বিজ্ঞাপন
default-image

সাজ্জাদ শরিফ: ১৯৭১ সালে কোন পরিস্থিতিতে কীভাবে মুক্তিবাহিনী গড়ে তোলার ধারণা জন্ম নেয়?

এ কে খন্দকার: মুক্তিবাহিনী গড়ে ওঠার প্রথম স্ফুরণটি কিন্তু ঠিক পরিকল্পনা করে হয়নি। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ সারা দেশের নিরীহ মানুষের ওপর পাকসেনারা যখন হিংস্রভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তখন তাত্ক্ষণিকভাবে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর ও পুলিশ বাহিনীর বাঙালি সদস্যরা আত্মরক্ষার জন্য রুখে দাঁড়ায়। সেই মুহূর্ত থেকেই মুক্তিযুদ্ধের শুরু। এরপর ৪ এপ্রিল সিলেটের তেলিয়াপাড়া চা-বাগানে কর্নেল এম এ জি ওসমানী, কর্নেল রব, মেজর শফিউল্লাহ, মেজর জিয়াউর রহমান, কর্নেল নূরুজ্জামান, মেজর খালেদ মোশাররফসহ আরও কয়েকজন সম্মিলিত হয়ে মুক্তিফৌজ নামে একটি সংগঠন করেন। আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তিবাহিনী গঠন করা হয় ১৭ এপ্রিল, মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে শপথ নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠিত হওয়ার পর।

সাজ্জাদ: ভারতীয় সেনাবাহিনী এর সঙ্গে কীভাবে সম্পৃক্ত হলো?

খন্দকার: আমাদের সামরিক, আধা-সামরিক ও পুলিশ বাহিনীর যেসব বাঙালি সদস্য প্রতিরোধযুদ্ধ করতে করতে সীমান্ত অতিক্রম করেছিলেন, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কাছ থেকে তাঁরা সামান্য কিছু অস্ত্রশস্ত্র ও অন্যান্য সহায়তা পাচ্ছিলেন। যে গতিতে ও ব্যাপকতায় তখন মুক্তিবাহিনী গড়ে ওঠা দরকার ছিল, তার তুলনায় এ সহায়তা ছিল অপর্যাপ্ত। পরিস্থিতি ও প্রয়োজনের কথা বিবেচনা করে মে মাস থেকে মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার দায়িত্ব ভারতীয় সেনাবাহিনীর ওপর ন্যস্ত হয়। এই প্রথম ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে আমাদের সত্যিকারের যোগাযোগ সূচিত হলো। প্রশিক্ষণের পাশাপাশি তারা আমাদের অস্ত্রশস্ত্র ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস দিতে শুরু করল।

সাজ্জাদ: আপনাদের তো সে সময় কল্পনাসীমারও বাইরে ছিল যে মাত্র নয় মাস পরই দেশ স্বাধীন হতে চলেছে। মুক্তিবাহিনী গড়ে তোলার প্রাথমিক লক্ষ্য হিসেবে আপনারা তখন কী ভেবেছিলেন?

খন্দকার: শক্তিশালী একটি বাহিনী গড়ে তুলে শত্রুদের পরাস্ত করে দেশ স্বাধীন করতে হবে, এ সংকল্প নিয়েই কাজ শুরু হয়। এই আত্মবিশ্বাস না থাকলে আমাদের অস্থায়ী সরকার বা মুক্তিবাহিনী—কারও পক্ষেই তো সেই পরিস্থিতিতে কিছু করা সম্ভবপর হতো না। আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল ছিল অদম্য। সে কারণে আমরা অতি দ্রুত শক্তি সঞ্চয় করে উঠতে পেরেছিলাম।

সাজ্জাদ: আপনি নিজে ব্যক্তিগতভাবে কীভাবে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িত হলেন?

খন্দকার: ঢাকা সেনানিবাসে কর্মরত বাঙালি সামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে আমি ছিলাম পদমর্যাদায় জ্যেষ্ঠতম। ২৯ মার্চ আমি আমার পরিবার নিয়ে লঞ্চে করে ময়মনসিংহ হয়ে সীমান্ত অতিক্রমের চেষ্টা করি। গফরগাঁও অব্দি গিয়ে দেখি, নদীতে নাব্যতা অত্যন্ত কম থাকায় আর এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এর কয়েক দিন পর আবার আরিচা হয়ে সীমান্ত অতিক্রমের চেষ্টা করলাম। দেখি, পাকসেনারা আরিচা ঘিরে রেখেছে। বাধ্য হয়ে আমাদের ফিরে আসতে হয়। ২৬ মার্চের আগে বাঙালি সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করাটা সহজ ছিল না। তাদের কে কোন পক্ষে আছেন, ২৫ মার্চ পর্যন্ত তা ছিল অস্পষ্ট। দ্বিতীয়বার ফিরে আসার পর মনে হলো, এদের মধ্যে যারা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে চান তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা দরকার। আমি ভেবেছিলাম, কিছু বৈমানিক আমাদের সঙ্গে থাকলে যুদ্ধের কোনো না কোনো পর্যায়ে তাঁদের প্রয়োজন হতে পারে। এর আগে তাঁরা গেরিলা হিসেবে যুদ্ধ করবেন। অনেকে তা করেছেনও। উইং কমান্ডার বাশার আর ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট রেজার মাধ্যমে আমি বিভিন্নজনের সঙ্গে যোগাযোগ করি। দেখা গেল, তাঁরা প্রত্যেকেই আমাদের সঙ্গে যেতে ইচ্ছুক। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট নূরুল কাদের সীমান্ত পর্যন্ত গিয়ে আমাদের নিরাপদ পথের সন্ধান নিয়ে এলেন। দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে দুটো ভিন্ন পথ দিয়ে আমরা রওনা দিই, যাতে একটি দল ধরা পড়ে গেলেও অন্য দলটি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে পারে। এভাবে আমরা ১৫ মে আগরতলা গিয়ে পৌঁছাই।

সাজ্জাদ: বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার ও মুক্তিবাহিনীর মূল দলের সঙ্গে আপনার যোগাযোগ ঘটে কীভাবে?

খন্দকার: ভারতীয় বাহিনীর কাছে সেদিনই আমাদের সীমান্ত অতিক্রম করার খবর পৌঁছে গিয়েছিল। মুক্তিবাহিনীকে সহায়তা দেওয়ার জন্য ভারতীয় বাহিনীর পক্ষ থেকে পূর্বাঞ্চলের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল জেনারেল কালকাত সিংকে। পরদিন খুব ভোরে তাঁর সঙ্গে আমি কলকাতা রওনা হয়ে যাই। ক্যাপ্টেন শাফায়াত জামিল আমাদের সঙ্গে ছিলেন। এর পরদিন আমার পরিচয় হয় অস্থায়ী সরকারের সদস্যদের সঙ্গে। নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী, কামরুজ্জামান, খন্দকার মোশতাক ছাড়াও অন্যান্যের মধ্যে সেখানে ছিলেন কর্নেল ওসমানী। তাজউদ্দীন আহমদ অনেকক্ষণ ধরে আমার সঙ্গে সেদিন আলাপ করলেন। আমি বললাম, কিছু জঙ্গি বিমান জোগাড় করা গেলে আমাদের বৈমানিকেরা অন্তত প্রশিক্ষণ চালিয়ে যেতে পারে। যুদ্ধের সময় প্রয়োজনে এদের ব্যবহার করা যাবে। আমাকে মুখে কিছু না বললেও বুঝতে পারলাম, তিনি আমার সঙ্গে একমত। তিন-চার দিন পর কর্নেল ওসমানী আমাকে দিল্লি যেতে বলেন। ওখানে বিভিন্ন সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে যুদ্ধের নানা বিষয় নিয়ে কথা হয়। এরপর ভারতীয় বিমান বাহিনীর গ্রুপ ক্যাপ্টেন বাদামির সঙ্গে আমি চলে আসি আগরতলা। ওখান থেকে পর দিন কলকাতায় চলে আসি।

সাজ্জাদ: তখন তো মুক্তিবাহিনীর গড়ে ওঠার সময়। মুক্তিবাহিনী গড়ে তোলার প্রাথমিক ওই দিনগুলোর কথা একটু বলবেন? কোন নীতি বা কৌশলের ওপর ভিত্তি করে প্রশিক্ষণ পরিচালনা করা হচ্ছিল, কীভাবে আনাড়ি লোক সংগ্রহ করে তাদের যোদ্ধা বানিয়ে তোলা হচ্ছিল বা আপনারা অস্ত্রশস্ত্র পাচ্ছিলেন কী করে?

খন্দকার: মে মাস থেকে ভারতীয় বাহিনী আমাদের সহায়তার দায়িত্ব নেয়। প্রতিমাসে তারা আমাদের দুই হাজার লোককে প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করে। সত্যি বলতে কী, এ সংখ্যা মোটেই যথেষ্ট ছিল না। আমাদের যে অস্ত্রশস্ত্র দেওয়া হচ্ছিল, তার পরিমাণও ছিল অত্যন্ত কম। সম্ভবত সমন্বয়ের অভাবে যে দলগুলোকে গেরিলা যুদ্ধ করার জন্য দেশের ভেতর পাঠানো হতো, তাদের অল্প কিছু অস্ত্র দেওয়া হতো। প্রয়োজনের তুলনায় অতি সামান্য। ফলে প্রথম দিকে আমাদের বেশ কিছু ক্ষয়ক্ষতি হয়। ব্যাপারটি অনেকের মধ্যে কিছুটা অসন্তোষ সৃষ্টি করেছিল। ভারত আদৌ সাহায্য করবে কি না, তা নিয়েও কারও কারও মধ্যে সংশয় দেখা দেয়। সব মিলিয়ে জুন-জুলাইয়ের দিকে আমাদের কার্যক্রম কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়ে। মুখে বলা না হলেও ওপরের পর্যায়ে যোগাযোগ থাকার কারণে আমরা কেউ কেউ অবশ্য এ অবস্থার পেছনের কারণটা আন্দাজ করতে পেরেছিলাম। তখনো পর্যন্ত ভারত ছাড়া আর কোনো দেশ প্রকাশ্যে আমাদের পক্ষে ছিল না। সোভিয়েত ইউনিয়ন আমাদের প্রতি সমর্থন জানালেও প্রকৃত কোনো সাহায্য-সহযোগিতা তখনো দেয়নি।

সাজ্জাদ: এই পরিস্থিতির মোড় ঘুরল কীভাবে? একটি অপ্রতিরোধ্য শক্তি হিসেবে মুক্তিবাহিনীর আবির্ভাব কোন সময়ে কীভাবে ঘটল?

খন্দকার: আগস্ট সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের মধ্যে এই চুক্তি হয় যে তাদের বন্ধুপ্রতিম কোনো রাষ্ট্রকে যদি তৃতীয় কোনো শক্তি আক্রমণ করে, তা হলে তারা পরামর্শ করে যৌথ পদক্ষেপ নেবে। এ চুক্তির পর পুরো চিত্র আমূল পাল্টে গেল। ভারত জোরেশোরে আমাদের সাহায্য করতে শুরু করল। আগস্টের মাঝামাঝি থেকে প্রশিক্ষণের সংখ্যা প্রতিমাসে দুই হাজারের জায়গায় বেড়ে হলো ২০ হাজার। বেড়ে গেল অস্ত্রশস্ত্রের সরবরাহ। আগেই সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে আমাদের ফিল্ড রেজিমেন্ট হবে, ব্রিগেড হবে। এবার সে উদ্যোগ শুরু হলো। আমাদের কাজে একটা প্রবল গতি এল। চুক্তির ঠিক ছয় দিন পর—পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসের পরের দিন—আমাদের নৌ-কমান্ডোরা অত্যন্ত সফল অভিযান চালিয়ে পাকিস্তান ও অন্যান্য দেশের অনেক জাহাজ ডুবিয়ে দেয়। এ ঘটনায় পাকবাহিনীর আত্মবিশ্বাসে সাংঘাতিক চিড় ধরে। বিধ্বস্ত জাহাজের কারণে নৌ-চলাচলও বিঘ্নিত হয়ে পড়ল। আন্তর্জাতিক বহু নৌ-প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম আসতে অপারগতা প্রকাশ করে। এ ঘটনায় আমাদের মনোবল অসম্ভব বেড়ে গিয়েছিল।

সাজ্জাদ: রাজনৈতিক নেতৃত্বের বাইরে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে কি মুজিবনগর সরকারের আর কোনো যোগসূত্র ছিল? এর পরিচালনায় কি তারা কোনো ভূমিকা রাখতেন? যৌথবাহিনীর নেতৃত্ব ও মুজিবনগর সরকারের মধ্যে কোনো টানাপোড়েন হতো না? সমন্বয়ের কাজটি হতো কী করে?

খন্দকার: একটি ন্যায়সংগত গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সরকারের অধীনে আমরা যুদ্ধ করছিলাম বলেই তো ভারত আমাদের সহযোগিতা করেছিল। সবার মধ্যে আলোচনা ও যোগাযোগের ভিত্তিতেই কাজ হতো। জেনারেল জগজিত্ সিং অরোরা আসতেন। অন্য সামরিক কর্মকর্তারাও আসতেন। কর্নেল ওসমানী ও আমি থাকতাম। কখনো তাদের সঙ্গে আলোচনার জন্য আমরা ফোর্ট উইলিয়ামে যেতাম। কর্নেল ওসমানীর সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদের আলোচনা হতো। একটা সমঝোতার ভাব ছিল। হ্যাঁ, আমরা যেভাবে সব চাইতাম বা আমাদের প্রত্যাশাটা যত বড় থাকত, সব সময় সবকিছু নিশ্চয়ই সেভাবে হতো না। এত বড় একটা ঘটনার মধ্যে এসব ছোটখাটো ব্যাপার ঘটতেই পারে। কিন্তু বৃহত্তরভাবে বোঝাপড়ার কোনো কমতি বা সমঝোতার অভাব আমাদের ছিল না।

সাজ্জাদ: আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থক বাদেও তো নানা রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীর লোক মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয়। তাঁদের মতাদর্শিক বিরোধ বা স্বার্থের সংঘাত আপনারা কীভাবে মোকাবেলা বা মীমাংসা করতেন?

খন্দকার: কলকাতায় কর্নেল ওসমানীর সঙ্গে দেখা হওয়ার পর তিনি আমাকে বলেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধে প্রশিক্ষণের জন্য শুধু আওয়ামী লীগের কর্মীদের নেওয়া হবে। আমরা সবাই বললাম, এটা হতে দেওয়া একেবারেই ঠিক নয়। দেশকে ভালোবেসে প্রাণ বাজি রেখে যারা যুদ্ধ করতে এসেছে, অন্য দল করার কারণে তাদের কাউকে বাদ দেওয়ার অধিকার তো আমাদের নেই। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ডি পি ধর। তাঁরও একটা প্রচেষ্টা ছিল সব দল থেকে লোক নেওয়ার। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আমাদের আলোচনা হয়। আমরা এ সমঝোতায় পৌঁছাই যে আমাদের যা কিছু করার, স্বাধীনতাকামী প্রতিটি দলের লোককে সঙ্গে নিয়েই তা করতে হবে। এরপর আমাদের আর কোনো সমস্যা হয়নি।

সাজ্জাদ: মুজিববাহিনী কি আদৌ আপনাদের নেতৃত্ব মেনে নিয়েছিল? মুজিববাহিনীর দায়িত্বে থাকা ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা উবানের স্মৃতিকথা কিন্তু আমাদের কাছে একেবারে উল্টো একটা ছবি তুলে ধরে।

খন্দকার: হ্যাঁ, এ কথা সত্যি যে মুজিববাহিনী কখনোই আমাদের নেতৃত্ব মেনে নেয়নি। এদের নিয়ে প্রায়ই বেশ সমস্যা তৈরি হতো। তাজউদ্দীন আহমদ ও কর্নেল ওসমানী যে ব্যাপারটি নিয়ে খুব সন্তুষ্ট ছিলেন, তাও নয়। মুজিববাহিনীকে একটি অভিন্ন নির্দেশনার অধীনে নিয়ে আসার জন্য তাঁরা অনেক চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সেটা সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি।

সাজ্জাদ: মুক্তিবাহিনীর ব্যাপারে বাংলাদেশ ও ভারতের পক্ষে নির্দিষ্ট দায়িত্বগুলো কী ছিল? আপনারা দুই পক্ষ কাজগুলো কীভাবে সমন্বয় করতেন?

খন্দকার: দুই পক্ষের দায়িত্বই পরিষ্কারভাবে নির্ধারিত ছিল। যুদ্ধের মতো একটা বিশাল কর্মকাণ্ডে দায়িত্বের বিভাজন অস্পষ্ট থাকলে তো যুদ্ধ করাই কঠিন। আমাদের দিক থেকে দায়িত্ব ছিল মানব সম্পদ, মানে যোদ্ধা সরবরাহ করা। আর ভারত আমাদের দিয়েছে প্রশিক্ষণ, থাকার জায়গা, যোগাযোগের সুবিধা, অস্ত্রশস্ত্র ইত্যাদি। হেড কোয়ার্টার থেকে নির্দেশ যেত সেক্টর কমান্ডারদের কাছে। আমাদের ও ভারতের সেক্টর কমান্ডারদের আলোচনার ভিত্তিতে তখন আক্রমণের পরিকল্পনা হতো। আমরা যুদ্ধ করতে সাধারণত দেশের ভেতরে ঢুকে যেতাম। ভারতীয় বাহিনী তখন কামান দিয়ে আমাদের কাভার দিত, যাতে পাকসেনারা আমাদের বাধা দিতে সক্ষম না হয়।

সাজ্জাদ: যৌথবাহিনীর প্রধান জেনারেল জগজিত্ সিং অরোরা এক সাক্ষাত্কারে জানিয়েছেন, জেনারেল নিয়াজী তাঁকে বলেছিলেন যে মুক্তিবাহিনী নাকি তাঁকে অন্ধ ও বধির করে দিয়েছিল। ভারতীয় কর্মকর্তারা মুক্তিবাহিনীকে কী চোখে দেখতেন?

খন্দকার: সবার কথা বলতে পারব না। দুই বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে কোথাও কোথাও হয়তো সামান্য ভুল বোঝাবুঝি বা রেষারেষির ঘটনা ঘটেছে। সেসব বড় কিছু নয়। তবে আমার সঙ্গে যাঁদের দেখা হতো—জেনারেল অরোরা, জেনারেল জ্যাকব, জেনারেল সরকার—মুক্তিবাহিনী সম্পর্কে তাঁদের কিন্তু অত্যন্ত উঁচু ধারণা ছিল। তাঁরা স্বীকার করতেন যে মুক্তিবাহিনী খুব কার্যকরভাবে যুদ্ধ করছে। শত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও যে সাহসিকতার সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধারা লড়াই করেছে, সেটা ব্যাখ্যা করে বলা যাবে না। অক্টোবরের মাঝামাঝি সারা দেশে ভয়ঙ্করভাবে তাদের লড়াই ছড়িয়ে পড়ে। নিয়াজী যে অন্ধ হওয়ার কথা বলেছেন, সে প্রসঙ্গে বলছি। ‘অপারেশনাল ব্লাইন্ডনেস’ বলে যুদ্ধে একটা কথা আছে, যখন প্রতিরক্ষা বা আক্রমণের সময় আপনি জানেন না শত্রুপক্ষ কত শক্তি নিয়ে কোথায় কী অবস্থায় আছে। মুক্তিযোদ্ধারা সত্যি সত্যিই তাদের সে অবস্থায় ফেলে দিয়েছিল। কারণ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি জনযুদ্ধ। সাধারণ মানুষ মুক্তিযোদ্ধাদের ভালোবেসেছে; চরম বিপদ মাথায় নিয়ে তাদের থাকা, খাওয়া, চিকিত্সা, তথ্য, গোপন আশ্রয়—সব দিয়েছে। পক্ষান্তরে পাকসেনারা যুদ্ধ করেছে সম্পূর্ণ শত্রু-পরিবেষ্টিত পরিবেশে।

সাজ্জাদ: আপনারা কখন বুঝতে পারলেন যে যুদ্ধের পরিণাম আপনাদের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে?

খন্দকার: আমার নিজের কেমন একটি ধারণা ছিল যে এক কোটি শরণার্থীর ভার নিয়ে একটি দেশ অনির্দিষ্টকাল যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারে না। স্থানীয় সমাজ ও রাজনীতিতে এর একটি বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে বাধ্য। কাজেই আক্রমণ করে এগিয়ে গিয়ে যুদ্ধ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার একটি সুবিধাজনক সময় আমাদের বেছে নিতে হবে। ভারতের উত্তর দিক থেকে একমাত্র চীন হুমকি হিসেবে আসতে পারত। চীন যে আসবে, পাকিস্তান শেষ দিন পর্যন্ত এ কথা বিশ্বাসও করত। কিন্তু ভারতের এ হিসাব ছিল যে শীতকালে চীন থেকে ভারত বা বাংলাদেশে প্রবেশের পথ বরফে ঢেকে যাবে। সিকিমের পাশ দিয়ে চুম্বি নামে আর যে ছোট পথটি ব্যবহার করা যেত, সেটি দিয়ে বেশি সৈন্য নিয়ে আসা সম্ভব নয়। নভেম্বরে যখন মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করতে করতে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ল, তখন স্পষ্টই বোঝা গেল যে পাকসেনাদের যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার মানসিক ও শারীরিক শক্তি প্রায় বিধ্বস্ত।

সাজ্জাদ: ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় আত্মসমর্পণের দলিল স্বাক্ষরের সময় মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক ওসমানী আসতে পারেননি, উপ-প্রধান হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন আপনি। সেদিনের ঘটনাটি বলুন।

খন্দকার: ৩ ডিসেম্বর প্রত্যক্ষ যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার পর থেকেই আমাদের মনে হচ্ছিল, পাকিস্তানি বাহিনী যেকোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে। ১৬ ডিসেম্বর সকাল ১০টার দিকে অফিসের এক দরকারি কাজে আমি মুক্তিবাহিনীর প্রধান কার্যালয়ের বাইরে গিয়েছিলাম। সবাই তখন হন্যে হয়ে আমাকে খুঁজছে। আমার দেখা পাওয়ার পর একজন জানালেন, তাজউদ্দীন আহমদ আমাকে খুঁজছেন। ঢাকার রমনা ময়দানে বিকেল ৪টায় পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করবে। সে অনুষ্ঠানে আমাকে মুক্তিবাহিনীর প্রতিনিধিত্ব করতে হবে। আমার গায়ে তখন একটা শার্ট আর সোয়েটার। সে অবস্থায়ই আমি দমদম চলে গেলাম। প্লেনের কাছাকাছি পৌঁছাতেই একটি জিপে করে জেনারেল অরোরা এসে হাজির। আমি তাঁকে বললাম, ‘স্যার, আপনি আগে প্লেনে উঠুন।’ আমার পিঠে হাত দিয়ে তিনি বললেন, ‘আপনি মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার। আমি আপনার পেছনে পেছনে যাব।’ ঢাকা বিমানবন্দরের রানওয়ে বিধ্বস্ত থাকায় আগরতলা হয়ে হেলিকপ্টারে করে আমরা ঢাকা পৌঁছাই। জিপে করে যখন যাচ্ছি, রাস্তায় তখন অসংখ্য মানুষ। আরে সে যে কী আনন্দ-উল্লাস! আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানটি যে বেশ শৃঙ্খলাপূর্ণভাবে হয়েছিল, সে কথা আমি বলব না। কোনোভাবে আমাদের জায়গা করে নিতে হয়েছিল। কয়েক মিনিটের মধ্যেই দলিলে স্বাক্ষর হয়ে গেল। তখন ঢেউয়ের মতো মানুষ আসছে। আমাকে তারা জড়িয়ে ধরছে, কাঁদছে। সবার মুখে আশা, আকাঙ্ক্ষা আর স্বপ্ন। সে অনুভূতি কখনো ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়।