বিজ্ঞাপন
default-image

গ্রাম থেকে যুদ্ধে গিয়েছিলেন ১৮ জন। বিজয়ের পর একে একে ফিরে এলেন ১৭ জন, একজন ছাড়া। না ফেরা ছেলেটির নাম এসএম খালেকুজ্জামান। খালেক নামেই সবাই চেনে। সে গ্রামের হাই স্কুলের ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র।

খালেকের বাড়িতে কান্না আর থামে না। মায়ের আহাজারি ‘সবাই চলে আইছে, আমার খালেক আইল না। সে নিশ্চয় যুদ্ধে মারা গেছে।’

একদিন খালেকের চাচাত ভাই একটি পত্রিকা আনলেন। পত্রিকায় একটি ছবি দেখিয়ে চাচিকে বললেন, ‘এই দেখ মিয়া ভাই (খালেক) বেঁচে আছেন।’

ছবিতে তিন কিশোর যোদ্ধা—একজন শত্রুর দিকে গ্রেনেড ছুঁড়ছেন, অন্য দুজন রাইফেল হাতে লড়ছেন। ‘ওই তো গ্রেনেড হাতে খালেক।’ দেখে মায়ের মন শান্ত হল।

দুদিন পর বাড়িতে ফিরে এলেন খালেক। পত্রিকায় নিজের ছবি দেখে অবাক তিনি। আরও অবাক হলেন ছবির সহযোদ্ধাদের দেখে। তাঁর পাশে অস্ত্র হাতে যে দুজনকে দেখা যাচ্ছে তাঁরা আর কেউ নন, তারই খেলার সাথী এবং সহযোদ্ধা মো. আবদুল মজিদ ও মো. মজিবর রহমান।

খালেক ছবিটা নিয়ে এক দৌড়ে পৌঁছে গেলেন মজিদ ও মজিবরের কাছে। ছবি দেখে তিনজনের খুশি দেখে কে! রাতারাতি এ খবর প্রচার হয়ে গেল গ্রামে। ছবি দেখতে এলেন মুক্তিযোদ্ধারা। গোটা গ্রাম জেনে গেল তিন কিশোর বীরের বীরত্বের কাহিনী।

দুই.

১৯৯০/৯১ সালের ঘটনা। খালেক তখন চট্টগ্রামের একটি কারখানায় শ্রমিকের কাজ করতেন। কোনো এক বিজয় দিবসে একটি পত্রিকা কিনেছিলেন তিনি। পত্রিকা দেখে তো চোখ ছানাবড়া। প্রথম পৃষ্ঠায় বড় করে ছাপা হয়েছে সেই ছবিটি, কিন্তু তাতে মজিবর নেই। ছবির ওপর বড় হরফে লেখা হয়েছে ‘চুপি চুপি দেশটাকে ভালবেসে যারা দিয়ে গেল প্রাণ।’ খালেক স্ত্রীকে তা দেখালেন। স্ত্রী তো খুশি হলেন না, বরং উল্টো খোঁচা দিলেন, ‘দেশের জন্য যুদ্ধ করেছ, কেউ কখনো খবর নিল না, উল্টো জ্যান্ত মানুষগুলোরে মরা বানিয়ে দিল!’

এরপর খালেক প্রতিবছর ২৬ মার্চ ও ১৬ ডিসেম্বরের পত্রিকা কিনতে লাগলেন। চট্টগ্রাম শহরের দেয়ালে একদিন চোখে পড়ল সেই ছবি দিয়ে ছাপা একটি পোস্টার। এটি প্রকাশ করেছে তথ্য মন্ত্রণালয়ের চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর। তিনি আরও দেখলেন বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অধিদপ্তরের বিশেষ ক্রোড়পত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মাঝখানে তাঁদের সেই ছবি। বিএনপির আমলে জিয়াউর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার পাশে এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমদ ও প্রধান উপদেষ্টা ফখরউদ্দিনের মাঝখানে সেই ছবি। কিন্তু তাঁদের খবর কেউ নেয় না।

এরপর তিন মুক্তিযোদ্ধা প্রশাসনের দুয়ারে ধর্ণা দিতে লাগলেন। সরকারের কাছে বলবেন একটি কথা—তাঁদের ছবি নিয়ে এত কিছু হয় কিন্তু তাঁদের খবর কেউ নেয় না। তাঁরা করুণা চান না, সম্মানটুকু চান।

তথ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু বিদায় হলেন সচিবালয়ের ফটক থেকে। গত নভেম্বরে জাতীয় জাদুঘরে একটি প্রদর্শনীতে সেই ছবিটি ছিল। সেখানে ছুটে গেলেন খালেক। তথ্যমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে সেই ছবিটাকে মক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেরা ছবি হিসেবে বর্ণনা করেন। খালেক তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন, বলতে চাইলেন ‘আমরাই সেই ছবির নায়ক।’ মন্ত্রীর কাছে যাওয়ার ভাগ্য হয় না তাঁর।

শেখ হাসিনার কাছেও একবার গিয়েছিলেন খালেক। তখন তিনি বিরোধীদলীয় নেত্রী। তিনি সেদিন খালেককে পাশে বসিয়ে চা খাইয়ে বলেছিলেন, ‘দেশের ভাগ্য পরিবর্তন হলে আমি আপনাদের দেখব।’ খালেক বলেন, ‘দেশের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়েছে, শেখ হাসিনা এখন প্রধানমন্ত্রী। আমি আর মজিদ তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তিনদিন ঢাকায় থেকেও তাঁর কার্যালয়ে ঢুকতে পারিনি।’

খালেক, মজিদ ও মজিবর মুক্তিযুদ্ধের সাড়া জাগানো সেই ছবির তিন কিশোর যোদ্ধা। বিজয়ের কয়েকদিন আগে ময়মনসিংহের শম্ভুগঞ্জ এলাকার রনাঙ্গণ থেকে ছবিটি তুলেছিলেন আলোকচিত্রী নাইব উদ্দিন আহমেদ।

তিন.

তিন কিশোর যোদ্ধার বাড়ি টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার এলাসিন ইউনিয়নের মুশরিয়া গ্রামে। মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার সময় এসএম খালেকুজ্জামান ও মো. আবদুল মজিদ এলাসিন উচ্চবিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণীতে এবং মো. মজিবর রহমান ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে পড়তেন। স্বাধীনতার পর দারিদ্র্যের কারণে তাঁদের লেখাপড়া বেশিদূর এগোয়নি। খালেক চট্টগ্রামে কারখানায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছেন দীর্ঘদিন। এখন চাকরি করেন কনকর্ড গ্রুপের ফয়’স লেক পার্কে। আর মজিবর ৩৬ বছর ধরে রিকশা চালান টাঙ্গাইল শহর ও গ্রামে। মজিদ রাঙামাটির ১৫ আনসার ব্যাটেলিয়ানে কর্মরত।

৬ ডিসেম্বর খালেক ও মজিদকে সঙ্গে নিয়ে টাঙ্গাইলের মুশরিয়ায় যাই। খবর পেয়ে পরদিন ভোরে মজিদের বাড়িতে ছুটে আসেন মজিবর। যুদ্ধজয়ের স্মৃতিচারণ করেন তিনজন। প্রথমে মজিবর বলেন—একদিন এলাসিন হাটে গেলাম। সেখানে পাকিস্তানি সেনারা এমন দাবড়ানি দিল যে, লোকজন যে যেদিকে পারে প্রাণ নিয়ে ছুটতে লাগল। আমি একটি পুকুরে গিয়ে লুকিয়ে রইলাম। সেদিনই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম মুক্তিযুদ্ধে যাব। হাজার মাইল দূর থেকে এসে ওরা আমাদের দাবড়ানি দেয়! তাদের তাড়াতে হবে।

মজিবর বলেন, ‘পাঁচ ভাই ছিলাম। মা তো যাইবার দিবই না আমারে। তখন মারে বললাম যে, তোমার চাইর ছেলেরে তোমার বুকে দিয়ে গেলাম, আমারে বিদায় দিত অইব।’

default-image

আপনারা কেন গেলেন? মজিদ ও খালেকের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করি। তাঁরা বলেন, ‘আমাদের বিদ্যালয়ের প্রবীণ শিক্ষক যোগীন্দ্রনাথ শীলকে হত্যা করল। ভাবলাম যেভাবে শুরু অইছে, হয়তো ওরা আমাগো মাইরা ফালাই দিব, যদি মুক্তিযুদ্ধে যাই, তাইলে হয়ত দুএকটা মাইরা মরব।’’

মজিদ জানান, ওয়াজেদ মাস্টারের বাড়িতে কাদের সিদ্দিকী এলে তাঁকে তালিকা দেওয়া হয়। সেই মত ৬০ জনের দল নৌকায় করে ভারতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। সিরাজগঞ্জের বাহাদুরাবাদ ঘাটে পাক সেনাদের আক্রমণের মুখে পড়েন তাঁরা। সেখানে কয়েকজন শহীদ হন। অনেকে ফিরে আসেন। পরে কয়েকদিনের চেষ্টায় ২১ জন তিনটি নৌকায় করে ভারতের মাইনকার চরে পৌঁছে যান। গেরিলা প্রশিক্ষণ নেন তুরা ক্যাম্পে। প্রথমে ছিলেন আলফা কোম্পানিতে। পরে ১১ নম্বর সেক্টরের অধীনে যুদ্ধ করেন।

মজিবর চোখ বন্ধ করে আগুনঝরা দিনের স্মৃতিচারণ করেন। প্রথমদিকে তাঁরা গেরিলা যুদ্ধ করেছেন। ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে ১১ নম্বর সেক্টরের অধীনে সম্মুখযুদ্ধ করেন। প্রথম যুদ্ধ হয় সর্চাপুর হাটখোলায়। সেখানে মর্টার শেলের আঘাতে শহীদ হন সাইদ। ভয়ানক যুদ্ধ হয় হালুয়াঘাট, ফুলপুর, গেছুমারা, ময়মনসিংহের শম্ভুগঞ্জ ও টাঙ্গাইলে।

আপনাদের ছবিটা কোথায় তোলা হয়েছিল জানেন? এ প্রশ্নের উত্তরে কথা বলে ওঠেন তিনজনই। শেষে মজিদ বলেন, ‘বিজয়ের তিন-চারদিন আগে ময়মনসিংহের শম্ভুগঞ্জে নদীর পারে পাক হানাদারদের সঙ্গে তুমুল যুদ্ধ হয়। ব্রিটিশ আমলে তৈরি সেতু উড়িয়ে দিই আমরা। একের পর এক গ্রেনেড ছুড়ছি, রাইফেল দিয়ে ফায়ার করে করে শত্রুসেনাদের বাংকারগুলো ধ্বংস করে দিচ্ছিলাম। এ সময় এক লোক ক্যামেরা নিয়ে এলেন। বললেন, যেভাবে আমরা আক্রমণ করি, সেভাবে একটি ছবি তুলবেন। এরপর তিনি আমাদের একটা ছবি তুললেন। কে ছবি নিচ্ছে তা খেয়াল করার সময় কই?’

বিজয়ের পর পত্রিকায় ছবি ছাপা হলো। তখন জানলাম ওই লোকটা সাংবাদিক।

তিন মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের কিছু দুঃখের কথা বলেন। খালেক বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় কোরান ছুঁয়ে শপথ নিয়েছিলাম কখনো অসত্ হব না। সে শপথ রক্ষা করেছি বলে আজ আমাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়। চট্টগ্রামে সড়ক ও জনপথ বিভাগের একখণ্ড জমি পেয়েছিলাম। সেখানে ঘর তুলে ১৫ বছর বাস করি। গত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় সন্ত্রাসীরা বাড়ি গুড়িয়ে দেয়। সেই থেকে পরিবার নিয়ে আমি উদ্বাস্তু।’

মজিবর বলেন, ‘স্বাধীনতার পর সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছিলাম। কিন্তু অর্থাভাবে পড়তে পারিনি। আমার বিশ্বাস ছিল বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকতে চেষ্টা করলে আমার চাকরি হতো। ১৯৭৫ সালের পর কত জায়গায় ঘুরেছি। চাকরি হয়নি। পরে রিকশা ধরলাম, গত ৩৬ বছরে তা আর ছাড়িনি।’

মজিদের বাড়ির পাশে মাটি কেটে সড়ক তৈরি করছিলেন একদল লোক। তিন মুক্তিযোদ্ধা আমাদের সেখানে নিয়ে গেলেন ‘মুক্তিযোদ্ধাদের পরিণতি’ দেখাতে। ষাটোর্ধ্ব এক বৃদ্ধকে দেখিয়ে বলেন, ‘ইনি আবদুল হালিম। আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন। এখন মাটি কেটে সংসার চালান। অথচ তিনি ’৭২ সালে এসএসসি পাস করেছেন।’

কাজের তদারকি করছিলেন এলাসিন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. বেলায়েত হোসেন। তিনি বলেন, ‘হালিম-মজিবরের মত অনেক মুক্তিযোদ্ধা দিনমজুরি করে সংসার চালান। এটা এ জাতির জন্য বিরাট লজ্জা।’

সড়কের পাশেই জয়নাল মুন্সির বাড়ি। অসুস্থ শরীর নিয়ে বেরিয়ে এলেন। হাটখোলার যুদ্ধে শহীদ সাইদের কথা স্মরণ করে কেঁদে ওঠেন। বলেন, ‘ছেলেটা নতুন বিয়ে করেছিল। তিন মাসের বাচ্চাকে বৌয়ের কোলে দিয়ে যুদ্ধে গিয়েছিল। মজিদ-মজিবর ও খালেকও খুব ছোট ছিল। এখন ভাবলে অবাক হই তারা কী বীরত্বই না দেখিয়েছে সেদিন!’

গত ৮-১৩ নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে নাইব উদ্দিন আহমেদের ছবির প্রদর্শনী হয়। সেখানে তিনি বলেন, ‘পাক হানাদাররা বাঙালিদের ওপর এত বর্বরতা দেখিয়েছে যে পরে আমি ছবি তোলার আগ্রহই হারিয়ে ফেলি। তবে আমার জীবনের সেরা ছবির একটি তিন কিশোর যোদ্ধার ছবিটা।’

নাল্লাপাড়া বাজারে কথা হয় মজিদদের সহযোদ্ধা শুকুর মাহমুদ ও ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য আলমগীর হোসেনের সঙ্গে। তাঁরা বলেন, ‘মজিদ, মজিবর ও খালেকের জন্য আমাদের গ্রাম গর্ব করে। কিন্তু মজিবর যখন রিকশা চালায়, তখন বুকটা ফেটে যায়। তার রিকশায় গ্রামের মানুষ উঠতে চান না। তাই সে চুপি চুপি টাঙ্গাইল শহরে চলে যায়। সেখানে রিকশা চালায়।’

সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০০৯ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত