার সংগ্রহ করে ইউনিসেফের বাংলাদেশের শিশুসাহায্য তহবিলে প্রদান করেছিলেন। ৪০টি মাইক্রোফোনে অনুষ্ঠানের গান ও কথা রেকর্ড করে তিনটি লং প্লেইয়িং নিয়ে একটি বড় অ্যালবাম প্রকাশ করা হয়েছিল। সঙ্গে ছিল বহু রঙে মুদ্রিত সে অনুষ্ঠানের একটি সুদৃশ্য সচিত্র পুস্তিকা।
‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ শুরু হয়েছিল পণ্ডিত রবিশঙ্করের একটি সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা দিয়ে। এ কনসার্টের জন্য রবিশঙ্কর তৈরি করেছিলেন ‘বাংলাদেশ ধুন’ বলে নতুন একটি সুর। আর তাঁর সঙ্গে সরোদে যুগলবন্দি করেছিলেন ওস্তাদ আলী আকবর খান। তবলায় সহযোগিতা করেছিলেন বিখ্যাত আল্লারাখা। তানপুরায় ছিলেন কমলা চক্রবর্তী। সেদিন ম্যাডিসন স্কোয়ারের অনুষ্ঠানের অন্যতম আকর্ষণ ছিল প্রতিবাদী গানের রাজা বব ডিলান। তিনি গেয়েছিলেন ছয়টি গান-মি. তাম্বুরিনম্যান থেকে শুরু করে তাঁর লেখা ও সুরারোপিত ৫০ লাইনের বিখ্যাত গান ‘এ হার্ড রেইন ইজ গোননা ফল’। সেদিন বব ডিলানের সঙ্গে গিটার বাজিয়েছিলেন জর্জ হ্যারিসন, ব্যাস লিওন রাসেল এবং টাম্বুরিন রিঙ্গো স্টার। সে অনুষ্ঠানে ‘বিটল্স্’-এর অন্যতম সদস্য রিঙ্গো স্টার, লিওন রাসেল, এরিক ক্ল্যাপটন, বিলি প্রেস্টন ও ডন প্রেস্টন প্রমুখ গান গেয়েছেন, গিটার বাজিয়েছেন।
এ অনুষ্ঠানের জন্য জর্জ হ্যারিসন লিখেছিলেন নতুন গান : ‘এল একদিন বন্ধু আমার/চোখভরা তার ধু ধু হাহাকার/বলে গেল, চাই শুধু সহায়তা/দেশ তার আজ ধুঁকে ধুঁকে মরে/বেশি কিছু আমি জানতে চাই না’। এটি ছিল অনুষ্ঠানের শেষ গান। আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের সম্মিলিত চড়া সুরের মধ্যে আর্তনাদের মতো করুণ অথচ দৃঢ় কণ্ঠে জর্জ হ্যারিসনের এই গান আর তাঁর মহত্ উদ্যোগ আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে সংহতি প্রকাশের বহু স্মরণীয় কার্যক্রমের মধ্যে এক সমুজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হওয়ার দাবি রাখে। পুরো অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা ছাড়াও জর্জ হ্যারিসন একক সঙ্গীত করেছিলেন ছয়টি।
নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে সেদিনের সঙ্গীতসন্ধ্যায় যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের নেত্রী হিসেবে পরিচিত কণ্ঠশিল্পী জোয়ান বায়েজ অংশ নিতে পারেননি। সে দিন তাঁর অন্য একটি পূর্বনির্ধারিত অনুষ্ঠান ছিল। ভিয়েতনামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধের বিরুদ্ধে সাহসী ও প্রতিবাদী ভূমিকার জন্য জোয়ান বায়েজ ষাট ও সত্তরের দশকে বিশ্বব্যাপী সবিশেষ পরিচিতি লাভ করেন। মানবতাবাদী এই শিল্পী বব ডিলান ও জর্জ হ্যারিসনদের সঙ্গে সেই সন্ধ্যার অনুষ্ঠানে অংশ না নিলেও বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নিদারুণ হত্যাযজ্ঞ তার হূদয়কে গভীরভাবে সর্ঙ্শ করেছিল। জোয়ান লিখেছিলেন এক হূদয়-নিংড়ানো সঙ্গীতালেখ্য। গানের শুরুর কয়েকটি লাইন এ রকম : ‘বাংলাদেশ...পশ্চিম দিগন্তে সূর্য অস্ত যায়/লক্ষ মানুষ নিহত হয় বাংলাদেশে/আমরা পাশে দাঁড়িয়ে দেখি/ক্রুশবিদ্ধ পরিবার, কিশোরী মাতার অসহায় শূন্য দৃষ্টি/তার শিশু লড়াই করছে ঝড়-বৃষ্টি আর কলেরার সঙ্গে।’
‘বাংলাদেশ’ গানটির সুরকার ছিলেন জোয়ান বায়েজ নিজেই। গানটি গেয়েছেনও তিনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার এক বছর পর জোয়ান বায়েজের ‘বাংলাদেশ’ গানটি প্রথম শোনার সেই অভিভূত মুহূর্তগুলোর কথা এখনো স্মৃতিতে সঙ্ষ্ট হয়ে আছে। সেই প্রথম শোনার পর এ পর্যন্ত দু-তিন দশক ধরে বহুবার শুনলেও এই অবিস্মরণীয়ই গানটি আজও পুরনো হয়নি। এখনো এ গান একাত্তরের সে দিনগুলোতে টেনে নিয়ে যায়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ওপর শোনা গানগুলোর মধ্যে জোয়ান বায়েজের গানটিকে অন্যতম শ্রেষ্ঠ বলে মনে করার কারণ রয়েছে।
এভাবে বাংলাদেশের নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অবস্থান নিয়েছিলেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের খ্যাতনামা কবি, শিল্পী, গায়ক, বিজ্ঞানী নানা অন্যান্য সৃজনশীল মানুষেরা। বাংলাদেশের মানুষের বীরত্ব ও আত্মত্যাগ অনুপ্রাণিত করেছিল তাদের। আমাদের জীবনের সবচেয়ে দুর্যোগপূর্ণ দিনগুলোতে যারা ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, শক্ত করে ধরেছিলেন আমাদের হাত, তাদের সবার কথা কি আমরা জানি? আমাদের লড়াইয়ের প্রতি তাদের অকুণ্ঠ সমর্থন, আমাদের জন্য তাদের ভালোবাসাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য কি আমাদের কিছু করণীয় ছিল না?
কতদিন এ রকম ভেবেছি, বন্ধুরা আলোচনা করেছি, এসব মহত্ ও বিশ্বসেরা লেখক-শিল্পীদের যদি বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানানো হতো, যদি তাদের নিয়ে ঢাকা স্টেডিয়ামে একটি অনুষ্ঠান করা যেত! সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লাখো মানুষের সামনে যদি তাদের সংবর্ধনা দেওয়া যেত? বহুদিন এরকম একটি দৃশ্যের কথা ভেবেছি, স্বাধীনতার পর ঢাকা স্টেডিয়াম বা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত বিশাল মঞ্চে পণ্ডিত রবিশঙ্কর, লতা মুঙ্গেশকর, বব ডিলান, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, জর্জ হ্যারিসন, সুচিত্রা মিত্র ও ভূপেন হাজারিকা উপস্থিত হয়ে কথা আর সুরের ঐশ্বর্যমণ্ডিত ভুবন রচনা করে তুলছেন। স্বপ্নের মতো হলেও এমন দৃশ্য কল্পনা করে বহুবার আবেগ-বিহ্বল হয়ে পড়েছি।
বাংলাদেশের সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সংহতির পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী স্বজনদের ভূমিকা বিশেষ তাত্পর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। তাদের সহানুভূতি, তাদের ভালোবাসা বাংলাদেশের লেখক, শিল্পী, কবি, গায়কদের স্বতঃস্ফূর্ত লড়াইকে অনুপ্রাণিত করেছে, সাহস যুগিয়েছে। কোনোদিন তাদের কথা আমরা ভুলতে পারব না। তাদের প্রতি আমরা চিরকৃতজ্ঞ।
সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০০৩ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত