মহেন্দ্র সর্দার নেই। মারা গেছেন। তার সাঁওতাল কম্যুনিটির কোনো পরিবারই নেই এখন পঞ্চগড়ের সীমান্ত লাগোয়া নালাগঞ্জ গ্রামটিতে। কিন্তু এক সময় ছিল, সেই ’৭১-এ স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়। জয়বাংলা মানেই তখন ছিল বাংলার জয়, বাংলার স্বাধীনতা। সেই স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন সাহসী শরিকদার হিসেবে মহেন্দ্র সর্দার তার গোত্রের লোকজনদের নিয়ে ছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে। গত বছর ১৬ ডিসেম্বরে বিজয় দিবসে মহেন্দ্র সর্দারের পরিত্যক্ত ভিটিতে মিলিত হয়েছিলেন ’৭১-এর জীবিত মুক্তিযোদ্ধারা যারা চাউলহাটী ইউনিট বেসের থ্রি-আলফা কোম্পানি হিসেবে পরিচিত ছিল। সবাই নয়, তাদের কেউ কেউ এসেছিলেন। এসেছিলেন আশ্রয়দাতা, গাইড, সহযোগী মুক্তিযোদ্ধারা। সবার বয়স হয়েছে, জড়াগ্রস্ত অনেকে। মহেন্দ্র সর্দার নেই। কিন্তু মহেন্দ্র সর্দারের স্মৃতি ছিল জীবন্ত সবার মধ্যে।
তার গোত্রের অন্যরা এখন ভারতীয় সীমান্তের ওপারে। খবর দেওয়া হয়েছিল। তারকাঁটার বেড়া এখন দুই দেশের মাঝখানে। ইচ্ছে করেই সেই ’৭১-এর মতো চলে যাওয়া যায় না বেরুবাড়ী, ভাটপারা, গড়ালবাড়ী, সাকাতি বা জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি। মৈলী মহেন্দ্র সর্দারের মেয়ে! এখনো বেঁচে আছেন। স্বামী, ছেলেপুলে নিয়ে সংসার করছেন। একাত্তরের ঘটনাবলি এবং মুক্তিযোদ্ধাদের তিনি দারুণভাবে স্মরণ রেখেছেন। কিন্তু সেই সঙ্গে রয়ে গেছে গভীর দুঃখবোধ। জয়বাংলা হলো। কিন্তু দেশটা তাদের রইল না।
সেই সময়
একাত্তরের আগস্টের প্রথম দিকে দুলু সেই যে এল, থেকেই গেল স্থায়ীভাবে। তার যাওয়ার উপায় নেই। যদিও পিছুটান প্রচুর। যুদ্ধের উদ্দাম জীবনটাকে সে পছন্দ করে ফেলেছে। এখানে রোদন-ভরা বসন্ত আছে। খোল খোল দ্বার আছে। আগুন জ্বালো আগুন জ্বালো আছে। আছে তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা। শেকল ভাঙার গান আছে। ও আমার দেশের মাটি আছে। আছে আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি। আর আছে পিন্টু। যখন-তখন তার স্টেনগানটা গিটার হয়ে যায়। আর খোলা প্রান্তরে উদ্দাম গলায় সে গান ধরে। আনন্দ-বেদনার, ভালোলাগা ভালোবাসার, দুঃখ জাগানিয়ার।
তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দুলু। অফুরন্ত প্রাণশক্তি। রসিক। রোমান্টিক। জয়বাংলার জন্য নিবেদিত সাহসী যুবক। এ দুজনে জমিয়ে রাখে অবকাশ-অবসরের নিজস্ব সময়গুলো। যুদ্ধের মাঠে এমনিতেই সময় পাওয়া যায় না। যে সময়টা তবুও বের হয় তা নিংড়ে নিয়ে উপভোগ করে ছেলেরা। পিন্টু দুলুর সঙ্গে যোগ দেয়, মধুসূদন, মতিয়ার, খলিল, মোসারদ পাগলা। একদল তাজা প্রাণের তরুণ যুবক।
—হাতিয়ার চালানো জানেন? রাইফেল?
—জি, ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের সময় কলেজে কয়দিন ট্রেনিং নিয়েছিলাম।
—ওতেই চলবে।
৩.
দুলুর ইন্টারভিউ হয়ে যায়। ওকে রাইফেল দেওয়ার নির্দেশ দিই। যুদ্ধক্ষেত্রে গুলি ছুড়তে ছুড়তেই রাইফেল চালানো শিখে যাবে। ইচ্ছেশক্তিটাই এখানে বড়। আর প্রয়োজন সাহসের। মনে হয় ওর দুটোই আছে।
গৌরবর্ণ হালকা-পাতলা শরীর, লম্বাটে গড়নের হাস্যোজ্জ্বল যুবক। দুই গালের চোয়াল কিছুটা ভাঙা। তাকে বলি, রিচার্ড হ্যারিসন নাকি?
—কী যে বলেন!
—অভিনয় করেছেন কখনো?
—জীবনে একবার।
—গান?
—কিছু কিছু। তবে যুদ্ধের এই ডামাডোলের মধ্যে সব পালান দিছে।
—পালান দেওয়ার পরও কিছুটা তো আছে? হোক দেখি!
পিন্টুকে ইশারা দিই। এগিয়ে আসর জমিয়ে বসে সে। দুলু গান ধরে, ‘তুই ফেলে এসেছিস কারে মন...।’
বাইরে বৃষ্টি, ঝিরঝিরিয়ে বর্ষার বৃষ্টি—এই আসে, এই চলে যায়। কিছুক্ষণ আগেই টিনের চালে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি ঝরছিল। আকাশ ভেঙে যেন বালতিতে পানি ঢেলে দিচ্ছিল কেউ। এখন তা নেই। ধরে এসেছে। এর মধ্যে মেঝের বিছানায় বসে দুলুর সুরেলা কণ্ঠে গান।
দুলু থামে, পিন্টু ধরে ‘আগুন জ্বালো, আগুন জ্বালো।’ ওটা শেষ হলে দুজনে একসঙ্গে ধরে, ‘ও আমার দেশের মাটি...।’ মতিয়ার উসখুস করতে করতে ভেতরগড় অপারেশনে দখলকৃত ভাঙা হারমোনিয়ামটা নিয়ে এসে যোগ দেয়। মিনহাজ পরিবেশন করে গরম চা আর পেঁয়াজু। জমে ওঠে মধুপাড়া হাইড-আউটের পরিবেশ। বাঁধনছাড়া উদ্দাম জীবন। তারুণ্য। এখন যুদ্ধ নেই। অবসরের নিজস্ব সময় এটা। ইচ্ছে-খুশিমতো ছেলেরা এই সময়টা উপভোগ করে। শুধু একটাই বিধিনিষেধ। হাইড-আউটের বাইরে যাবে না কেউ।
৪.
—কী দুলু ভাই, আপনার নাকি জ্বর?
—নাহ্। খানের দল আসার খবর পায়ে হেনে এখন জ্বরটর পালান দিছে। ‘পালান দিছে’ কথাটা দুলুর মুদ্রাদোষের মতো। প্রতিটা প্রসঙ্গে এবং আলোচনার শেষে তার ‘পালান দিছে’ থাকবেই। যেমন খানের দল আজ টিকতে না পেরে পালান দিছে। শান্তি কমিটির আনাজ চেয়ারম্যান জানের ভয়ে পালান দিছে। ভেতরগড়ের মীর খান আর আসিবে নাই, সারা জীবনের জন্য পালান দিছে। প্রথম দু দিন ব্যাপারটা বোঝা যায়নি। তৃতীয় দিনে পিন্টু ব্যাপারটা ধরে ফেলে। আর হঠাত্ করেই তাকে বলে বসে, আপনিও কি পালান দেবেন?
—কী কহিলেন?
—এই যে পালান দেওয়ার ব্যাপারটা আর কি?
—মানে?
দুলু আমার মুখের দিকে চায়। পিন্টুকে দেখিয়ে দিই ইশারায়।
পিন্টু বলে, আপনার কথামতো সবাই তো পালান দিছে, আপনি কবে দেবেন সেটা আগে-ভাগে জানলে ভালো হতো না?
এবার বুঝে ফেলে দুলু। রসিকতা। কিন্তু মুখ গম্ভীর করে বলে, আমি যাচ্ছি না!
—থেকেই যাবেন?
—হ্যাঁ।
—কিন্তু পিছুটান? মা-ভাই-বোনেরা? ওপারে শরণার্থী তারা। গার্জেন বলতে শুধু আপনি। ওদের কী হবে?
—ওরাও থাকবে। লক্ষ কোটি শরণার্থী। তাদের মধ্যে ওরাও থাকবে। কিন্তু এই যুদ্ধ, দেশের জন্য এই কাজ করার সুযোগ আর তো পাব না।
—খারাপ কিছু হতে পারে। দুদিন আগে আক্কাস মারা গেল। গোলাম গউস মারা গেছে। আমি পরিস্থিতির গভীরতা বোঝাতে চাই।
দুলু বলে—তা হোক। কপালে থাকলে হবে। যুদ্ধের মধ্যে থাকব। আর মৃত্যুর আশঙ্কা থাকবে না এটা কি হয়?
বলি, জানেন তো চান্স ফিফটি ফিফটি। বাঁচা-মরার সম্ভাবনা সমান সমান। আপনার দিকে তাকিয়ে আছে ওপারে শরণার্থী মা-ভাইবোন-আত্মীয়রা। কীভাবে তারা বাধা দিচ্ছিল, কাঁদছিল, যখন আসেন!
—রাখেন তো মেয়ে মানুষের প্যানপ্যানানি। ওরা অমন করবেই।
—তাহলে পালান দেবেন না?
—দুর!
—তবে তাই হোক। এখন গান ধরেন।
ছোট একটা খাল। হাঁটু সমান স্রোতস্বিনী জলরাশি। দুই ধার উঁচু। অসমতল। কাশবন, নলখাগড়া, জঙ্গুলে গাছ, বুনো ঘাসের ঝোপঝাড়। বিকেল ঘনিয়ে এসেছে। খালটা মাঝখানে রেখে দুই পাশের অবস্থান থেকে সারা দিন চলেছে যুদ্ধ। শত্রুরা একেবারে স্থির প্রতিজ্ঞ ছিল এপার আসবেই। দখলে নেবে আমাকে মধুপাড়ার হাইড-আউট। অন্তত তাদের মতিগতি তা-ই বলছিল। কিন্তু তা হয়নি বাস্তবে। দুলু গাইড করে এনেছে আমাদের এই কৌশলগত অবস্থানে। এখান দিয়েই তারা এগুতে চাইছিল। দুলুর সাহায্যে ঠিক সময়ে এই অবস্থানে না আসতে পারলে আজ হয়তো আর একটা ম্যাসাকার হতো। হয়নি। সারা দিন সমানতালে গুলি বিনিময়ের পর তারা হাল ছেড়ে পিছিয়ে গেছে। আমাদের তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। ওদের হয়েছে কি না জানা যায়নি। শত্রু রণেভঙ্গ দিয়ে চলে যাওয়া মানে যুদ্ধ শেষ। অল ক্লিয়ার সিগনাল পেয়ে সবাই উঠে আসে। কাদা-বালিতে মাখামাখি। শরীর জুড়ে শ্রান্তি-ক্লান্তি। কাঁধে অস্ত্র ঝুলিয়ে তারা আসে। পরিত্যক্ত ছনের বাড়িটার সামনে ঘাসের উঠানে তারা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে। তৃষ্ণার্ত এবং ক্ষুধার্ত তারা। জঙ্গলযুদ্ধে গেরিলা যোদ্ধাদের সহজে পানি বা খাবার পাওয়ার উপায় নেই।
দুপুরের না-খাওয়ার খিদে এই শেষ বিকেলে এসে মজে গেছে। তবে তৃষ্ণার্ত সবাই। দুটো ৭.৬২ এমএম গুলির বাক্স খালি করা হয়। স্রোতস্বিনী পাহাড়ি খালের পানি মোটামুটি পরিষ্কার। তাই তুলে আনে ছেলেরা। বাক্সে মুখ লাগিয়ে খায়। হাইড-আউটের দূরত্ব প্রায় ৪ মাইল। পেটে দানাপানি কিছু না দিয়ে এতদূর হেঁটে যাওয়া! যেতে তো হবেই। দুলুকে বলি, পারবেন কিছু খাবার যোগাড় করতে?
—পারিল যাবে। তাত্ক্ষণিক উত্তর ওর দেহাতি ভাষায়।
—মানে?
—পারা যাবে।
—কিন্তু আশপাশে তো কিছুই দেখছি না। সব পরিত্যক্ত বাড়িঘর। মানুষজন সব চলে গেছে ওপারে।
—আমার নাম দুলু। মাহবুবার রহমান প্রধান। চেয়ারম্যান মশিয়ার রহমান প্রধানের ছেলে আমি। এটা আমাদের জোতদারি এস্টেট। দেখেন না পারি কি না। শুধু হুকুম করে দেখেন।
—হুকুম তো করা হলো। সেটা তামিল করতে গিয়ে পালান দেবেন না তো?
—একটুখানি অপেক্ষা করেন।
৫.
—মোর নাম মহেন্দ্র সর্দার। দুলু ভাইয়া এইগুলান দিয়া পাঠাইছে।
মহেন্দ্র সর্দারের সঙ্গে সেই প্রথম দেখা।
সের তিনেক চাল ভাজা। লবণ আর কাঁচা লঙ্কা। মোতালেব আর একরামুল মিলে সেই শুকনো খাবার পরিমাণমতো মুঠি করে বিলি করে। ক্ষুধার পেট। আউশ চাল ভাজার মোটা দানা। লবণ-কাঁচা লঙ্কা, অমৃতসম মনে হয়।
—আপনি কিসের সর্দার?
—আমাদের জাতির। সাঁওতাল আমরা। ভাইয়াদের প্রজা। তাদের জমি-জিরাত চাষ করি।
—তাহলে এই এলাকার সাঁওতাল সর্দার আপনি? বেশ তো! দেশ ছেড়ে ওপারে যাননি?
—গেইছে কেউ কেউ। আমরা যাই নাই। গেইলে কিছুই থাকিবে না।
কালো কুচকুচে শরীর, শক্ত বাঁধন, লোহা পেটানো যেন। মহেন্দ্র সর্দারের চেহারা সর্দারের মতোই। প্রথম দেখাতেই মনে হয়, না ঠিকই আছে নাম, পদবি।
—ভাইয়া সন্ধ্যার পর আপনাদের নিয়া যাইতে কহিছেন।
—কোথায়?
—হামার গাঁয়োত, নালাগঞ্জে। সেখানে তো খাসি মারা হয়েছে। সবার জন্য রান্না হচ্ছে।
—বাহ! বিউটিফুল! কতদূর এখান থেকে?
—আধ মাইল হইবে।
—ঠিক আছে। আমরা যাব।
৬.
—চলেন আজ রাতে হাঁড়িভাসা। ওদের তাড়িয়ে দিয়ে আসি।
ভূরিভোজ হয়েছে। এখন মেঘমুক্ত আকাশের নিচে খড়ের গাদার ওপর সবাই শুয়ে-বসে আছি। রাতের অন্ধকারের কালোছায়া চারদিকে। আকাশজুড়ে তারকারাজি। তারই সঙ্গে মিল রেখে যেন চারপাশে খেলে বেড়ায় জোনাকির দল। আকাশের দিকে মুখ রেখে সপ্তর্ষিমণ্ডলের দিকে চেয়ে থাকি। শুক্র গ্রহ খুঁজি। দুলু তখন প্রস্তাবটা দেয়।
দূরবর্তী জগদলহাট কিংবা মীরগড় ফ্রন্ট থেকে একটানা মেশিনগানের শব্দরাজি ভেসে আসে। কামান যুদ্ধ আপাতত বন্ধ। কখন আবার শুরু হয়ে যায় ঠিক নেই। এদিকে হাঁড়িভাসা থেকে প্রতিদিনই পাকসেনারা হামলা করতে আসছে। মুক্তিযোদ্ধারা এদিকে তত্পর। সেটা তারা ধরতে পেরেছে। চাচ্ছে কম্বিং অপারেশন করে সমূলে উত্পাটন। আজ ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস। বাংলাদেশের নয়। ওটাকে আমরা পরিত্যাগ করেছি। দেশ স্বাধীন হলে আমরা বাংলাদেশের নিজস্ব স্বাধীনতা দিবস পালন করব। স্বাধীনতা দিবসকে সামনে রেখেই ওরা বুঝি পরপর তিন দিন এল। এভাবে দিনের পর দিন তাদের ক্রমাগত আক্রমণ আমাদের সমূহ ক্ষতি করে ছাড়বে। একটা কিছু বিহিত করা দরকার। দুলুর প্রস্তাবটা এ অবস্থায় মনঃপূত হয়। পিন্টু, মুসা, শামসুল চৌধুরী, একরামুল এদের সবাইকে ডাকি। দুলুও থাকে। রাতের অন্ধকারে পাকবাহিনীর ঘাঁটিতে আঘাত করে হাঁড়িভাসা থেকে স্থায়ীভাবে তাদের বিতাড়নের ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা হয়। মুসা বলে, ডেইলি ডেইলি মার খাওয়ার চেয়ে চলেন ওদেরই আমরা মেরে আসি।
—মারা কি যাবে? ওরা দারুণ শিক্তিশালী। একরামুল বলে।
—দুলু ভাই ঠিকভাবে নিয়ে যেতে পারলে আমরা সফল হতেও পারি। পিন্টুর জবাব।
—আমাদের তরফে ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। তবু রিস্ক নিতেই হবে। প্রতিদিন এভাবে মার খাওয়া যায় না। আমি সিদ্ধান্ত দিয়ে দিই।
—ওকে বস্, তাহলে দল রেডি করি। দুলু মিয়া আপনিও রাইফেল নিয়া ফল-ইন হন। পিন্টু এই বলে দুলুকে নিয়ে উঠে যায়।
৭.
তিনটি দল। কাট-আপ পার্টি, কভার এবং অ্যাসল্ট পার্টি। পিন্টুর সঙ্গে কভার পার্টিতে থাকে একরামুল। মুসার সঙ্গে কাট-আপ পার্টিতে থাকে শামসুল চৌধুরী। অ্যাসল্ট পার্টিতে আমার সঙ্গে থাকে মোতালেব, থাকে দুলু। গাইড আর এবং ফাইটার দুটি দায়িত্বই সে পালন করবে। সর্বমোট বত্রিশ জনকে নিয়ে দল তিনটি সাজানো হয়। এলএমজিটা থাকে মোতালেবের কাছে। পিন্টুর কাছে দুই ইঞ্চি মর্টার। এটিএম বা অ্যান্টি ট্যাঙ্ক মাইন, এপি-১৪ বা অ্যান্টি পারসোনাল মাইন থাকে যথেষ্ট পরিমাণে মুসার সঙ্গে।
যুদ্ধক্লান্ত সবাই। দিনভর নাওয়া-খাওয়া হয়নি। রাতে দুলু মিয়ার চেষ্টায় মহেন্দ্র সর্দারের বাড়িতে হয়ে গেল ভূরিভোজ। ছেলেরা ক্ষুধা মিটিয়ে স্ব-স্ব হাতিয়ার নিয়ে খড়ের গাদায় শুয়ে-বসে থাকে। অবসাদে-ক্লান্তিতে অবসন্ন শরীর। আজ রাতেই যে পুনরায় যুদ্ধযাত্রা হবে তা কেউ আঁচ করতে পারে না। বিড়ি-সিগারেট খায়। মৃদু স্বরের কথাবার্তা, হালকা হাসি-মশকরার শব্দ। বাইরে সেন্ট্রি দাঁড়িয়ে থাকে বাড়ির রাস্তার প্রবেশমুখে। জোনাকিরা আলো জ্বেলে আলো নিভিয়ে ঘুরে বেড়ায় অন্ধকারে তাদের পথকে আলোকিত করে। আপাত শান্তিময় নিরুপদ্রব রাত। শুধু দূরের শব্দধ্বনি জানান দিয়ে যায়, আমরা যুদ্ধের মধ্যে রয়েছি। এখন যুদ্ধের সময়। নিজ দেশ বাসভূমি গাঁওগ্রাম থেকে বিতাড়িত। অচেনা-অজানা সীমান্ত এলাকায় ঝোপঝাড়-জঙ্গল দিয়ে ঘেরা একটা সাঁওতাল বসতি। মহেন্দ্র সর্দারের বাড়ির দরজায় আমরা বসে আছি। অদ্ভুত লাগে ব্যাপারটা ভাবতে! দুলু আর তার প্রজা মহেন্দ্র সর্দার এখন আমাদের আপনজন, পরম আত্মীয়তুল্য। অথচ সেই সব আপনজন, আত্মীয়জনেরা কোথায় এখন? আমরাও জানাতে পারছি না তাদের এখনকার অবস্থা, হাল-চাল, কেমন আছে সবাই, কে জানে?
৮.
মহেন্দ্র সর্দার মাঝে-মাঝে মৈলী-মাঈ মৈলী-মাঈ বলে ডাকে। তার ডাকে সাড়া দিয়ে সদ্য কৈশোর পার হয়ে আসা একটি তরুণী সামনে এসে দাঁড়ায়। সর্দার তাকে এটা-ওটা নির্দেশ দেয়। লঘু পায়ে চঞ্চল ভঙ্গিতে মেয়েটি তা পালনের জন্য নিমিষেই হারিয়ে যায়। কালোবরণ কন্যারে তোর কুঁচবরণ কেশ—মৈলী মেয়েটিকে দেখার পরই প্রথমে এই লাইনটি মনের মধ্যে গুঞ্জন দিয়ে ওঠে। বসতবাটির পরিবারগুলো রয়ে গেছে মহেন্দ্র সর্দারকে কেন্দ্র করে। তকতকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন বাড়িঘর। মেঝে-উঠোন চমত্কারভাবে লেপানো, ময়লা-অপরিষ্কার কিছুই নেই। মাটির ঘরগুলো দেখতে একই রকম। উপরে ছন, কিন্তু দেয়ালগুলোতে হাতে আঁকা নানা ধরনের ছবি। শিল্পী তার মন থেকে মানুষ, পশু, দেবতা এগুলোর অবয়ব আনার চেষ্টা করেছে কাঁচা হাতের তুলিতে। এটাই তাদের ঐতিহ্য, কালচার। এখনো আদিম স্বভাবের মানুষগুলো কী সুন্দর তাদের ঐতিহ্যকে ধরে রাখার চেষ্টা করছে!
অন্ধকারে কুপি হাতে বউঝিরা চলাফেরা করে। দু-তিনটা হারিকেন অন্ধকার তাড়ানোর চেষ্টা করে চলে। এরা থাকবে কীভাবে এখানে, খানেদের থাবার নাগালের আওতায়? এতদিন ধরে আমরা না হয় ঠেকিয়ে রেখেছি। এরপর শত্রুদের ব্যাপক প্রস্তুতির মুখে তাদের ঠেকানো না-ও যেতে পারে। তখন কী হবে এদের? কোথায় যাবে?
মৈলী এসে সর্দারের সামনে দাঁড়ায়। হাতে পান আর বিড়ির প্যাকেট। বলে, বাবা এই নে পান আর বিড়ি। বিড়ি কিন্তু শ্যাষগে। চাহিলে আর পাবোনি!
সর্দার মাথা নাড়ে। হাত বাড়িয়ে নেয়। বিড়ি এগিয়ে দেয় আমার পিন্টুর দুলুর উদ্দেশে। মেয়েটির চোখে-মুখে উত্সুক ভাব। ছটফটে। চলে যায় না। বাবার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকে। সঙ্গে ওর চেয়ে কম বয়সী আরো দু-তিনটি মেয়ে, বাচ্চা কয়জন। কাছে ডাকি। আসে। তাকে বলি, ঘরের দেয়ালের ওই ছবিগুলো কে এঁকেছে?
হাসে মৈলী। অন্ধকারে চকচক করে ওঠে সাদা দাঁতের সারি। এদের সবার দাঁত খুব সাদা আর সুগঠিত। মৈলী বলে, মোর মা, মহো অর্থাত্ সে আর তার মা এঁকেছে।
—লেখাপড়া শিখেছো?
—অল্প। নাম লিখতে পারি।
—আজকে যে খাসিটা খাওয়ালে ওটা কার?
—মোর।
—তোমার দিতে কষ্ট হয়নি?
—বাপ কহিলে। তুমরালা খাবেন। সারা দিন কিছু খান নাই। যুদ্ধ করেছেন হামার জইন্যে। জয়বাংলা আনিবেন তুমরা।
অদ্ভুত! এই মেয়েটারও বিশ্বাস, জয়বাংলা আনার দায়িত্ব আমাদেরই! যেহেতু যুদ্ধের মাঠে-ময়দানে আছি, এবং আমরা তা আনবোই। আর তখনই মৈলীর মুখের দিকে তাকিয়ে বুকের গহিনে যেন কাঁপন জাগে। সর্দারকে বলি, মৈলী আর অন্যদের এখানে রাখা চলবে না সর্দার। চারপাশে বিপদ। ওদের সরিয়ে দাও।
দুলুও বলে, আমিও সেই কথা এদের বলেছি। কিন্তু দেশের মায়া কাটিয়ে যেতে চায় না।
—যাবে। সাকতি শরণার্থী ক্যাম্পে রংপুর-দিনাজপুর থেকে বহু সাঁওতাল চলে এসছে। সেখানে এরাও যেতে পারবে।
সর্দার বলে, কেমন করি দ্যাশ ছাড়ি যাই কহেন দেখি?
কঠিন প্রশ্ন। তার কথার জবাব, একমাত্র জয়বাংলা এলেই দেওয়া যাবে। কবে হবে সেটা আমাদের জানা নেই।
৯.
দুলু তাগিদ দেয়, ওঠেন। হাঁটতে হবে অন্তত সাত-আট মাইল।
বৃষ্টিভেজা পথ-অপথ, খেতবাড়ি, খালের পানি পার হয়ে আমরা এগুতে থাকি। রাত ১টা হচ্ছে ‘ডি-টাইম’। সে সময় হবে সম্মিলিত আক্রমণ। রাত ৯টায় আমরা রওনা দিয়েছি। মহেন্দ্র সর্দারের তাগিদ-অনুরোধ সেও আজকের অপারেশনে অংশীদার হবে তো, সাঁওতাল সর্দার মহেন্দ্র তীর-ধনুক চালাতে জানে, রাইফেল ছুড়তে তো জানে না। বলি তাকে, যাবেই?
—যামনি? যাবা হবে তুমরাই খালি যুদ্ধ করিবেন, জয়বাংলার যুদ্ধ তো হামারও।
ওর কথা ফেলার উপায় নেই। আশাহত করতেও ইচ্ছে করে না। বলিষ্ঠ শরীরের টগবগে জোয়ান মহেন্দ্র যদি থাকে, তাহলে তো পুরো সাঁওতাল কম্যুনিটিই থাকবে আমাদের সঙ্গে। চারদিকে অবিশ্বাসী মানুষ। কিন্তু মহেন্দ্ররা কখনোই বিশ্বাস ভঙ্গ করবে না, জীবন দিলেও। মহেন্দ্রকে কাজ দেই, বলি তীর-ধনুক ব্যবহারে তোমরা খুবই দক্ষ, কিন্তু খানদের সঙ্গে ওতে চলবে না। চালাতে হবে রাইফেল। সেটা পরে শিখিয়ে দেয়ো যাবে, আজ অন্য কাজ। এক্সপ্লোসিভ আর মাইনের পুঁটলি বহন করবে, সঙ্গে নেবে কোদাল। আমাদের সঙ্গে সঙ্গে থাকবে। কোনো অবস্থাতেই দলছুট হবে না। পালিয়ে আসবে না। আরো তিনজন যুবক বেছে নাও। তারাও গুলিগালা এক্সপ্লোসিভ এগুলো বহন করবে।
—ঠিক আছে।
অন্ধকারের মধ্যেও মহেন্দ্র সর্দারের মুখের আনন্দ আভা টের পাওয়া যায়।
ওরা সকলেই ছিল বিদায়ক্ষণে। তাদের মধ্যে চোখে-লাগা অপরূপ ভঙ্গিমা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে মৈলী। তাকে বলি, যাই মৈলী।
কাপড়ের খুঁটে চোখের পানি মোছে। অবাক ব্যাপার! সে কাঁদছে?
অন্যদের চোখেও জল। মাত্র একদিনের পরিচয়ে এই যদি আদি মানুষগুলো কত আপন করে নিয়েছে, দেশ মাতৃকার মুক্তির লক্ষ্যে যুদ্ধে লিপ্ত অপরিচিত অজানা ছেলেগুলোকে! মৈলীকে আবার বলি, যাই।
—আর আসিবেন না?
—আসব।
—কুনদিন?
—দেখি, যদি বেঁচে থাকি। যুদ্ধ শেষ হলে।
সেই থেকে হাঁটছি। মৈলীর সঙ্গে আর দেখা হবে কি না জানি না। মনে মনে বলি, যেখানেই থাক, উচ্ছলপ্রাণ মায়াময় মেয়েটি নিরাপদে থাক, বেঁচে থাক।
১০.
হাঁড়িভাসা খালের কাছে এসে দলটি তিন ভাগে ভাগ হয়ে যায়। এখন সকলের ষোলআনা দায়িত্ব পালনের মধ্যেই রয়েছে দলের চূড়ান্ত সাফল্য।
বাজার থেকে শ-তিনেক গজ দূরে রাস্তার ঢালে পজিশন নিয়ে অপেক্ষা করছি। কাট-আপ পার্টি প্রথমে মাইন পুঁতবে রাস্তায়। তারপর ফায়ার ওপেন করবে। পিন্টুর পার্টি সঙ্গে সঙ্গে শুরু করবে কভার ফায়ার। তারই আচ্ছাদনে আমরা পৌঁছে যাবো হাঁড়িভাসা। দুলু ঘুরপথে আমাদের নিয়ে তুলবে ইউনিয়ন অফিসের কাছাকাছি। তারপর অ্যাসোল্ট, চার্জ! গুলি ছুড়তে ছুড়তে ঝাঁপিয়ে পড়া। ভয়ানক বিপজ্জনক পরিকল্পনা। কী হবে কিছুই আগাম বলা যায় না।
সময় কাটে দ্রুত। দ্রিমি-দ্রিমি বুকের ভেতর ঢাক বাজে। মেরুদণ্ড বেয়ে শিরশিরে শীতল ঠাণ্ডা অনুভূতি প্রবাহ। অপেক্ষায় দুরূহ ক্ষণ। হঠাত্ করেই এ সময় গুলি শুরু হয়। পিন্টুর মর্টার উড়ে আসে। দুলু বলে, আসেন আমার সঙ্গে। আজ শালাদের খতম করে দেবো।
দ্রুত দুলুকে অনুসরণ। চার্জ! বলে সতের জনের যোদ্ধাদল নিয়ে বাজারে প্রবেশ। প্রচণ্ড গোলাগুলি। চারদিকে যুদ্ধের ডামাডোল। পিছিয়ে যায় খানেরা রাজাকারেরা পঞ্চগড় রাস্তা ধরে। অন্ধকারে ধাওয়া করা কঠিন। তবে বটগাছের গুঁড়ির আড়ালে অবস্থান নিয়ে তাদের উদ্দেশে গুলির তুবড়ি ছুটিয়ে চলে ছেলেরা। আমার কাছে দুলু। উত্তেজনায় কাঁপছে। তাকে শক্ত করে ধরে রাখি। ফিসফিসিয়ে বলি, দেশটা স্বাধীন হলে, আপনাকে আমরা এই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বানাব। চমত্কার মানাবে!
—কী যে কহেন!
—কহেনটহেন না। যা বললাম তাই ঠিক।
—সেটা দেখা যাবে। কিন্তু খানেরা যে পালান দিছে!
—আবার সেই পালান দেওয়ার কথা। অন্ধকারে তার দিকে চেয়ে হেসে ফেলি, বলি, পালান দিছে, দেউক। সামনেই ধরা খাবে। একরামুল আর শামসুল চৌধুরী মহেন্দ্র সর্দারকে নিয়ে আছে ওঁত পেতে...।
কথা শেষ হয় না। বুম! প্রচণ্ড বিস্ফোরণ। বোঝা যায় অ্যান্টি ট্যাঙ্ক মাইন। তাহলে তো খানেরা সত্যিকারভাবেই ধরা খেয়েছে!
একজন পাক সুবেদার খতম। আহত বেশ কয়জন। পঞ্চগড় থেকে রি-ইন ফোর্সমেন্ট এসেছে নতুন সৈনিকের একটা দল। তারা এলাকা চষে বেড়াচ্ছে। কম্বিং অপারেশনে নেমেছে। মুক্তিদের খুঁজে বের করে অবস্থান দখল করবে। একেবারে বিনাশ করে দেবে তাদের।
কিন্তু পাবে কই? আমরা এখন ভেতরগড়ের মতিনদের বাড়ির দহলিজে শুয়ে আছি। পাশে পিন্টু-দুলু। তারা গান ধরেছে, এই বাংলা, বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি...। চমত্কার সুরেলা গলায় দেশের গান ভেসে বেড়ায় ভেতরগড় নামে মুক্ত বাংলার এই অংশে। এখন এই এলাকা পুরোটাই শত্রুমুক্ত। মনের গহনে গভীর আনন্দচ্ছটা। সাফল্যের। শত্রুকে আমরা ঠেকিয়ে দিচ্ছি। হটে যাচ্ছে তারা এলাকা ছেড়ে। মুক্ত হচ্ছে দেশ। এই হারে চলতে থাকলে সমস্ত দেশটা একদিন মুক্তাঞ্চল হয়ে যাবে। বুকের মধ্যে গভীর আশার ঝিলিক। সামান্য করে হলেও কিন্তু হচ্ছে। এগুচ্ছি আমরা। স্বাধীনতার পানে, জয়বাংলার দিকে। খুব সময় কি লাগবে? দেখা যাক! মহেন্দ্রকে বলি, সর্দার বিড়ি দাও।
—উড়োজাহাজ নাই, ভুতি আছে।
—ভুতি মানে মতি বিড়ি। মোটা অনেকটা চুরুটের মতো। রিফাইনড না, তামাকের তৈরি। খুবই কড়া।
—ভুতিই দাও সর্দার।
—মহেন্দ্র বিড়ি এগিয়ে দেয়। জ্বালিয়ে দেয় আগুন। তার আলোতে দেখা যায় সাঁওতাল সর্দারের তেজোদীপ্ত মুখ। বলিষ্ঠ চেহারা। বলি, ভয় পেয়েছ?
—না হয়।
—মৈলীদের সরিয়ে দাও সর্দার, ওপারে নিরাপদ জায়গায়। থেকে যাবে শুধু পুরুষেরা, আজকের মতো মাঝে মাঝে যুদ্ধে যাবে।
—ঠিক আছে।
অমরখানা জগদল পঞ্চগড় থেকে ভেসে আসে কামানের গুড়গুড় গর্জন ধ্বনি। সেই সঙ্গে অবিশ্রান্ত্ত মেশিনগানের গুলিবর্ষণের ভীতি জাগানিয়া শব্দ। তার মধ্যে সবার অপেক্ষা নিয়ে শুয়ে থাকা, বসে থাকা রাত থেকে ভোরের সূর্যের জন্য।
সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০০৫ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত