বিজ্ঞাপন
default-image

৩ ডিসেম্বর ১৯৭১। বিকেলবেলায় আমি কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে আমার দপ্তরে কাজ করছি। সন্ধ্যা ছয়টায় টেলিফোন বেজে উঠল। ফোন করেছেন তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল (পরে ফিল্ড মার্শাল) স্যাম মানেকশ। দিল্লি থেকে ফোন করেছিলেন তিনি। তিনি জানালেন, পাকিস্তান পশ্চিমে আমাদের বেশ কয়েকটি বিমান ঘাঁটিতে বোমাবর্ষণ করেছে। তিনি আমাকে পূর্ব পাকিস্তানে অভিযান বাস্তবায়নের নির্দেশ দিলেন। ‘পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে,’ তিনি বললেন। প্রধানমন্ত্রী তখন কলকাতায়। বিষয়টি তাঁকে অবহিত করতে তিনি আমাকে নির্দেশ দিলেন।

আমি আমার চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জ্যাকবকে (পরে লে. জেনারেল) ডেকে সব ফিল্ড কমান্ডারকে সতর্ক করে দিতে এবং একটি স্টাফ কনফারেন্স আয়োজন করতে বললাম। বললাম, ‘মেস থেকে সবচেয়ে ভালো ব্র্যান্ডের স্কচ নিয়ে আসুন। আমি এক্ষুনি আসছি।’

গাড়ি চালিয়ে আমি রাজভবনে গেলাম। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সেখানে অবস্থান করছেন। আমি যখন পৌঁছালাম তখন তিনি সবেমাত্র একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিয়ে নিজের কামরায় ফিরেছেন। আমি দরজায় কড়া নাড়লে তিনি আমাকে ভেতরে ঢুকতে বলেন। আমি তাঁকে স্যালুট দিয়ে সেনাপ্রধানের বার্তা পৌঁছে দিলাম।

‘হ্যাঁ,’ তিনি উত্তর দিলেন। ‘অল ইন্ডিয়া রেডিওতে আমি সেটা শুনেছি। এখন আমি দিল্লি যাচ্ছি।’ তিনি দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন। মনে হলো, তিনি কোথাও হারিয়ে গেছেন। তাঁর দৃষ্টি অনেক দূরে নিবদ্ধ।

নীরবতা ভেঙে আমি বললাম, ‘শুভ কামনা, মিসেস গান্ধী।’

তিনি ফিরে দাঁড়িয়ে হাসলেন। আমার সঙ্গে হাত মিলিয়ে বললেন, ‘আপনার জন্যও শুভ কামনা, জেনারেল।’

পাকিস্তানের সঙ্গে আমরা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছি। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে ফোর্ট উইলিয়ামে আমার কার্যালয়ে চলে এলাম। আমার চিফ অব স্টাফ জেনারেল জ্যাকব মেস থেকে একটি ব্ল্যাক ডগ নিয়ে এলেন। স্টাফ অফিসার ও উপদেষ্টা যাঁরা ছিলেন, তাঁদের সবাইকে টেবিলে হুইস্কি পরিবেশন করা হলো। আমরা গ্লাস তুলে বাংলাদেশের আসন্ন বিজয় উদ্‌যাপন করলাম। আমাদের সবচেয়ে সুবিধাজনক সময়ে যুদ্ধ শুরু করায় ইয়াহিয়া খানের উদ্দেশেও আমি এক দফা পান করার প্রস্তাব করি। এরপর আমাদের কাজ শুরু হয়ে গেল।

আমার প্রথম কাজ ছিল আমার নেতৃত্বাধীন সেনাদের যুদ্ধপরিস্থিতি সম্পর্কে জানানো। তাঁদের নিজ নিজ দায়িত্ব পালনের জন্য নির্দেশ দেওয়া। একটি বিশেষ আদেশ জারি করে সে দিন আমি কাজটা সম্পন্ন করি। আদেশটা ছিল এ রকম:

পূর্বাঞ্চলীয় সেনাবাহিনীর সাহসী কর্মকর্তা ও জওয়ানেরা,

পাকিস্তান বিনা উসকানিতে আজ সন্ধ্যায় পশ্চিমে আমাদের বিমান ঘাঁটিতে আক্রমণ চালিয়েছে। আমরা পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছি। পূর্বাঞ্চলীয় সেনাবাহিনীর হাতে ভারতের ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষা এবং পশ্চিম পাকিস্তানের জোয়াল থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন করার মহান দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে। এই দায়িত্ব অর্পিত হওয়ায় আমরা বিশেষ সম্মানিত বোধ করছি।

পাকিস্তান রাষ্ট্র জন্ম থেকেই ভারতের প্রতি ঘৃণা পোষণ করে আসছে। তারা ভারতকে ধ্বংস করতে চায়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাংলাদেশের জনগণের ওপর যে বর্বর ও অমানবিক নৃশংসতা চালিয়েছে, ইতিহাসে তার তুলনা পাওয়া ভার। বাংলাদেশে অসহায় মানুষকে আশ্রয় দেওয়ায় পাকিস্তান আমাদের ওপর আরও বিক্ষুব্ধ হয়েছে।

এখন সময় এসেছে, পাকিস্তানকে জুতসই শিক্ষা দেওয়ার। এবার চূড়ান্তভাবে তাদের শেষ করে দিতে হবে।

ঈশ্বরের ওপর আস্থা রেখে এবং আমাদের উদ্দেশ্যের নীতিগত ব্যাপারে একাত্ম হয়ে আমি বলতে চাই, আপনারা সবাই গভীর আত্মনিবেদন, প্রতিজ্ঞা, পেশাদারি দক্ষতা ও উৎসর্গের মাধ্যমে নিজের নিজের দায়িত্ব পালন করতে ঝাঁপিয়ে পড়বেন। আমাদের পূর্ণ সফলতা লাভ করতে হবে সবচেয়ে কম সময়ের মধ্যে।

মনে রাখবেন, বাংলাদেশে আপনারা প্রবেশ করছেন মুক্তিদাতা হিসেবে, দখলদার হিসেবে নয়। জনগণের সঙ্গে আপনাদের আচরণ অবশ্যই বিবেকসম্মত ও যথাযথ হতে হবে।

আপনাদের সর্বাঙ্গীণ সাফল্য কামনা করছি। আপনারা দ্রুততম সময়ের মধ্যে সফল হোন।

২.

বাসায় ফিরে আমি আমার পড়ার ঘরে শুয়ে পড়লাম। সেখানে বাংলাদেশের একটা বড় মানচিত্র আর টেলিফোন। ভোর পর্যন্ত বেশ গভীর ঘুম হলো।

ফিল্ড কমান্ডাররা কী করলেন, পর দিন সকাল সকাল তার খোঁজখবর নিলাম। দ্রুত নাশতা সেরে চলে গেলাম ফোর্ট উইলিয়ামে, স্টাফ কনফারেন্সে যোগ দিতে। প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়ার পর সংবাদ সম্মেলনের জন্য গেলাম প্রধান প্রেস কর্মকর্তার কার্যালয়ে।

সেখানে দুই শরও বেশি ভারতীয় ও বিদেশি সাংবাদিক উপস্থিত। তাঁদের অনুরোধে আমি ব্যাখ্যা করে বোঝালাম, ভারতের ওপর কীভাবে এ যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর আমরাই বা কেন বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতার যুদ্ধে সহায়তা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

তাঁদের বললাম, আমাদের প্রধান লক্ষ্য হলো, বাংলাদেশে দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে যতটা দ্রুত সম্ভব আত্মসমর্পণে রাজি করানো। আমি সবদিক থেকে নানা রকমের চাপ দিতে শুরু করেছি। তবে কাজটা আমি কীভাবে করব, সে সম্পর্কে তাঁদের কিছু বলতে পারিনি। মুক্তিবাহিনীর ভূমিকা সম্পর্কেও আমি কিছু বলতে অপারগতা জানাই। অনুমোদিত যুদ্ধ সংবাদদাতাদের আমি আমাদের অগ্রসরমাণ সেনাদের সঙ্গে যাওয়ার অনুমতি দিই।

যুদ্ধের প্রথম দিনের বেশির ভাগ সময়ই আমি অপারেশন কক্ষে বসে ফিল্ড কমান্ডারদের কাজের অগ্রগতির প্রতিবেদন দেখে কাটিয়ে দিয়েছিলাম।

খুশবন্ত সিংয়ের বই ওয়ার অ্যান্ড পিস ইন ইন্ডিয়া, পাকিস্তান অ্যান্ড বাংলাদেশ-এ সংকলিত জেনারেল অরোরার বর্ণনা থেকে প্রতীক বর্ধনের অনুবাদ

লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা: ১৯৭১ সালে ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় সেনাবাহিনীর অধিনায়ক

সূত্র: ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত