বিজ্ঞাপন
default-image

‘মতিউর এল ভৈরব থেকে সন্ধ্যার একটু আগে। শরীর-জামা ভেজা, ট্রাউজারের পেছনে কাদার ছিটে। ভৈরবের প্রতিরোধ বেঙ্গলের সঙ্গে অংশ নেওয়ার পরে ফিরে এসেছে। বিষণ্ন মুখে বলল, কপাল মন্দ। সব তৈরি ছিল অথচ আজকেও ইন্ডিয়া যেতে পারলাম না। যত আগে যেতে পারি এয়ারফোর্স গড়ে তোলা তত তাড়াতাড়ি সম্ভব। আমার কাছে এখন প্রতিটি মিনিট মূল্যবান। আই মাস্ট গো, অ্যাজ আরলি অ্যাজ পসিবল। জলদি ব্যবস্থা করুন। বললাম, যাওয়ার আগে প্রেয়সীর সঙ্গে একবার দেখা করবে না? সে ঢাকায় বসে নিশ্চয়ই কাঁদছে তোমার জন্য।’

‘কাঁদে যদি, কাঁদতে দিন,’ গরম হয়ে উঠল পেশোয়ারি, ‘বলল, ‘সেক্রিফাইস ছাড়া স্বাধীনতা আসবে না’ (‘ফেরারি ডায়েরি থেকে’: আলাউদ্দিন আল আজাদ, বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান স্মারকগ্রন্থ)।

মতিউর রহমানের বিমান ছিনতাইয়ের এক দিন পরের ঘটনা। তাঁর কমান্ডিং অফিসার রান্দাভা এসে খুব গালাগালি করল মতির উদ্দেশে। রাত ১১টায় আবার এল। আমরা গাড়িতে উঠলাম। শহর পেরিয়ে যায়, রাস্তা আর শেষ হয় না। গাড়ি এসে থামল এক বিরাট গেটের সামনে। বাচ্চারা ঘুমিয়ে পড়েছে। ওদের কোলে নিয়ে গাড়ি থেকে নামলাম। তারপর আচ্ছন্ন অবস্থায় রান্দাভার পেছনে হাঁটতে হাঁটতে এক বিরাট তালাবদ্ধ দরজার সামনে এসে দাঁড়ালাম। ভেতরে ঢুকলাম।

আলো জ্বালানোর সঙ্গে সঙ্গে ভয়ে আঁেক উঠি আমি। সারা ঘর-দরজা-জানালা সবকিছুই কালো রং করা। ঘরের মাঝখানে শুধু দুটো দড়ির খাট পাতা। আমি বললাম, এখানে আমি কী করে থাকব? বাচ্চাদের কোথায় শোয়াব? বিছানাপত্র কিছুই তো নেই।

কর্কশ ভাষায় রান্দাভা বলল, তর্ক করবে না, তাহলে এক্ষুনি খাট দুটোও বের করে দেব।

কোনো কথা না বলে তাড়াতাড়ি বাচ্চাদের শক্ত দড়ির খাটের ওপর শুইয়ে দিলাম। বাইরে তালা লাগানোর শব্দ পেলাম। ঘরের দেয়াল ছুঁয়ে ছুঁয়ে হাঁটলাম। ওই শক্ত দড়ির খাটে আমার অবুঝ মেয়ে দুটো ঘুমিয়ে আছে।

বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ শব্দ হচ্ছে। চারদিকে নিস্তব্ধতা ভেঙে ভারী বুটের আওয়জ আসছে। বারান্দায় কোনো গার্ড হাঁটছে, আমাদের পাহারা দিচ্ছে। আমি বাচ্চাদের পাশে গিয়ে বসি। কিছুক্ষণ পর লক্ষ করলাম বাচ্চারা ছটফট করছে। দেখি দড়ির ফাঁকে ফাঁকে ছারপোকা, বাচ্চাদের কামড়াচ্ছে। মারতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু কয়টা মারব।

default-image

ওই ক্যাম্পে আমি বন্দী ছিলাম ২৩ দিনের মতো। সঙ্গে দুই মেয়ে—মাহিন ও তুহিন। মাহিনের বয়স দুই বছর চার মাস। তুহিন আট মাসের। কান্না আসত, কিন্তু কাঁদতে পারতাম না। আমার কান্না দেখলে ওরা আরও বেশি করে চিত্কার করে কাঁদত।

রাতে ছারপোকার কামড়ে মেয়েরা ঘুমাতে পারত না। ঠিকমতো খেতে দিত না। দুই বেলা নানরুটি আর ডাল খেয়ে দুই মেয়ের ফুড পয়জনিংয়ের মতো হয়ে গেল। সারা দিন বমি আর পায়খানা। সারা ঘর একাকার। কাপড় দিয়ে ঘরটা মুছে পরিষ্কার করতাম কোনো রকমে। প্রায়ই বিদ্যুত্ থাকত না। মেয়েরা ভয়ে চিত্কার করে উঠত। মোমবাতি-ম্যাচ কিছুই দেওয়া হতো না। অন্ধকারের মধ্যে হাতড়িয়ে হাতড়িয়ে চলতে হতো। দিনে দিনে মেয়ে দুটো যেন কেমন হয়ে যায়। সাড়া নেই, শব্দ নেই।

মেয়ে দুটোর কাহিল অবস্থা দেখে পাহারারত সৈনিকদের কাছে ওষুধ চাই। ওরা দেয় না। একদিন অনেক অনুরোধের পর এক বোতল লাল ওষুধ দিল। কোনো নাম-দাগ কিছুই নেই। আল্লাহর নাম নিয়ে তাই খাওয়ালাম। ভাবলাম আমাদের সামনে মৃত্যু ছাড়া কিছুই নেই, আর ভয় করে কী হবে।

ওই লাল পানি খাওয়ানোর পর আস্তে আস্তে মেয়ে দুটোর বমি আর পায়খানা বন্ধ হয়।

তার পরও অন্ধকার ঘরে থাকতে থাকতে বাচ্চারা অস্থির হয়ে পড়ে।

মতির সৈনিক বন্ধু বা ঊর্ধ্বতন অনেক কর্মকর্তাকে আমি চিনতাম। কিন্তু জেলে বন্দী হওয়ার পর রান্দাভা ছাড়া যারা আমাকে পাহারা দিত বা রোজ জেরা করত তাদের কাউকে আমি চিনতাম না।

প্রতিদিন ওই অন্ধকার ঘরের পাশের কক্ষে নিয়ে দরজা বন্ধ করে আমাকে জেরা করত। ওই ঘরটিও ছিল সম্পূর্ণ কালো। কেবল দড়ির খাটের বদলে সেখানে ছিল মুখোমুখি দুটো চেয়ার। প্রতিদিন ওই চেয়ারে বসিয়ে আমার কাছে মতি সম্পর্কে সবকিছু জানতে চাইত। বাসায় কে কে আসত, মতি কোথায় যেত, আমাকে কী কী বলত। এসব। দীর্ঘ সময় ধরে আমাকে দেখতে না পেয়ে মেয়ে দুটো কাঁদত। পাশের ঘর থেকে ওদের কান্না শুনে আমি ছটফট করতাম। আমাকে বলত, ওদের কান্না শোনানোর জন্যই আপনাকে এ ঘরে নিয়ে এসেছি। আপনি যত সময় নেবেন, ওরা তত কাঁদবে। সবকিছু বলে ফেলেন, তাহলেই বাচ্চাসহ আপনি ছাড়া পাবেন।

অচেনা এক অফিসার রুদ্রমূর্তি নিয়ে আমাকে বলল, মিসেস মতি, ১৮ থেকে ২০ আগস্ট এই তিন দিনের সব ঘটনা আমাকে খুলে বলুন। আমি তার কথা প্রথমে বুঝতে পারিনি। তাই কোনো উত্তর দিতে পারছিলাম না। লোকটি সঙ্গে সঙ্গে চিত্কার করে বলল, মতি কী কী করত সব বলো, কিছু বাদ দেবে না। আমি মাথা ঠান্ডা রেখে সাধারণ কিছু বিষয় বলেছি। কিন্তু বলিনি শুধু মতির পূর্ব পরিকল্পনার কথা।

বিভিন্নভাবে জেরা করে ওরা আমার মাথা খারাপ করে দিত। একই কথা প্রতিদিন শুনতে চাইত। তারপর বলত, আজ যেভাবে বলছেন গতকাল তো এভাবে বলেননি। তার মানে অনেক কিছু লুকাচ্ছেন। একদিন হঠাত্ বলল, মতি আপনাকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে গেছে এ কথা আগে বলেননি কেন? তারপর এই পাঁচ হাজার টাকার জেরা চলত রোজই।

আমাকে মানসিকভাবে দুর্বল করার জন্য মিথ্যে করে একেক দিন একেক নিকটাত্মীয়ের মৃত্যুর সংবাদ দিত। একদিন বলল, আপনার ভাসুর আলতাফ আমাদের সহযোগিতা করেনি, তাই তাঁকে মেরে ফেলা হয়েছে। সবকিছু বলে দিন, নইলে আপনার অবস্থাও আপনার ভাসুরের মতো হবে।

আরেক দিন বলল, আপনার ছোট যে ভাই দুটি মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে জড়িত ছিল, বাবলু ও নান্টু, তাদেরও মেরে ফেলা হয়েছে। আপনার বাবাকেও মেরে ফেলা হয়েছে। আপনার বাবার বাড়ির কেউ বেঁচে নেই, শ্বশুরবাড়িরও কেউ বেঁচে নেই। এখন আপনি কী করবেন? আর ইচ্ছে করলে আমরাও অনেক কিছুই করতে পারি আপনার সঙ্গে। কেউ বাধা দেবে না। আপনি বোঝেন এসবের মানে কী?

আমি জোর করে নিজেকে বোঝাতাম—এ সবই মিথ্যে। আমাকে মানসিকভাবে দুর্বল করার জন্য এসব বলা হচ্ছে। শেষমেশ এক দিন সাহস করে বলেই ফেললাম—আপনারা বুঝতেই পারছেন আমি কিছুই জানি না। রোজ একই কথা জিজ্ঞেস করে কী লাভ আপনাদের?

সঙ্গে সঙ্গে ওরা বলল, ঠিক আছে, বলতে কষ্ট হলে লিখে দাও—বলে কাগজ-কলম ধরিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমা চেয়ে বললাম, রোজ যেমন বলি আজও তেমনি বলব।

এভাবে কেটেছে কয়েক দিন। তারপর একদিন ছেড়ে দিল।

সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার ছিল, যেখানে আমাকে বন্দী রাখা হয়েছিল, ঠিক মাসখানেক আগে মতি আমাকে সেখানে বেড়াতে এনেছিল। সঙ্গে আমার বোন ও বাচ্চারাও ছিল। দুপুরে ওখানে খেয়েছি, সারা দিন কাটিয়ে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরেছি। এ কারণে বন্দী দিনগুলোতে মনে হতো, এখানে এসে আমি যেন ভেঙে না পড়ি, তার জন্যই মতি আমাকে এই জায়গার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। ও হয়তো ভেবেছিল, বিমান নিয়ে ভারতে চলে গেলে পাকবাহিনী আমাকে নিঃসন্দেহে বন্দী করবে। বন্দী করে এই মালীর ক্যান্টনমেন্টেই আটকে রাখবে।

জেলে বন্দী দিনগুলো আমার জীবনের সবচেয়ে অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে কেটেছে। তবে আমি সাহস হারাইনি; মতিউর যোগ্য ছিল, আমাকেও যোগ্য হতে হবে।

২০০৬ সালে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে, দেশের এমন অস্থির সময়ে খুব বেশি প্রয়োজন দেশপ্রেম। আমি ও খিজির হায়াত খান যৌথভাবে দেশপ্রেমের কাহিনী নিয়ে একটি ছবি বানাচ্ছি। এই ছবিতেও থাকবে মতিউর রহমানের কথা। ছবির নাম অস্তিত্বে আমার দেশ। আগামী ২৬ মার্চ, স্বাধীনতা দিবসে মুক্তি পাবে ছবিটি।

অনুলিখন: আশা নাজনীন