বিজ্ঞাপন
default-image

১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবস উপলক্ষে ঢাকায় আন্তবাহিনীর কুচকাওয়াজ হওয়ার কথা ছিল। আমাকে তার প্যারেড কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ২৬ ফেব্রুয়ারি হঠাত্ খবর পেলাম, ওই প্যারেড বাতিল করা হয়েছে। এতে আমি আশ্চর্য হলাম। ২৮ ফেব্রুয়ারি পশ্চিম পাকিস্তান (বর্তমান পাকিস্তান) থেকে আসা একটি বোয়িং বিমান ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণ করে। তাতে বেসামরিক পোশাকে সেনাবাহিনীর লোকজন ছিল। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ দেওয়ার কথা শুনে পাকিস্তান সেনাবাহিনী উদ্বেগজনক অবস্থায় ছিল। সেদিন পুরো সেনাবাহিনীর লোকজনকে সতর্ক অবস্থায় রাখা হয়েছিল। ২৫ মার্চের ক্র্যাকডাউনের পর আমি নিজেকে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর সদস্য বলে মেনে নিতে পারছিলাম না। এর পর থেকে স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ভারতে যাওয়ার চেষ্টা করতে থাকলাম। ১২ মে আমি ভারতের আগরতলায় যেতে সক্ষম হই। আগরতলা থেকে কলকাতায় যাওয়ার পর আমি কর্নেল ওসমানীর সঙ্গে দেখা করি। পরে আমাকে মুক্তিবাহিনীর উপপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। আমি মূলত মুক্তিবাহিনীর অপারেশনাল কার্যক্রম, রিক্রুট ইত্যাদি কার্যক্রম দেখতাম।

সেই পরিস্থিতিতে তাজউদ্দীন সাহেব আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। আলোচনায় আমি বলেছিলাম, ‘স্যার, যে মানুষটি বা যে যুবকটি এ দেশের জন্য যুদ্ধ করতে চায় তাকে সাহায্য করা উচিত, যাতে সে যুদ্ধ করতে পারে। এটা তো ব্যক্তিগত যুদ্ধ নয়, দলীয় যুদ্ধও নয়। এটা জাতীয় যুদ্ধ।’ তিনি সঙ্গে সঙ্গে এ মত দিয়েছিলেন যে অন্যান্য দল থেকেও ট্রেনিং দেওয়ার জন্য ছাত্র-যুবক নেওয়া হবে। এটা তিনি অনুমোদন করলেন। এটা অনুমোদন করতে গিয়ে তিনি বেশ প্রতিকূলতার মধ্যে পড়েছিলেন। অনেকেই বোধ হয় আপত্তি তুলেছিলেন, তবে তিনি যে মত দিয়েছিলেন সে মতটি পরিবর্তন করেননি। আমার ওপর ট্রেনিংয়ের ভারটা ছিল, তাই আমি নিজে জানি তিনি বিভিন্ন মতের বিরুদ্ধে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

এটা ঠিক, ভারত আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করেছে। কিন্তু যেভাবে বলা হয় যে ভারত স্বাধীন করে দিল, সেই কথাটা আমি সেভাবে স্বীকার করি না। কারণ, এ দেশে ৯৩ হাজার সেনা (পাকিস্তানি সেনাবাহিনী) যেভাবে সম্পূর্ণ আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে গোটা সীমান্তে বাংকার তৈরি করে অবস্থান করেছিল, তাদের এই নয়-দশ দিনের যুদ্ধে পরাজিত করা এত সহজ ছিল না।

এটা সম্ভব হয়েছিল একটি মাত্র কারণে, সেই সময়, অর্থাত্ নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহের পর থেকে যখন রীতিমতো যুদ্ধ শুরু হলো, তখন মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশকে এমন একটা পর্যায়ে এনে ফেলেছিলেন যে পাকিস্তানিদের পক্ষে দিনের বেলাই চলাফেরা করা অসম্ভব ছিল, রাতের বেলা তো অনেক দূরের কথা। যেটাকে বলে ইন্টেলিজেন্স ব্লাইন্ডনেস, অর্থাত্ তাদের কিছুই জানা ছিল না, কোথায় গেলে নিরাপদভাবে যাওয়া যাবে, কোথায় কী আছে, কোথায় কীভাবে যোগাযোগ করা যাবে। যেখানে হয়তো পাঁচজন গেলে চলত, সেখানে তারা হয়তো ৩০ জন চলে যেত। কারণ, সেই ভয়টা তাদের ছিল, যেকোনো দিক থেকে মুক্তিবাহিনী তাদের গুলি করবে। সুতরাং ডিসেম্বরে যে যুদ্ধটি আরম্ভ হলো, তখন একটি ব্যাপার লক্ষ করার মতো ছিল যে যশোর ক্যান্টনমেন্ট ও কুমিল্লায় ঠিক যুদ্ধ হয়নি। এত বড় ক্যান্টনমেন্ট ছিল, কিন্তু তার পরও তারা পালিয়ে বেঁচেছিল। তাদের যুদ্ধ করার মনোবল মুক্তিবাহিনী সম্পূর্ণ ভেঙে দিয়েছিল। কাজেই বলা সম্পূর্ণ অন্যায় যে ভারত বাংলাদেশকে মুক্ত করে দিয়েছে। ভারত নিশ্চয়ই আমাদের সাহায্য করেছিল। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা দেশটাকে পাকিস্তানিদের পরাজয়ের একদম শেষ প্রান্তে নিয়ে এসেছিল—এ কথাটা স্বীকার করতেই হবে। এটাই সত্য ঘটনা। এটা কোনো আবেগের কথা নয়। এটা কোনো কল্পনাপ্রসূত গল্পের কথা নয়। এটাই সত্য, ভারত থেকে আমরা অস্ত্র পাচ্ছিলাম, ভারতেই ট্রেনিং নেওয়া হয়েছিল এবং একই যৌথ কমান্ডের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল।

default-image

মুক্তিযুদ্ধের সময় নারায়ণগঞ্জ তেলের ডিপো এবং চট্টগ্রাম তেলের ডিপোর ওপর যে আক্রমণটি করা হয় তা ভারতীয় বিমানবাহিনী করেনি, সেটা বাংলাদেশ বিমানবাহিনী করেছে, আমরা করেছি। আমরা যে ছোট একটি বিমানবাহিনী করেছিলাম, সেই বিমানবাহিনীই যুদ্ধে প্রথম আক্রমণ করেছিল। এটা মানুষ আজও জানে না। এমনিতে আমাদের বিমানবাহিনী অত্যন্ত ছোট ছিল, শক্তিও খুব কম ছিল; তবু ৩ ডিসেম্বর প্রথম আক্রমণ যেটি হয়, সেটা বাংলাদেশ বিমানবাহিনীই করেছে । আমি যখন সীমান্ত অতিক্রম করে কলকাতায় যাই, তখনই তাজউদ্দীন সাহেবকে বলেছিলাম, যে করেই হোক আমাদের বিমানবাহিনী গড়ে তুলতে হবে।

১৬ই ডিসেম্বর তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ আমাকে ডেকে পাঠালেন। সেখানে তত্কালীন প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী, খোন্দকার মোশতাক সবাই উপস্থিত ছিলেন। আমাকে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য বলা হয়। আমি ভারতীয় সামরিক বাহিনীর হেডকোয়ার্টারের সঙ্গে যোগাযোগ করি। আমাকে দমদম বিমানবন্দরে যেতে বলা হয়। আমি কলকাতার দমদম বিমানবন্দরে গেলাম। সেখানে জেনারেল অরোরা, জেনারেল জ্যাকব এবং ভারতীয় সামরিক বাহিনীর অনেক উচ্চপদস্থ অফিসার ছিলেন। আমরা বাংলাদেশের পথে প্রথমে আগরতলায় এলাম। সেখান থেকে হেলিকপ্টারে ঢাকা রওনা হলাম।

ঢাকা বিমানবন্দরের রানওয়ে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। রাস্তাঘাটে খুব বেশি লোকজন ছিল না। এ অবস্থা আমরা বিমানে বসে লক্ষ করছিলাম। বিমানবন্দরে খুব একটা ভিড় ছিল না। আমরা বিমান থেকে অবতরণ করলাম। জেনারেল নিয়াজি আমাদের সংবর্ধনা জানালেন।

আমরা বিমানবন্দর থেকে সোজা রেসকোর্সের মাঠে গেলাম। সেখানেও আস্তে আস্তে লোকের ভিড় হচ্ছিল। সাতই মার্চ বঙ্গবন্ধু যেখান থেকে ভাষণ দিয়েছিলেন, সেখানে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। জনগণ আনন্দ-উল্লাসে ফেটে পড়েছিল। তারা জেনারেল অরোরাকে কাঁধের ওপর উঠিয়ে নেয় এবং বিজয়োল্লাসে মেতে ওঠে। জেনারেল নিয়াজিকে খুব বিমর্ষ দেখাচ্ছিল।

সংক্ষেপিত

সূত্র: স্বাধীনতা যুুদ্ধের দলিলপত্র

এ কে খন্দকার: পরিকল্পনামন্ত্রী, সাবেক রাষ্ট্রদূত ও বিমানবাহিনীর প্রধান।

আজকের অনুভূতি

এই বৈষম্য আমরা চাইনি

আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম দেশকে স্বাধীন করার জন্য। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত করার উদ্দেশ্য নিয়ে। দেশটি কেমন হবে, তখন হয়তো সে বিষয়ে বিস্তারিত চিন্তা করিনি। আমাদের প্রথম লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে হবে। কেননা আমরা বুঝেছিলাম, পাকিস্তানিদের সঙ্গে থাকা যাবে না। অবশ্য পরে ধীরে ধীরে চিন্তা আসে, স্বাধীন তো হব, তারপর কী হবে। মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ থাকবে না; প্রতিটি নাগরিক রাষ্ট্রের সমান সুযোগ পাবে, সমান অধিকার পাবে, সেটাই মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ছিল। অর্থাত্, একজন ধনী লোকের সন্তান লেখাপড়ায় তেমন ভালো না হয়েও ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়বে, আর একজন গরিব লোকের সন্তান অসাধারণ মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে, এ ধরনের বৈষম্য আমরা চাইনি।

আমরা এমন একটি দেশ চেয়েছিলাম, যেখানে মানুষ দুমুঠো অন্নের জন্য হাহাকার করবে না। এমন ব্যবস্থা থাকবে, যেখানে খেয়েপরে বেঁচে থাকা কঠিন হবে না। সবাই হয়তো প্রচুর সম্পদের মালিক হবে না, কিন্তু খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ন্যূনতম মৌলিক চাহিদাগুলো মেটাতে পারবে। আমরা এমন একটি দেশ চেয়েছিলাম, যেখানে যোগ্যতা, দক্ষতা ও মেধার ভিত্তিতে নিজ নিজ ভাগ্য গড়তে পারবে।

আমাদের অনেক অর্জন আছে। আবার অনেক কিছু অর্জন করতে পারিনি, সে কথাও সত্য। এখন কিন্তু মানুষ দুই বেলা খেতে পারছে। না খেয়ে কেউ মারা গেছে, সে রকম খবর কোথাও দেখিনি। প্রায় সব ছেলেমেয়েই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। যাদের অবস্থা একটু ভালো, তাদের ছেলেমেয়েরা উচ্চশিক্ষা নিচ্ছে। অষ্টম শ্রেণীতে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের সংখ্যা বেশি। তুলনামূলকভাবে কৃষিক্ষেত্রে আমাদের অর্জন অনেক বেশি। ১৯৭১ সালে দারিদ্র্যসীমার নিচের মানুষের সংখ্যা ছিল ৭৫ শতাংশ, বর্তমানে সেটি ৩০ শতাংশে নেমে এসেছে। তখন দারিদ্র্যের মাত্রাও ছিল চরম। এখন অন্তত প্রত্যেকের গায়ে কাপড় ও পায়ে এক জোড়া স্যান্ডেল আছে। আমরা আশা করি, ২০৩০ সালের মধ্যে দরিদ্র অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে পারব। সেই সঙ্গে মানুষে মানুষে বৈষম্যও কমিয়ে আনতে হবে।

সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০১১ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত