বিজ্ঞাপন
default-image

৩ ডিসেম্বর, শুক্রবার

সন্ধ্যায় শুনতে পেলাম, বিমান ও গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় ভারতের অগ্রবর্তী বাহিনী গোটা পশ্চিম পাকিস্তানে দ্বিতীয় রণক্ষেত্র চালু করেছে। আমাদের বিমানবাহিনী শ্রীনগর থেকে রাজস্থান ও আগ্রা পর্যন্ত নয়টি বিমানঘাঁটিতে হামলা চালিয়ে জবাব দিয়েছে। আমি মনে করি, শত্রুদের রাডার ও রাশিয়ার এসএএম (ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র) ফাঁকি দিয়ে চালানো এই হামলা কৃতিত্বের দাবি রাখে। কেন যেন মনে হয়, ভারতীয়রা এ ব্যাপারে অসতর্ক ছিল। এত তাড়াতাড়ি তাদের ওপর এমন শক্তিশালী হামলা চালানো হতে পারে, ঘুণাক্ষরেও তারা আশঙ্কা করেনি।

গত রাতে কয়েক দফায় বিমান হামলার আগাম সংকেত দেওয়া হয়েছিল। নিশ্চয়ই বিমান তৎপরতা ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। প্রথমবার সতর্কসংকেত শোনার পর আমার ছোট্ট মেয়ে তানিয়ার ঘুম ভেঙে যায়। সে চিৎকার করে সবাইকে নিরাপদ আশ্রয় নিতে বলে।

৬ ডিসেম্বর, সোমবার

নিরাপত্তা পরিষদে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। কিন্তু রাশিয়ার বাধার মুখে তাদের উদ্যোগ বিফল হয়। তারা সব ধরনের যুক্তি ভেটোতে প্রয়োগ করে।

৭ ডিসেম্বর, মঙ্গলবার

মনে হচ্ছে, মার্কিননীতি পাকিস্তানের দিকে মোড় নিয়েছে। তারা ভারতকে আগ্রাসনকারী আখ্যা দিয়ে নিন্দা জানিয়েছে এবং সব ধরনের উন্নয়ন সহযোগিতা বন্ধ করে দিয়েছে। এটি আমাদের জন্য কিছুটা হলেও সাফল্যের। এতে হয়তো ভারত তার সেনাদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করতে পারে। কারণ, দেশটি দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার অবস্থায় নেই, অবশ্য পাকিস্তানের অবস্থাও তা-ই। আমরা উভয়েই নেতিবাচক প্রচেষ্টার মাধ্যমে নিজেদের ধ্বংস করছি। আমরা আর কী করতে পারি? ভারত তো কোনো যুক্তি মানবে না।

বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে ভারত। এর ফলে, ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে পাকিস্তান। এ পদক্ষেপে বড় ধরনের কোনো অসুবিধা হবে না। যদিও ভারত সম্পর্কে যে ধরনের গোয়েন্দা তথ্য এর আগে আমরা পেতাম, তা পাব না।

৮ ডিসেম্বর, বুধবার

নূরুল আমীন ও ভুট্টোকে যথাক্রমে প্রধানমন্ত্রী ও উপপ্রধানমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আশা করি, এটি পাকিস্তানের জন্য সবচেয়ে কালো দিবস হিসেবে প্রমাণিত হবে না। কারণ, ভুট্টো লোকটা অবর্ণনীয় সমস্যা সৃষ্টি করতে ওস্তাদ। লস যত দিন বেঁচে থাকবে আর এ দেশে থাকবে, তত দিন কোনো শান্তি আসবে না। নূরুল আমীন, এমনকি ইয়াহিয়া খানও তাঁকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা রাখেন না। পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করতে ভুট্টোকে পাঠানো হয়েছে জাতিসংঘে। তিনি হয়তো দেশের প্রতিনিধিত্ব করবেন, কিন্তু তাঁর চেষ্টা থাকবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার।

পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা খবর খুব একটা ভালো নয়। অনেক এলাকায় আমাদের সেনারা পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে, যদিও তারা বীরবিক্রমে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে।

পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে অস্ত্রবিরতি এবং নিজ নিজ ভূখণ্ডে সেনা প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ একটি প্রস্তাব পাস করেছে। এতে কী ধরনের প্রভাব পড়ে তা দেখার বিষয়। সম্ভবত খুব একটা কাজে দেবে না। কারণ, ভারত কোনো যুক্তি শোনার মেজাজে নেই।

১০ ডিসেম্বর, শুক্রবার

নূরুল আমীনের নিয়োগ কৃত্রিম ঠেকছে। তিনি কার প্রতিনিধিত্ব করবেন? আমি মনে করি না তিনি পূর্ববঙ্গে গিয়ে সুবিধা করতে পারবেন, ইয়াহিয়া ও ভুট্টোরও সেই ক্ষমতা নেই। তিনি যতই সুশাসক হোন না কেন, এত দিনে অনেক বুড়ো হয়ে গেছেন, ৭৪ বছর বয়স। ইতিবাচক কোনো অবদান রাখার মতো বয়স তাঁর আর নেই। আমার বিশ্বাস, পূর্ববঙ্গে আর টিকতে পারবেন না জানার পরই তিনি ও তাঁর আত্মীয়স্বজন সে জায়গা ছেড়েছেন।

পূর্ব পাকিস্তানে আমাদের সেনারা বীরদর্পে যুদ্ধ করছে; কিন্তু সংখ্যায় তারা খুব কম, অস্ত্রশস্ত্রও খুব বেশি নেই। এ ছাড়া তারা ভারতীয় নৌবাহিনীর অবরোধের মুখে পড়েছে। এর মানে সেখানে সামরিক শক্তিবৃদ্ধি কিংবা ক্ষয়ে যাওয়া শক্তি পূরণ সম্ভব নয়। আক্ষরিক অর্থে সেনাবাহিনীর পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে, আর তাদের সামনে শত্রুভাবাপন্ন বিশাল জনগোষ্ঠী। এই পরিস্থিতিতেই তাদের লড়াই করতে হচ্ছে। আমাকে বলা হয়েছে, ভারতীয় আগ্রাসন সত্ত্বেও বাঙালিদের আচরণে কোনো পরিবর্তন আসেনি।

১২ ডিসেম্বর, রোববার

দুই দিন ধরে বিভিন্ন গণমাধ্যমে জোর দিয়ে তুলে ধরার চেষ্টা চলছে যে পূর্ব পাকিস্তানে আমাদের অপেক্ষাকৃত কমসংখ্যক সেনা কী প্রবল শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। শত্রুপক্ষের লোকবল ও অস্ত্রশস্ত্র অনেক বেশি। এ ছাড়া, সেনা অবতরণের কাজে এখন হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হচ্ছে। ঢাকার মাত্র ৬০ মাইল উত্তরে একদল প্যারা ব্রিগেড নামানো হয়েছে।

অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, তারা সবচেয়ে ভয়ানক, বেদনাময় ও হৃদয়বিদারক কিছুর জন্য জনগণকে প্রস্তুত করছে। ভারতের সঙ্গে গোপন কোনো চুক্তির কারণেই হয়তো এসব কিছু করা হচ্ছে। অবাঙালি, পশ্চিম পাকিস্তানি ও বিশেষ করে পাঞ্জাবিদের বিরুদ্ধে ঘৃণা এখন তিক্ত ফলে পরিণত হতে যাচ্ছে। তাদের দুর্ভাগ্য যে তারা শত্রু-মিত্রের পার্থক্য বুঝতে পারে না। এই ত্রুটির জন্য শত বছর ধরে তাদের মূল্য দিতে হবে।

এর মধ্যে, দেশটির অবস্থা আরও জটিল হয়ে উঠবে। সম্ভবত মেরামতের বাইরে চলে যাবে।

১৩ ডিসেম্বর, সোমবার

প্রেসিডেন্ট নিক্সন যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে ইন্দিরা গান্ধীকে হয়তো কঠিন ভাষায় চিঠি পাঠিয়েছেন। এমন ইঙ্গিতও মিলছে, সেন্টো আর সিয়াটো চুক্তির বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী তারা এমনকি হস্তক্ষেপ করতে পারে। কেউ কেউ বলছেন, পাকিস্তানকে কীভাবে সহযোগিতা দেওয়া যায়, এ বিষয়ে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র পরস্পরের সঙ্গে আলোচনা করছে। এদিকে এরই মধ্যে রাশিয়ার একটি শীর্ষ প্রতিনিধিদল নয়াদিল্লি এবং ভারতের অন্য একটি দল মস্কো গেছে। সেই সঙ্গে, পূর্ব পাকিস্তানে ভারত যে গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে, তাতে রাশিয়া নাখোশ। রাশিয়া চায় ঢাকা দখল করা হোক এবং ১৫ তারিখের মধ্যেই যেন সেখানে বাংলাদেশ সরকার অধিষ্ঠিত হয়। যাতে নিরাপত্তা পরিষদে তাদের আবার ভেটো দিতে না হয়।

১৪ ডিসেম্বর, মঙ্গলবার

যুদ্ধবিরতির দাবিতে নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবে আবার ভেটো দিয়েছে রাশিয়া। আমার আশঙ্কা, এর পর যুক্তরাষ্ট্র ঠান্ডা হয়ে যাবে। যদি তাদের ফ্লিট (সপ্তম নৌবহর) বঙ্গোপসাগরের দিকে অগ্রসর হতে থাকেও, তারও ব্যবহার করা হবে না। ভারতেরও একই হিসাব। তারা ভাবছে, যুক্তরাষ্ট্র শুধু ক্ষোভ প্রকাশ করছে। আমিও তাদের মতের পক্ষে। ভারতীয়রা এখন বেপরোয়া হয়ে উঠছে। আজাদ কাশ্মীর বা পশ্চিম পাকিস্তানে হামলা চালানোর উদ্দেশ্য তাদের আছে কি না, যুক্তরাষ্ট্রের এমন প্রশ্নের জবাব ভারত দেয়নি।

গত কয়েকটি দিন ছিল সবচেয়ে হতাশাপূর্ণ। পূর্ব পাকিস্তানের খবর খারাপ। শত্রুরা সেখানে সবকটি গুরুত্বপূর্ণ শহরের চৌহদ্দিতে আক্রমণ চালাচ্ছে। ঢাকা থেকে প্রায় ৪০ মাইল উত্তরে টাঙ্গাইলে প্যারাস্যুট ব্রিগেড নামানো হয়েছে। এ ছাড়া পুব দিক থেকে হেলিকপ্টারবাহী ব্রিগেড ও অন্য একটি দল ঢাকার দিকে অগ্রসর হচ্ছে বলে গুজব শোনা যাচ্ছে। শত্রুদের বিমান থেকে সামরিক ও বেসামরিক নির্বিচারে সব ধরনের লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালানো হচ্ছে। এক হামলায় গভর্নমেন্ট হাউসে আগুন ধরে গেছে।

রেডিও ও গণমাধ্যমের খবরে আমাদের আশ্বস্ত করা হচ্ছে যে শত্রুদের দৃঢ়তার সঙ্গে ঠেকানো হয়েছে। কিন্তু ব্রিটিশ সূত্রগুলো বলছে, ঢাকার চারিদিকে শত্রুরা শক্ত অবস্থান নিয়েছে, ঢাকার উপকণ্ঠে তুমুল লড়াই চলছে। তারা টেলিফোনে এ তথ্য সংগ্রহ করতে সমর্থ হয়েছে এবং বন্দুক ও অন্যান্য আগ্নেয়াস্ত্রের শব্দ শোনার দাবি করেছে।

১৫ ডিসেম্বর, বুধবার

সিঙ্গাপুর থেকে পাঠানো এক সংবাদে বলা হয়েছে, মার্কিন সপ্তম নৌবহর মালাক্কা প্রণালি পার হয়ে বঙ্গোপসাগরের দিকে এগোচ্ছে। পরের খবরে নিশ্চিত করা হয়েছে, নৌবহরটি সম্ভবত চট্টগ্রামের দিকে যাবে। তাদের উদ্দেশ্য কী বোঝা গেল না। এই বাহিনীর যথেষ্ট ক্ষমতা আছে। কিন্তু পূর্ববঙ্গের পরিস্থিতি পাল্টে দেওয়ার উদ্দেশে তা প্রয়োগ করা হবে কি না সন্দেহ করি।

দুপুরের সংবাদে ঢাকার আশপাশের ভয়ানক পরিস্থিতির ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। সন্ধ্যার খবরে স্পষ্ট করে বলা হয়, ঢাকার চারপাশে সব দিক থেকে যুদ্ধ চলছে এবং বৃত্ত ছোট করে আনা হচ্ছে। শত্রুপক্ষের বহু সেনাদল তাতে যোগ দিয়েছে।

এ বড় মর্মান্তিক খবর। মনে হচ্ছে, পূর্ব পাকিস্তানের পতন শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু কিছু বোকা সংকীর্ণ আবেগে অন্ধ মানুষ পরিণাম অনুধাবন না করেই এই কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়েছিল। তারা যদি বিভাজন চাইত, তাহলে সহজে শান্তিপূর্ণ উপায়েই তা করতে পারত।

১৬ ডিসেম্বর, বৃহস্পতিবার

এই মাত্র খবর পেলাম নিয়াজি পূর্ব পাকিস্তানে আত্মসমর্পণ করেছেন এবং যুদ্ধ থেমে গেছে। ভারতের সেনারা ঢাকায় কুচকাওয়াজ করছে। ঢাকা দুর্বল করতে মর্টার ও অন্যান্য অস্ত্র নিয়ে মুক্তিবাহিনী সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। তারা জাতীয়তাবাদী ও জামায়াতে ইসলামী ধরনের ব্যক্তিদের হত্যা করছে।

ভারত ঘোষণা দিয়েছে, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। দেশটির সরকার আজই শপথ নেবে। ইন্দিরা গান্ধী ঘোষণা দিয়েছেন, যেহেতু তাঁদের লক্ষ্য পূরণ হয়েছে, তাই আগামীকাল সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা থেকে তারা এক তরফা অস্ত্রবিরতি পালন করবে।

বেদনাময় হলেও বাংলার এই বিভাজন ছিল অনিবার্য। তা এড়ানো সম্ভব ছিল না। পূর্ববঙ্গের বেশির ভাগ মানুষকে পশ্চিম পাকস্তানিদের শত্রু বলে বোঝানো হয়েছে, আমাদের শাসকদের সময়মতো এ সত্য অনুধাবন করা উচিত ছিল। ভারতের হস্তক্ষেপ শুরুর আগেই বাঙালিদের শান্তিপূর্ণ উপায়ে যেতে দেওয়া উচিত ছিল।

ডায়রিস অব ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মদ আইয়ুব খান ১৯৬৬-১৯৭২ বই থেকে মিজান মল্লিকের অনুবাদ

ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মদ আইয়ুব খান: পাকিস্তানের সাবেক সামরিক শাসক

সূত্র: ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত