বিজ্ঞাপন
default-image

একাত্তরের এপ্রিল মাসে নাটোর থেকে ১০-১২ মাইল দূরে কসবা মালঞ্চি গ্রামে পলাতকজীবন যাপন করতে হয়েছিল। আমার বেলায় সেটা স্থায়ী হয়েছিল দিন-পনের। আর আমার পরিবারের বেলায় আরও কিছু দিন। পরিবার বলতে আমার স্ত্রী, দুই ছেলে, বয়স ১৫ ও ১৩ এবং এক মেয়ে (৩)। আমার ছোট ছেলে (১০) ছিল ঢাকায়, কলাবাগানে, তার খালার সঙ্গে, যিনি ছিলেন তার দ্বিতীয় জননী। কসবা মালঞ্চিতে আমরা আশ্রয় নিয়েছিলাম যে বাড়িতে, তাদের সঙ্গে ছিল দূরসম্পর্কের আত্মীয়তা। সে-বাড়ির একটি ছেলে ও দুটি মেয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে।

আমাদের ক্যাম্পাসের বাসায় তাদের যাতায়াত ছিল। সেই ছেলেটি (খাজা) ও তার দুই বোন (লাইলী ও উইলী) সেই দুর্দিনে আমাদের পেয়ে, ওই বিপদের দিনেও একটা আনন্দঘন পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। তাদের মা সম্পর্কে আমার খালা, ছিলেন অত্যন্ত মধুর স্বভাবের এক মহিলা। দূরসম্পর্কের আত্মীয়দের পরমাত্মীয়ের মতো গ্রহণ করেছিলেন। একাত্তরের পাকিস্তানি দখলদারির নয় মাস ছিল সবার জন্য এক আতঙ্ক ও দুর্ভাবনায় ঘেরা সময়। জীবনের নিরাপত্তা বলতে কিছুই ছিল না। রাজশাহী ক্যাম্পাসে পাক মিলিটারি এসে ঘাঁটি গেড়ে বসেছিল। আমরা তাদের সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে ছিলাম। এই দুঃসময়ে কসবা মালঞ্চির কটা দিন এখনো এক সুখস্মৃতি হয়ে আছে।

সারা দেশ যখন মিলিটারির জঙ্গি শাসনে, তখন কেন আমরা অন্য অনেকের মতো সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে যাইনি? আরও দু-চার দিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে থেকে গেলে তা-ই করতাম। কিন্তু আমরা, যারা একটু বেশি ভীতু, তারা আগেই ক্যাম্পাস ছেড়েছিলাম এবং শহর থেকে দূরগ্রামে গেলে বিপদ এড়ানো যাবে, বিপদ কেটে গেলে আবার যে যার জায়গায় ফিরে আসা যাবে, সেটাই ছিল আমাদের হিসাব। রাজশাহী শহর বা শহর উপকণ্ঠের মতিহার ক্যাম্পাস থেকে যাঁরা পালিয়েছিলেন, তাঁরা গ্রামের দিকে ছোটেননি, পদ্মা পার হয়ে ওপারে ভারতে গিয়ে হাঁফ ছেড়েছিলেন। গ্রামে পালানো, আমাদের জন্য সেটা সহজ ছিল না।

আমার স্ত্রী, কসবা মালঞ্চির দিনগুলোতে আমার নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলেন। প্রায়ই নদীর ওপারে চলে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু আমাদের স্বভাবেই আছে এক দুর্মর আশা। বিপদ যতই সত্য হোক না কেন, আমাকে স্পর্শ করবে না। এই আশায় ভর করে আমি দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমাবার চিন্তাকে মনের মধ্যে ঠাঁই দিইনি। জঙ্গি-শাসনের শেষ দিকে বুঝেছি, কী ভয়ানক ঝুঁকি নিয়েছি দেশত্যাগী না হয়ে। কিন্তু তখন কিছু করার ছিল না।

কসবা মালঞ্চি গ্রামটি একটি ইটবিছানো আধপাকা রাস্তা দিয়ে নাটোরের সঙ্গে যুক্ত। এখানেই ছিল বিপদ। পাক মিলিটারির গাড়ি চলে আসতে পারে এই গ্রামে, ওই সড়ক পথে। একবার-দুবারও হতে পারে ঠিক মনে নেই, খবর ছড়িয়ে পড়ে, ওরা আসছে। একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল গ্রামের মধ্যে।

সবাই বাড়ি ছেড়ে গ্রামের বাইরে জঙ্গলের দিকে ছুটল। সেটা এমন কোনো জঙ্গল নয় যে শত্রুর চোখের আড়ালে থাকা যাবে। প্রাণ হাতে করে পালানোর অভিজ্ঞতা লাভ করলাম। জঙ্গলে বেশিক্ষণ থাকতে হয়নি। যখন সবাই টের পেল যে ওটা ছিল একটা গুজব মাত্র, তখনই আবার সবাই ফিরে এল যথাস্থানে।

কসবা মালঞ্চি অজ্ঞাতবাসের এক পর্যায়ে স্থানীয় রেডিওতে শুনলাম, উপাচার্য ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন ডেকেছেন সবাইকে, যাঁরা ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে গিয়েছেন কাজে যোগ দিতে। ইতিমধ্যে অনেকেই ফিরেছেন বলে তিনি দাবি করেছেন। যাঁরা এখনো ফেরেননি, ২৬ এপ্রিলের মধ্যে যেন ফিরে এসে কাজে যোগ দেন। তাহলে তাঁদের বিরুদ্ধে কোনোরূপ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গৃহীত হবে না।

এই ঘোষণায় কতটা আস্থা রাখা যায়, ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। ক্যাম্পাসের পরিস্থিতি কী, সেটা সঠিক জানারও কোনো উপায় ছিল না। রাজশাহী ও নাটোরের মাঝামাঝি অবস্থানে ঝলমলিয়া, যেখানে খাজাদের একটি পরিচিত পরিবার আছে। ওখানে যদি যাই, ক্যাম্পাসের পরিস্থিতি জানতে পারব। কারণ ঝলমলিয়া থেকে প্রতিদিনই কেউ না কেউ রাজশাহী যায় ও ফিরে আসে।

ঝলমলিয়া যাওয়ার ব্যবস্থাও হয়ে গেল—একটা গরুর গাড়ি, সদর রাস্তা এড়িয়ে মেঠোপথে ঝলমলিয়া যাবে। আমার সঙ্গে কিছু টাকা ছিল।

আমি একা সেই গরুর গাড়িতে উঠে বসলাম। আমার পরিবার থেকে গেল কসবা মালঞ্চিতে। ঝলমলিয়ার সেই বাড়িতে যখন পৌঁছলাম তখন বেশ রাত হয়েছে। গৃহকর্তারা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন আমাকে নিয়ে। একেবারেই অপরিচিত পরিবার, আমার জন্য রীতিমতো অস্বস্তিকর এক পরিস্থিতি। একা একটা অনিশ্চিত যাত্রায় এভাবে বেরিয়ে পড়া, এত রাতে এক অজানা জায়গায় গিয়ে ওঠা, এক অচেনা পরিবারের আতিথ্য গ্রহণ, এ এমন এক অভিজ্ঞতা, যা কখনো ভুলব না।

রাত কাটল। সকালে একটা টমটম ভাড়া করে রওনা হলাম রাজশাহীর পথে। রাজশাহী-নাটোর, ওই পথে কতবার আসা-যাওয়া করেছি, পুরো রাস্তাটাই মুখস্থ। কিন্তু এবার এই যাত্রায় মনে হলো, সব বদলে গেছে। রাস্তার দুই পাশে পাক মিলিটারির ধ্বংসকর্ম চোখে পড়ছে। রাস্তায় স্বাভাবিক যান চলাচল নেই। একটি-দুটি টমটম চোখে পড়ে। যাত্রীদের সবার মাথার টুপি বলে দিচ্ছে ওই টুপিই তাদের ভরসা। একটা অদ্ভুত থমথমে ভাব সারা পথে। ক্যাম্পাসে পৌঁছে প্রথমে নিজের বাড়িতে না উঠে উঠলাম প্রতিবেশী ড. লতিফের বাড়িতে। তিনি আমাকে দেখে যেভাবে তাকালেন, বুঝলাম এক ভিন্ন চেহারা নিয়ে আমি ফিরেছি। মুখে বোধ হয় খোঁচা খোঁচা দাড়ি ছিল। চেহারায় আরও কিছু ছিল কি না, কে জানে।

খালি বাড়িতে ঢুকে টের পেলাম, পাক মিলিটারির কোনো অফিসার কিছুদিন আমার অনুপস্থিতিতে আমার আতিথ্য গ্রহণ করেছেন। তার কিছু আলামত বাড়িময় ছড়িয়ে আছে। আমার পড়ার ঘরে বসে তিনি বইপত্র নাড়াচাড়া করেছেন, তবে কিছুই নিয়ে যাননি। যে কাজের ছেলেটিকে রেখে আমরা চলে যাই, সেও নিজের পথ ধরেছিল। ড. লতিফ খুশি হলেন আমাকে দেখে। তিনি বরাবরই ক্যাম্পাসে ছিলেন, তাঁর নিরাপত্তাবোধ এসেছিল একটি বিশেষ কারণে।

যাঁরা গ্রামের দিকে পালিয়েছিলেন, তার মধ্যে আমার বন্ধু ফজলুল হালিম চৌধুরী অনেক দিন ক্যাম্পাসের বাসায় ফেরেনি। গ্রাম থেকে রোজ আসত, বিকেলে আবার গ্রামে ফিরে যেত। মোশাররফ কিছুদিন গ্রামে কাটিয়ে একসময়ে ওপারে চলে যান। গোপনে দেশ ছেড়ে বিদেশে যাওয়ার রোমাঞ্চকর কাহিনী একসময় তিনি আমাকে শুনিয়েছিলেন। সালাহউদ্দীন আহমদ, মুখলেসুর রহমান, কাজী হাসিবুল হোসেন—আমার রাজশাহীজীবনের বন্ধুরা—দেশেই ছিলেন। শেষের জনের স্ত্রী-ভাগ্য এ সময় কাজে দিয়েছিল। স্ত্রী জোন ছিলেন ব্রিটিশ নাগরিক। ব্রিটিশ নাগরিকের স্বামী-পরিচয়ে কাজী হাসিবুল হোসেন, আমাদের হাসিব ভাই সেই দুর্দিনে তুলনামূলকভাবে নিজেকে নিরাপদ মনে করেছেন। একসময় আমি আমার স্ত্রীকে, বন্ধু ফজলুল করিমের সঙ্গে তার গাড়িতে ঢাকা পাঠিয়েছিলাম, ও কয়েক দিনের জন্য হাসিব ভাইয়ের আতিথ্য গ্রহণ করলাম। পরে জেনেছিলাম, আমার কদিনের অনুপস্থিতির খোঁজ রেখেছে ক্যাম্পাসে পাক আর্মির লোকেরা। ক্যাম্পাসের প্রত্যেক বাসিন্দার ওপর ছিল তাদের নজরদারি। রাজশাহীর ডেপুটি কমিশনারকে তারা ক্যাম্পাসেই একটা বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করেছিল। যেহেতু তিনি, রশিদুল হাসান (আমার বন্ধু সাবের রেজা করীমের ছোট ভাই) প্রথমে বর্ডার পেরিয়ে ওপারে, ভারতে চলে যান, পরে আবার ফিরে আসেন।

তাঁর জন্য বিশেষ নিরাপত্তার প্রয়োজন ছিল বোধ হয়। আমাকে বেশ কয়েকবার তাঁর সঙ্গে দেখা করতে হয়েছিল আমাদের আর এক বন্ধু, ড. রকীবের খবর নেওয়ার জন্য। রকীবও রশিদুল হাসানের মতো এপ্রিলের শুরুতে বর্ডার পার হয়ে ওপারে চলে যান ও পরে উপাচার্য ড. সাজ্জাদ হোসায়েনের রেডিও-বার্তা শুনে ফিরে আসেন। ফিরে এসেই বিপদে পড়েন। পাক আর্মি তাঁকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায়। যে সাত দিন তিনি মিলিটারির হাতে ছিলেন, আমরা তাঁকে নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় ছিলাম।

উপাচার্য সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন ক্যাম্পাসের উপাচার্য ভবনে একা থাকতেন, তাঁর স্ত্রী-পরিবার থাকতেন ঢাকায়। ড. হোসায়েনের আনুগত্য অটুট ছিল পাকিস্তানের প্রতি। যত দিন তিনি রাজশাহীতে ছিলেন, খুব মানসিক কষ্টে ছিলেন। তাঁর কষ্টের অবসান হলো যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের শূন্য পদ পূরণ করার জন্য তিনি মনোনীত হলেন। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থাকাকালীন পাক মিলিটারির ক্র্যাকডাউনের অব্যবহিত পূর্বে বিদেশে চলে যান। ক্র্যাকডাউনের পর আর দেশে ফেরেননি। বিলেতে তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সক্রিয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তাঁর অনুপস্থিতিজনিত শূন্যতা পূরণ করা হয় ড. সাজ্জাদ হোসায়েনকে দিয়ে। রাজশাহীতে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হলেন ড. মুহম্মদ আবদুল বারী। ড. বারী প্রমাণ করলেন যে তিনি তাঁর পূর্বসূরির তুলনায় অধিকতর স্বাচ্ছন্দ্যে স্থানীয় সেনা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারেন। ওই কঠিন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দেখভাল করার কাজটি বেশ যোগ্যতার সঙ্গেই করেছিলেন ড. বারী।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর একাত্তরে পাক মিলিটারির আস্থাভাজন হওয়ার মূল্য তাঁকেও দিতে হয়েছিল, তবে চড়ামূল্য দিতে হয়নি। ট্রাইব্যুনাল তাঁকে বেকসুর মুক্তি দিয়েছিল, যেহেতু ট্রাইব্যুনালের প্রশ্নের উত্তরে আমরা সবাই উপাচার্য হিসেবে তাঁর ভূমিকার প্রশংসাই করেছিলাম; তাঁর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ কেউ করেনি। বিপদের ঝড় বয়ে গিয়েছিল ঢাকায় ড. সাজ্জাদ হোসায়েনের ওপর দিয়ে। মুক্তিযোদ্ধারা তাঁকে ধরে নিয়ে যায়, তাঁকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করে, তিনি প্রাণে রক্ষা পান, তবে পঙ্গু হয়ে তাঁকে বাকি জীবন কাটাতে হয়।

মতাদর্শজনিত স্পষ্ট বিরোধ থাকা সত্ত্বেও ড. হোসায়েনের আমার প্রতি স্নেহে বা আস্থায় ঘাটতি দেখা যায়নি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়ে মিলিটারি যে গোপন তদন্ত চালায়, তার আভাস তিনি আমাকে দিয়েছিলেন, ও আমাকে কিছু দিনের জন্য হলেও পশ্চিম পাকিস্তানের নিরাপত্তায় থাকার প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। তিনি চলে যাবেন শুনে আমি তাঁর সহযাত্রী হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করি। উদ্দেশ্য, ঢাকায় মিলিটারির হাতে কারাবন্দী আমার ভগ্নিপতি শাহ মোহাম্মদ ফরিদ কোথায় ও কেমন আছেন, সে সম্বন্ধে খোঁজ নেওয়া। ক্র্যাকডাউনের সময় ফরিদ ছিলেন রাজবাড়ীর এসডিও। একাত্তরের শুরুতে যে অরাজক অবস্থা সৃষ্টি হয়, সে সময় দেশের অনেক জায়গায় বাঙালিদের হাতে বিহারিদের নির্যাতন-হত্যার ঘটনা ঘটেছিল। রাজবাড়ীতে এ ধরনের ঘটনায় এসডিও হিসেবে ফরিদের ভূমিকা পাক মিলিটারি কী দৃষ্টিতে দেখেছিল জানি না, তবে তাঁকে ওরা স্বদায়িত্বে রাখেনি, কারাগারে পাঠিয়ে দেয়। জেল থেকে লেখা ফরিদের একটা চিঠি পাই। ফরিদ মুক্তি পায় ঢাকা শত্রুমুক্ত হওয়ার পর। বন্দী অবস্থায় তাঁর অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি বরাবর কিছু না বলার নীতি কঠোরভাবে পালন করেছেন।

গ্রুপ ক্যাপ্টেন খাদেমুল বাশার তাঁর ক্যান্টনমেন্টের বাসা থেকে নিরুদ্দেশ হওয়ার কারণে মিলিটারি তাঁর ভগ্নিপতি, আমার ছোট ভাই কালামের ওপর ও তাঁর বড় ভাই, ওবায়দুল বাশারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। দুজনেই সে সময় খুলনায় কর্মরত। পলাতক বাশার টেলিফোনে তাঁর বোনকে কিছু বলে যান। তার সূত্র ধরে খুলনায় পলাতকের বড় ভাই ও ভগ্নিপতিকে ওরা বলে—কোথায় পালিয়েছে খাদেমুল বাশার, খুঁজে বের করো। বাশার মুক্তিযুদ্ধে একটি সেক্টরে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর ভাই ও ভগ্নিপতিকে অভিনয় করতে হয়েছিল। সম্ভাব্য সব জায়গায় গিয়ে তাঁর খোঁজ করার। রাজশাহী বাশারের নিজের শহর। ওরা দুজন বাশারের খোঁজে রাজশাহী আসে। কালাম আমার বাসায় ওঠে, বাশারের ভাই ওঠে ওদের নিজেদের বাড়িতে। আমি তখন ফরিদের খোঁজে ঢাকায়। কালাম আমার গাড়ি নিয়ে ক্যাম্পাস থেকে নাটোর রোডে যাওয়ার সময় এক মিলিটারির জিপ গাড়ি ওর গাড়িকে আঘাত করে। ও অল্পের জন্য বেঁচে যায়, কিন্তু আমার গাড়ি ভয়ানক জখম হয়। ঢাকা থেকে ফিরে এসে সব শুনে আমার মনে হলো, গাড়ি গিয়েছে যাক, আমার ভাই যে অক্ষত আছে, সেটাই বড় সৌভাগ্যের কথা।

একাত্তরে মতিহার ক্যাম্পাসের এক দমবন্ধ করা উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তায় কাটাতে হয়েছিল প্রায় আট মাস। যুদ্ধের গতি যতই পাকিস্তানের জন্য প্রতিকূল হয়েছে, ততই পাকিস্তানের অখণ্ডতার পক্ষে শিক্ষিতজনের মত প্রকাশের চাহিদা বাড়তে থাকে। রেডিওতে টক দেওয়ার আমন্ত্রণ বারবার কী কৌশলে এড়িয়ে গেছি, এখন ভাবতে অবাক লাগে।

শহরে একটি জনসভার আয়োজন করা হয়েছিল এবং আমার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন আমার এক সহযোগী আমাকে বোঝাতে চাইলেন, ওই সভায় আমি যেন অবশ্যই যাই ও পাকিস্তানের প্রতি আমার আনুগত্য ঘোষণা করি। না গেলে আমার বিপদ হতে পারে। আমি যাইনি, তিনি ভয়ানক রুষ্ট হলেন। কারণ তাঁর ধারণায় এ এক আত্মঘাতী একগুঁয়েমি। মধ্য ডিসেম্বরে পাকবাহিনীর পলায়ন ও মুক্তিযোদ্ধাদের রাজশাহী প্রবেশের পর আমার ওই সহযোগী বন্ধু আমার বাসাতেই আত্মগোপন করে রইলেন। ভীষণ ভয় পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু কোনো বিপদে পড়তে হয়নি তাঁকে।

রাজশাহী মুক্ত করেছিল মুক্তিবাহিনী, মেজর গিয়াসের নেতৃত্বে। সার্কিট হাউসে তাঁর সঙ্গে দেখা করলাম আমরা তিনজন—প্রফেসর সালাহউদ্দীন আহমদ, ফজলুল হালিম চৌধুরী ও আমি। ক্যাম্পাসের হলগুলো খালি করে চলে গিয়েছে পাকসেনারা। মেজর গিয়াসকে আমরা তাঁর মুক্তিযোদ্ধাদের অস্থায়ী আবাসনের জন্য এই হলগুলোর প্রাপ্যতা জানালাম। তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন, তবে তাঁর মাথায় অন্য রকম চিন্তা ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের হলে আসেননি, হলে ফিরেছিল ছাত্ররাই, যারা মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ক্যাম্পাসে ছিল না।