বিজ্ঞাপন
default-image

হেলিকপ্টারগুলো যখন পূর্ব প্রান্তে ৪ নম্বর কোরের সৈন্য ও যুদ্ধের সাজসরঞ্জাম মেঘনা পার করে দিচ্ছে, সে সময়েই দেশের মধ্যভাগে সেনাবাহিনী আর বিমানবাহিনী মিলে আরেকটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে চলেছিল।

যুদ্ধের পরিকল্পনার সময়েই যেখানে প্রয়োজন সেখানে নিয়োগ দেওয়ার জন্য প্রধান সামরিক কার্যালয় থেকে এক ব্যাটালিয়ন, মানে ৮০০ থেকে এক হাজার, প্যারাট্রুপার পূর্ব-সামরিক কমান্ডের নেতা লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার অধীনে দেওয়া হয়। সাধারণত তিনটি ব্যাটালিয়ন মিলিয়ে একটা ব্রিগেড হয়। এই প্যারা-ব্রিগেডের বাকি অংশ পূর্বাঞ্চলেই রাখার সিদ্ধান্ত হলো। প্রধান সামরিক কার্যালয়ের নির্দেশে সেখানে তাদের রিজার্ভে রাখা হলো, যাতে যখন যেখানে প্রয়োজন নিয়োগ দেওয়া যায়। অক্টোবর অবধি জেনারেল অরোরার পরিকল্পনা মোটের ওপর তৈরি হয়ে গেল। একটা ব্যাটালিয়নে তিনটি বা চারটি কোম্পানি হয়, একেকটা কোম্পানিতে ১৫০ থেকে ৩০০ পর্যন্ত লোক হতে পারে।

২ নম্বর কোরের অধিনায়ক ছিলেন লেফটেনেন্ট জেনারেল টি এন রায়না। কোরে দুই বা তিন ডিভিশনে বিভক্তপ্রায় ৭০ হাজার সৈন্য। ৯ নম্বর ডিভিশনের দায়িত্ব ছিল দক্ষিণ-পশ্চিম দিক, মানে কলকাতার দিক থেকে আক্রমণ করে প্রথমে যশোর দখল করা। এদের সঙ্গে তিনি কিছু প্যারাট্রুপার রাখলেন। উত্তর দিকে থেকে যারা আক্রমণ করবে, বাকি প্যারাট্রুপারদের রাখলেন তাদের সঙ্গে।

সীমানায় ঘোর লড়াই হলো। বিমানবাহিনী থেকে ক্যানবেরা, ন্যাট, হান্টার, সুখয়, মিগ-সবাই সৈন্যবাহিনীকে সাহায্য করল। কিন্তু সুরক্ষিত যশোর শহরে লড়াই হলোই না। একটিও গুলি না চালিয়ে পাকিস্তানিরা যশোর ছেড়ে পিছু হটে গেল। ৭ ডিসেম্বর ভারতীয় সৈন্যরা যশোর দখল করে নিল। পাকিস্তানি সেনারা দুই ভাগ হয়ে এক ভাগ গেল দক্ষিণে খুলনার দিকে, অন্য ভাগ গেল উত্তরে কুষ্টিয়ার দিকে। আমাদের ৪ নম্বর ডিভিশন যশোরের উত্তরে ঝিনাইদহ দখল করল। পাকিস্তানি বাহিনী আরও পিছিয়ে মাগুরা অবধি চলে গেল।

এরপর ঢাকার কাছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বাইরে অন্তরায় হয়ে রইল ব্রহ্মপুত্র। ঠিক হলো, এ বাধা অতিক্রম করার জন্য প্যারাট্রুপার্স ব্যবহার করা হবে। কথা হলো, ২ নম্বর প্যারা-ব্যাটালিয়নকে ১১ ডিসেম্বর বেলা চারটায় টাঙ্গাইলে নামানো হবে।

কেন ১১ তারিখ? কেন বেলা চারটায়? কেন অন্য কোথাও না হয়ে কেন টাঙ্গাইলে? আমাদের পরিকল্পনা ছিল, পশ্চিম, উত্তর-পশ্চিম এবং পূর্ব—এই তিনদিক থেকে এক এক কোর, অর্থাৎ প্রায় ৭০ হাজার সৈন্য নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানকে আক্রমণ করা হবে। এর মধ্যে উত্তরে কামালপুর, জামালপুর, ময়মনসিংহের দিকে সৈন্যসংখ্যা কিছু কম ছিল। তাই ঠিক হলো, ওই দিকে প্যারাট্রুপারদের দেওয়া হবে। মুক্তিবাহিনী খবর দিল, টাঙ্গাইলে সৈন্য নামালে ওখানকার বাসিন্দারা তাদের সাহায্য করবে। তা ছাড়া জামালপুর-ময়মনসিংহ থেকে ঢাকার দিকে যে রাস্তাটি এসেছে, টাঙ্গাইল সেই রাস্তার ওপর। কাজেই ওদিক থেকে পাকিস্তানি সৈন্যরা পিছু হটতে বা ঢাকায় সাহায্য করতে ঢাকার দিকে আসে, তাহলে আমাদের সৈন্যরা সেটা প্রতিরোধ করতে পারবে।

১১ তারিখ কেন? জেনারেল অরোরা অনুমান করেছিলেন, যুদ্ধ আরম্ভ হলে উত্তর সীমান্ত থেকে ওই জায়গা পর্যন্ত পৌঁছাতে আমাদের এক সপ্তাহ লেগে যেতে পারে। কেন বেলা চারটায়? প্রথমে ভাবা হয়েছিল, ঘটনাটা ঘটানো হবে রাতে। কিন্তু পাকিস্তান বিমানবাহিনী পুরোপুরি অক্ষম হয়ে পড়েছিল ব​েল সাবধানতার আর কোনো প্রয়োজন রইল না। আমাদের দেশের পূর্বাঞ্চলে শীতের দিনে বেলা চারটায় সন্ধ্যা নামতে শুরু হয়। সৈন্যরা পৌঁছানোর সময় সামান্য আলো থাকবে। তাতে সুবিধা হবে। তারপর রাতের অন্ধকারে গা-ঢাকা দিয়ে দেবে।

বিষয়টা খুবই গোপন রাখা সম্ভব হয়েছিল। আকস্মিকতার কারণে মানুষ বুঝতেও পারল না, কত লোক নামানো হয়েছে। অনেক সংবাদপত্র, এমন কি বিবিসিও বলল, এক ব্রিগেড, মানে হাজার আড়াই সৈন্য নামানো হয়েছে। আসলে নামানো হয়েছিল এক ব্যাটালিয়ন, অর্থাৎ প্রায় ৮০০ সৈন্য।

এই যৌথ প্রয়াসের ব্যবস্থা নিতে নভেম্বরের গোড়ায় কলকাতায় পূর্বের বিমানবাহিনীর প্রধান কার্যালয়ের অধীনে একটা কার্যালয় স্থাপন করা হলো। এটি যুক্ত রইল দিল্লিতে বিমানবাহিনীর প্রধান কার্যালয়ের পরিবহন বিভাগের সঙ্গে। এএন ১২-এর অভিজ্ঞ পাইলট গ্রুপ ক্যাপ্টেন গুরুদীপ সিং রইলেন এর শীর্ষে। ঠিক হলো, ৫০টা পরিবাহক বিমান-২২টা ডাকোটা, ২০টা প্যাকেট, ৬টা এএন ১২ আর ২টা ক্যারিবু-একসঙ্গে এ কাজটা করবে। কিছু সৈন্য ছিল যারা প্যাকেট থেকে লাফাতে জানে, কিন্তু ডাকোটা থেকে কখনো লাফ দেয়নি। সে কারণে কিছুটা শিক্ষা ও অভ্যাসের ব্যবস্থা করতে হলো।

ডাকোটাগুলো জড়ো হলো (খড়গপুরের কাছে) কলাইকুন্ডায়, প্যাকেটগুলো দমদমে। এএন-১২-এর আস্তানা প্রথমে ছিল চণ্ডীগড়। কিন্তু জায়গাটা পাকিস্তানি সীমানার খুব কাছে। তাদের সরিয়ে দেওয়া হলো উত্তর প্রদেশের গোরখপুরে। আর একটা এএন-১২-এর স্কোয়াড্রন রাখা হলো বেরিলিতে। কীভাবে সেগুলো উড়বে? পাইলটরা বলল, তারা একটা লম্বা বাঁকা লাইনে যেতে চায়। মহড়া চলল। এএন-১২-এর নাগপুরে, প্যাকেটগুলোর এলাহাবাদে ‘ফাফামাউ’য়ে, ডাকোটাগুলোর কলাইকুণ্ডায়।

৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় পূর্ব পাকিস্তানের বিমানবাহিনী যখন আমাদের আক্রমণ করল না, তখন এএন ১২-গুলোর ২৫ নম্বর স্কোয়াড্রনকে এল-৭০ কামানগুলো হাসিমারা থেকে আগ্রায় পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হলো। ১০ ডিসেম্বর দুপুরে হুকুম দেওয়া হলো পরদিন সকালে দমদম পৌঁছানোর। তারা আর প্যাকেটগুলো একত্রে সমবেত হলো। তাদের কী করতে হবে মানচিত্র ও ছবি দিয়ে তা বুঝিয়ে দেওয়া হলো। ১১ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে নয়টায় কলাইকুণ্ডার বিমানঘাঁটিতে ২২টা ডাকোটা রওনা দেওয়ার জন্য সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে গেল। এক ব্যাটালিয়ন, মানে প্রায় ১০০ জন প্যারাট্রুপার ব্রহ্মদেশের আকিয়াবে নিয়ে যাওয়ার জন্য ১৯৪৫-এর ২৯ এপ্রিলে কলাইকুণ্ডায় একইভাবে সারি বেঁধে দাঁড়িয়েছিল ৩৮টা ডাকোটা। সে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কথা।

৬ ডিসেম্বর থেকে পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি বিমানবাহিনীর ওড়া বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরও দমদম থেকে কিছু ‘ন্যাটস’ ডাকোটা বাহিনীর রক্ষক হিসেবে সঙ্গে দেওয়া হলো। কলকাতার বোটানিক্যাল গার্ডেনে প্যারা-ক্যাম্প করা হয়েছিল।

চার রকমের ৫০টা উড়োজাহাজ। গতিবেগ ভিন্ন ভিন্ন। অতি সতর্কতার সঙ্গে হিসাব করা হলো, কে ঠিক কোন মুহূর্তে মাটি ছেড়ে উঠবে, কে কোন দিক দিয়ে যাবে, কতটা উঁচুতে উড়বে। সব বিমান রওনা হওয়ার ২০ মিনিট আগে দুটি পথপ্রদর্শক প্যাকেট রওনা দিল। সৈন্যদের নামার নির্দিষ্ট স্থান ছিল টাঙ্গাইলের মাইল পাঁচেক উত্তর-পূর্বে, জামালপুর-ময়মনসিংহ থেকে আসা রাস্তার ওপর। ৫০ মিনিটে ৫০টি অ্যারোপ্লেন নিজেদের কাজ সুসম্পন্ন করে নিল।

সেদিন জোরে হাওয়া বইছে। প্রথমে পৌঁছাল দুটি ক্যারিবু। তারা নির্দিষ্ট জায়গার একটু দূরে প্রথমে কয়েকটা মানুষের মতো পুতুল ফেলল। তারপর সৈন্যদের সঙ্গে জিনিসপত্র ভালো করে বেঁধে নিয়ে তাদের ফেলা হলো। প্রত্যেকে নিল চার দিনের মতো খাবার। অস্ত্রশস্ত্রসহ একেকজনের বোঝা প্রায় ২৫ কিলোগ্রাম করে। এক-আধটু গন্ডগোল বাদে নামানোর ব্যাপারটা মোটের ওপর নির্বিঘ্নেই সারা গেল। ১৯ জন সৈন্য নামল অন্য সৈন্যদের চেয়ে ১১ মাইল দূরে। বিপক্ষের সঙ্গে কিছুটা লড়াই করে নিজেদের দলের কাছে তাদের আসতে হলো। এসে পৌঁছাতে লাগল এক দিন। একটা প্যাকেট থেকে একটা কামান আর দুটি জিপ চার মাইল দক্ষিণে গিয়ে পড়ল। চারটি জিপ গিয়ে পড়ল একটা পুকুরে। ভাগ্যিস, পুকুরটা গভীর ছিল না। একটা প্যাকেটের ইঞ্জিনে কিছু গোলমাল হলো। জনা চল্লিশেক সৈন্য নিয়ে তাকে দমদম ফিরে যেতে হলো। তাদের আবার পাঠানো হলো পরদিন। একটা এএন-১২-এ নিচে থেকে বিপক্ষের গুলি লাগল। বেশির ভাগ সৈন্য ও যুদ্ধের সরঞ্জাম আড়াই বর্গমাইল জায়গার মধ্যে পড়ল।

জামালপুর থেকে আমাদের যে সৈন্যরা ঢাকার দিকে যাচ্ছিল, তাদের সঙ্গে ওরা মিলিত হলো পরদিন দুপুরবেলা। আমাদের খুব বেশি ক্ষতি হয়নি। কিন্তু এগিয়ে যাওয়ার জন্য গাড়ির মারাত্মক অভাব দেখা দিল। যে যাতে পারল তাতেই চড়ে বসল, এমন কী সাইকেল-রিকশায় পর্যন্ত।

পূর্ব পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের দিন, পূর্ব সীমান্তে আমাদের রক্ষীবাহিনীর তিন অধ্যক্ষের গৌরবের দিন। অনুষ্ঠানে উচ্চপদস্থ সবাই উপস্থিত হলেন। আমাদের পূর্ব এয়ার কমান্ডের অধ্যক্ষ এয়ার মার্শাল দেওয়ান পাকিস্তান বাহিনীর নেতা জেনারেল নিয়াজীকে জিজ্ঞাসা করলেন ‘আপনার হাতে তো লড়াই করার মতো কিছু সৈন্য ছিল। তার পরও আপনারা এত শিগগির হাল ছেড়ে দিলেন কেন?’ গ্রুপ ক্যাপ্টেন চন্দন সিং পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর বুকের ওপর বিমানবাহিনীর চিহ্ন ‘উইংস’ বা ডানার চিহ্ন। সেটার ওপর অঙ্গুলিনির্দেশ করে জেনারেল নিয়াজী বললেন, ‘এদের জন্য। এই বিমানবাহিনীর জন্য গত কয়েকটা দিনরাত কোনো সময়ে কোনো জায়গায় আমি আর আমার অনুচররা চোখের দুই পাতা এক করতে পারিনি। ক্লান্ত হয়ে গেছি। আর যুদ্ধ করতে পারলাম না। তাই আত্মসমর্পণ করতে হলো। আর কোনো গতি রইল না।’

পূর্বাঞ্চলের বিদ্যুৎগতি যুদ্ধের সমাপন হলো। কিন্তু পশ্চিম প্রান্তে তখনো যুদ্ধের আগুন জ্বলছে।

এয়ার চিফ মার্শাল পি সি লালের একজন বৈমানিকের আত্মজীবনী বই থেকে

এয়ার চিফ মার্শাল পি সি লাল: সে সময়ে ভারতীয় বিমান বাহিনীর প্রধান

সূত্র: ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত