বিজ্ঞাপন
default-image

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে এক পরিবারের তিন সহোদরসহ মামাতো ভাইকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে একসাথে হত্যা করে গণকবর দেওয়া হয়। জয়পুরহাট জেলার পাঁচবিবি নওদা (প্রয়াগপুর) গ্রামে একটি পরিবারে বর্বরোচিত এই হত্যাকাণ্ড শুধুজয়পুরহাট নয়, সারাদেশের আলোচিত গণহত্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম। নিরপরাধ মানুষকে নির্বিচারে হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দেন তাঁদের স্বজনেরা।

শহীদ ইউসুফ উদ্দিন সরদারের দ্বিতীয় ছেলে তত্কালীন পাঁচবিবি এলবি হাইস্কুলের কৃতী স্কাউট লিডার বজলার রহমান সরদার বুলু সেই নৃশংস ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ঘটনার দিন ছিল ’৭১ সালের ২৬ মে। বাবা বাড়িতে মিলাদ পড়ানোর জন্য খাসি জবাই করে মাঠে কৃষকদের কাজ তদারক করতে যান। আমিসহ চাচাতো ভাই টুকু, ভাগনে বল্টু খাসির মাংস কাটছিলাম। কে যেন খবর দিল, ৩৫-৪০ জন পাকিস্তানি মিলিটারি আমাদের পাড়া ঘেরাও করেছে। মিলিটারিদের সঙ্গী ছিল পাঁচবিবি বাজারের বিহারি আহম্মদ আনসারী ও কসাই জায়েদ আনসারী। আমি ও টুকু দূর থেকে মিলিটারিদের দেখে প্রাণভয়ে বাড়ির পাশের কবরস্থানের বাঁশঝাড় দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যাই। পালানোর সময় সম্মুখে বেতের ঝাড় লাফ দিয়ে পেরিয়েছিলাম। পিস কমিটির মিটিংয়ের কথা বলে মাঠ থেকে বাবাকে ডেকে মিলিটারিদের কাছে এনেছিল আহম্মদ আনসারী। বাবা বাড়িতে এসে গোসল করে পাঞ্জাবি-পায়জামা, কাবলি জুতা, সাদা মোজা, চশমা পরে চাচা ইলিয়াস উদ্দিন সরদার, ইউনুস উদ্দিন সরদার ও ইদ্রিস উদ্দিন সরদারকে ডেকে নেন। চাচাতো ভাই আবদুল হাই সরদার সেখানে আসেন।

আবদুল হাই সরদারকে মিলিটারিরা যেতে বললে তিনি বাড়ি চলে যান। ছোট চাচা ইদ্রিস সরদার এই ফাঁকে সেখান থেকে সরে পড়েন। তারপর বাড়ির পাশে বাঁশঝাড়ের কবরস্থানে লুকিয়ে থেকে প্রাণে বেঁচে যান। বুলু সরদারের স্ত্রী সাহারা বেগম বলেন, শ্বশুর যাওয়ার আগে অজুর পানি ও খাওয়ার পানি চেয়েছিলেন। আমি অজু করার পানি এনে দিলে তিনি অজু করেন। ডাবের পানি এনে দিলে পানি খেয়ে ছোট ভাইদের নিয়ে মিলিটারিদের সাথে পিস কমিটির সঙ্গে মিটিং করার জন্য পাঁচবিবিতে যান। পরে তাঁরা আর কেউ ফিরে আসেননি। বুলু সরদার বলেন, বাবা-চাচাদের নিয়ে গিয়ে পাঁচবিবি থানায় বন্দী রেখে বাবার মামাতো ভাই আবদুল কাদের মণ্ডলকে (এলাকায় কাদের বক্স নামে পরিচিত) পাঁচবিবির দোকান থেকে ডেকে নেয়। বিকেলে তাঁদের গায়ের গেঞ্জি খুলে চোখ বেঁধে পাঁচবিবি রেলওয়ে স্টেশনের উত্তরে কালী সাহার পুকুরপাড়ে নেওয়া হয়। এরপর তাঁদের হাতে কোদাল দিয়ে গর্ত খুঁড়িয়ে নিয়ে চার ভাইকে একসঙ্গে সেই গর্তের পাশে দাঁড় করিয়ে বিকেল চারটা ২০ মিনিটে এলএমজির ব্রাশফায়ারে হত্যা করে তাঁদের খোঁড়া কবরে মাটিচাপা দেওয়া হয়।

ইউনুস সরদারের একমাত্র মেয়ে শিক্ষয়িত্রী ফজিলাতুননেসা বলেন, আমি সে সময় ভারতে ছিলাম। আমাদের বাড়িতে মুক্তিফৌজ আছে, এ অভিযোগে মিলিটারিরা গ্রাম ঘেরাও করে। মুক্তিফৌজ না পেয়ে পিস কমিটির মিটিংয়ের কথা বলে বাবাসহ জেঠাদের ধরে নিয়ে যায়। ঘটনার দিন ২৬ মে আমার বাবা আমাকে দেওয়ার জন্য জমি থেকে পটল, তরিতরকারি, গরুর দুধ রেখেছিলেন। এমন সময় মিলিটারিরা এসে বলেছিল, আপনারা লুকিয়ে থাকবেন কেন? আমরা শান্তি চাই, এ জন্য মিটিং ডাকা হয়েছে। মিটিংয়ের কথা বলে তাঁদের ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে। ইলিয়াস সরদারের বড় ছেলে মোস্তাফিজুর রহমান রন্টু বলেন, আমার বাবা ছিলেন দিনাজপুরের হাকিমপুর থানার ভেটেরিনারি সার্জন। তিনি সেই সময়ের অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন। আমার জেঠা ইউসুফ উদ্দিন সরদার, চাচা ইউনুস উদ্দীন সরদার ও বাবাকে একসঙ্গে ডেকে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়। সে সময় আমরা তিন ভাই, এক বোন নাবালক ছিলাম। বাবাকে হারিয়ে আমরা এতিম হয়েছি। আমার বাবা-চাচাদের হত্যাকারীরা এখনো বহাল তবিয়তে আছে। আমার বাবা, জেঠা, চাচারা শহীদের মর্যাদা পাননি। কালী সাহার পুকুরপাড়ের বদ্ধভূমিতে কোনো স্মৃতিসৌধ হয়নি।

অনুলিখন: সুজন হাজারী, পাঁচবিবি (জয়পুরহাট)