মেহেরপুর জেলার নির্যাতিত এক নারীর সাক্ষ্য
১ এপ্রিল মেহেরপুর মহকুমার পতন ঘটলে আমরা পালিয়ে পিরোজপুরে চলে যাই। কিন্তু সেখানে গিয়ে আমাদের থাকা-খাওয়ার খুব অসুবিধা হতে লাগল। এই অবস্থায় আমরা সাত ভাইবোন এবং আব্বা-আম্মা সবাই বেশ মুশকিলে পড়ে গেলাম। এদিকে পাকসেনারা সীমান্ত এলাকায় চলে আসায় আমরা আর ভারতেও যেতে পারলাম না। তখন বাধ্য হয়ে সেখান থেকে আমরা সবাই মেহেরপুরে আমাদের গ্রামের বাড়িতে ফিরে আসি। বাড়িতে ফিরে আসার পরপরই খান সেনারা আমার আব্বাকে ধরে নিয়ে যায় গুপ্তচরবৃত্তির দায়ে। আমরা সবাই তখন কান্নাকাটি করতে লাগলাম। আব্বাকে থানায় তিন দিন আটক রেখে সেখান থেকে তাকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়ার সংবাদ পেলাম আমরা। কিন্তু আমরা কিছুই করতে পারলাম না।
এরপর সময়টা বর্ষাকাল (মাস-তারিখ আমার মনে নেই)। সেদিন বেলা প্রায় ১২/১টা হবে। এ সময় তিনজন খান সেনা আমাদের বাড়িতে আসে। দুজন খান সেনা আমার আম্মার সঙ্গে কথাবার্তা বলতে থাকে। একজন খান সেনা আমাদের ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ে এবং আমাকে দেখে আমার ওপর রাইফেল ধরে। তখন আমি শঙ্কিত হয়ে পড়লাম। একটু পর মা, ভাইবোনের সামনেই আমার প্রতি সে অশ্লীল আচরণ করতে লাগল। একপর্যায়ে আমাকে সে জড়িয়ে ধরে চুমো খেতে থাকল। আমি তখন তাকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলাম। মা বাধা দিতে গেলে তাকে তারা ভীষণ মারধর করল। তারপর হঠাত্ করে এক খান সেনা আমাকে জোর করে পাশের ঘরে নিয়ে যায়। ওই খান সেনাকে আমি বাবা, ভাইয়া বলে এবং হাত-পা ধরে কিছুতেই নিরস্ত করতে পারলাম না। আমাকে সে অসহ্য যন্ত্রণা দিতে লাগল। আমাকে বস্ত্রহীন করে আমার উপর আধঘণ্টা পাশবিক নির্যাতন চালায়। আমি যন্ত্রণায় যত ছটফট করতে থাকি ওই খান সেনা ততই বেশি বেশি যন্ত্রণা দিতে লাগল। আমি বস্ত্রহীন অবস্থায় বাইরে আসতে পারি না। খান সেনারা চলে যাওয়ার পর মা আমাকে কাপড় পরিয়ে দিলেন। এরপর বেশ কিছুদিন বিশ্রামের পর আবার আমি সুস্থ হয়ে উঠি। এভাবেই আমার জীবনে ঘটে গেল এক কলঙ্কময় ঘটনা।
রাজশাহীর পুঠিয়া থানার নির্যাতিত এক নারীর সাক্ষ্য
২৮ নভেম্বর রাজাকাররা আমাদের বাড়িঘর সব পোড়ায়ে দিছিল। ওরা আমার শ্বশুর-শাশুড়িকে মারধর করল। তারপর আমাদের গোটা বাড়ি আগুন দিয়া পোড়ায় দিল।
আমার এক দেওরকে ধইরা হাত পিঠমোড়া দিয়া বাইন্ধা এমন কইরা মারল যে মাইরতে মাইরতে গোটা পিঠ রক্তারক্তি কইরা দিল। তার ঠ্যাং ভাইঙা দিল। আমার এক ভাসুর পাশেই আলাদা বাড়িতে থাকতেন। সে সময় আমার ভাসুর বাড়িতে ছিলেন। ওরা আমার ভাসুরের বাড়িতে যাইয়া আমার ভাসুরকে ধইরা রাইফেল দিয়া মারতে মারতে গর্ত কইরা তারে জ্যাতাই পুঁইতা রাখল। পুঁইতা রাখার সময় সে কত চিত্কার দিল, যে আমাকে পুঁইতো না, পুঁইতো না। তাও জোর কইরা পুঁইতা দিল। তারপর ওরা সব আমার দুই দেওরকে ধইরা নিয়া চইলা গেল। পরে আমার অন্য দেওররা আর কিছু লোক ভাসুররে গর্ত থেইকা তুইলা আবার ওখানে মাটি দিল। রাজাকাররা আমার দুই দেওরকে নিয়া যাইয়া তাদের কোথায় যে মাইরল, আজ পর্যন্ত আমি তা জানি না। তাদের লাশ পাওয়া দূরে থাক, আমরা তাদের কব্বরও পাইনি। আজ পর্যন্ত তাদের কোনো খোঁজ নাই।
তারপর দিন মনে করেন ২৯ নভেম্বর। সেদিন আমি আমার স্বামীর বাড়ি থেকে চলে যাচ্ছিলাম। তখন লোহার ব্রিজের কাছে রাজাকাররা আমাক ধরছিল। আমি যাচ্ছিলাম ওখান দিয়া। কোলে আমার নয় দিনের বাচ্চা ছিল, বাচ্চাটা মেয়ে ছিল। সেই মেয়েটাকে আমার কাছ থেকে নিয়া ওরা উড়া দিয়ে ফেলে দিল জলার মধ্যে। তারপরে তারা আমাকে ধরে নির্যাতন করতে লাগল। আমি পানি চাইলাম, তারা আমাকে পানি খাইতে দিল না। আমি দৌড় দিয়া নিচে নাইমা হাতে কইরা কাদাজলের পানিই তুইলা খাইলাম। খাওয়ার পর আমাকে রাজাকাররা আবার মারল। তখন আমি অজ্ঞান হইয়া গেছিলাম। পরে আমাকে পাশের বাড়ির একজন আইসে ওখন থাকে নাকি নিয়া যায়। আমি সুস্থ হওয়ার পর গ্রামের কিছু লোক আর শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আইসল। চেয়ারম্যানের নাম আহাদ মোল্লা। আইসা সে আমাকে বলল, কী হয়েছে? আমি বলছি এ রকম, আমাকে রাজাকাররা ধরছিল। তখন উনি তাদেরকে বকা দিল। তারপরে একটা গাড়ি আসল। উনি আমাকে জোর কইরা সেই গাড়িতে তুইলে দিলেন। তুলে দেওয়ার পর আমি চইলা গেলাম আমার মায়ের বাড়ি। ওখানেও হানাদার বাহিনী আসছিল।
তারা আইসে আমাকে পায়নি। আমার চাচা বাড়িতে তালা মাইরা আমাকে বাহির দিয়া পার করে দিছিল, আমি চলে গেছিলাম। তারা আইসা ঘুইরা টুইরা আমাকে খুঁইজা পায়নি, চইলা গেছে।
দিনাজপুর জেলার নবাবগঞ্জ থানার নির্যাতিত দুই নারীর সাক্ষ্য
১.
১৯৭১ সালে দেশে যুদ্ধ লাগছিল। খানেরা তহন আমাদের দেশের অনেক লোক মারছিল।
একদিন ভোরে আইসে চরম আক্রমণ করছিল। তামাম গ্রাম হেরা ঘেরাও করছিল। তামাম গ্রাম ঘেরাও করে ওরা পুরুষ মানুষ কাউক বাঁচাবার দেয় নাই। পুরুষ মানুষ কেউ পলাইতে পারে নাই। সবাক নিয়া যায়া ওরা মাইরে ফেলাইছে।
কাউক ডাক দিয়া নিয়া গেছে, কারু বাড়িতে আগুন লাগায় দিছে, কাউক মাইরে ফেলছে। মাইয়া মাইনষের ইজ্জত মারছে। কোনো অবস্থায় ওদের সাথে পারা যায় না। মোরা যে পাকেই দৌড়ে যাই সেই পাকেই খান, সে পাকেই মেয়ে মাইনষেক ওরা জাবড়ায়ে ধরে, সব পাকেই মেয়ে মাইনষেক ওরা ধরাধরি করছে। কোনো কিছু করি পারা যাই নাই। খানেদের হাতোত থিকা মোরা বাঁচপার পারি নাই কেউ। পুরুষ মানুষ সব ধরি নিয়া যায়া মাইরা ফালাইল। ওই সময় গ্রামে ব্যাটা ছেলে যা আছিল হগলকেই ওরা মাইরে ফালাইছে। খানরা গেছে পর মোরা সবাই দৌড় মাইরে যায়া দেখি পুরুষ মানুষ সবাই মইরা গেছে।
২.
একদিন রাইতের বেলা গ্রামটা খানরা ঘেরাও করছিল। কেউ জানার পারে নাই। ভোর রাতে সবাই জাগি ওঠল। জাইগা দেখে চারপাকে খানরা ঘিরি আছে। যেই পাকে মানুষ যায় সেই পাকেই খান। কোনো পাকেই খালি নাই। সব পাকেই ওরা। কেউ বারাইতে পারে নাই। এতগুলাই আসছিল ওরা। ভোর হইল। তখন ওরা বাড়ি বাড়ি ঢুকল। অর্ধেকগুলা ঘেরাও দিয়া থাকল আর বাকিগুলান বাড়ি বাড়ি ঢুকল। ঢুকে পুরুষ মানুষক ডাকি ডাকি নিয়া গেছে। তাদের নিয়া এক জায়গায় জমা করি মারিছে। পুরুষ মানুষক সব নিয়া গেল। মোরা বাড়িত তো শান্তি পাচ্ছি না। সে সময়ে মনে করেন যে, হামার কিয়ামত আইছিল। কিয়ামতের লাকান। যা দুঃখ হইছে বাবা, সেগুলি বইলি আর কি হবি। পুরুষ মানুষক ধইরা নিয়া গেল। মেয়েছেলের ওপর নির্যাতন করিল। নির্যাতন করে টরে হ্যারা গেছে। পরে ভরভরি শব্দ খালি শুনি। আমরা জানি না, যে মাইরে ফেলাইছে। অত লোক সবাক মারি ফেলাইবে কোনো দিনও ভাবি নাই। একটা লোক আইসে মোক আর কয়জনাক খবর দিল যে, গ্রামের সব লোকরে ওই জায়গায় খানেরা মাইরে ফেলাইছে।
২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি আর্মি আমার স্বামীকে হত্যা করে
কোহিনুর হোসেন
(শহীদ কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের স্ত্রী)
২৫ মার্চ রাতে আমরা আমাদের এলিফ্যান্ট রোডের বাসায় ছিলাম। সেই রাতে পাকবাহিনী আমাদের বাসায় আসে এবং আমার স্বামীকে হত্যা করে। বাড়িতে পাকবাহিনী এসেছে শুনে আমার স্বামী ছুটে যান অন্যদিকে। সেই সময় আমি দোতলার বারান্দায়। তখন আমাদের নিচতলায় আর্মি। ওপরেও কিছু আর্মি উঠে পড়েছে। ওটা তিনতলা বাড়ি ছিল। যারা নিচে ছিল তাদের আর্মি জিজ্ঞাসা করেছে, কমান্ডার মোয়াজ্জেম কই? তো তখন ওরা একটু হেজিটেড করেছে। উনি ওপরে বা উনি বোধহয় বাইরে, এ রকম কিছু একটা তারা বলেছে। তখন ওপরে আরেক দল আর্মি চলে আসে। এসে দরজায় খুব ধাক্কাধাক্কি করছে। এই সময় কে যেন দরজা খুলে দিয়েছে এবং আর্মি ঢুকে পড়ে। আমি তখন একদম শেষের রুমে চলে গিয়েছি অর্থাত্ যেখানে আমার বাচ্চারা ঘুমিয়ে ছিল। আর্মি আসার পর আমার স্বামী ড্রইং রুমের সোফা থেকে যখন উঠে চলে যান তখন আমি ভেবেছি উনি হয়তো দোতলা থেকে লাফিয়ে পালিয়ে চলে গেছেন, অথবা কোথাও লুকিয়েছেন। কিন্তু উনি পালাতে পারেননি। উনি তখন ওদিকে যে সারভেন্টস বাথরুম ছিল তাতে এক পাল্লার দরজা, সেটার দরজা খুলে টেনে দিয়ে ওর পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সেটা অবশ্য আমি দেখিনি, যারা দেখেছে তাদের কাছে পরে আমি শুনেছি।
এদিকে আর্মি তো এসে ওপর-নিচ সব খুঁজছে। আর আমি বোকার মতো খাটের ওপর বসে আছি। তখন আমার কোনো অনুভূতি কাজ করেনি। পাক আর্মি অনেক খোঁজাখুঁজি করে আমি যে রুমে ছিলাম, সেই রুমের দরজায় এসে আমাকে বলছে—কমান্ডার মোয়াজ্জেম কোথায়? তখন আমার ভাগ্নিও আমার কাছে। সে আমার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে ওদের বলল, ওন লোক নিচ মে গেয়া থা। তখন ওরা নিচে গেল এবং একটু পর আবার ঘুরে এল। এর মধ্যে পাক আর্মি আমার ভাগ্নি জামাই এবং ওই বাসার চার-পাঁচজনকে নিচে লাইন করে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। আমার বাসায় আমার স্বামীর দলের, তিনি তখন একটা দল করতেন, যেসব ছেলেপেলে ছিল তারা কিন্তু আগেই লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে এদিক-ওদিক পালিয়েছে। আমাদের বাসার পেছনে একটা স্টুডিও ছিল। কেউ ওদিকে পালিয়েছে। কেউ পাশের আরেকটা বাসার মধ্যে চলে গেছে। এসব পরে শুনেছি। আমাদের বাসার নিচতলায় আমার চাচা শ্বশুরও ছিলেন। ওনাকে আর আমাদের কাজের লোক যারা ছিল, তাদের পাক আর্মি বেশ মারধর করেছে।
আমার হাজব্যান্ড তো তখন লুকিয়ে আছেন আর আমি ভাবছি যে উনি পালিয়ে গেছেন। আসলে আমাদের বেশির ভাগই তখন জানে না যে উনি কোথায়। এই অবস্থায় পাক আর্মি নিচে আমার ভাগ্নি জামাইকেও দাঁড় করিয়েছে। তখন আমার ভাগ্নি এসে আমাকে বারবার বলছে যে খালাম্মা এটা কী হলো। খালাম্মা আমার একি সর্বনাশ করলেন! আমি তখন তাকে বলছি—মারে, তোর এ রকম সর্বনাশ হবে আমি জানতাম নাকি। আমি জানলে নিচেই থাকতাম, উপরে আসতাম না। আমি তো বুঝতে পারিনি কী হতে পারে না-পারে।
এরপর আবার আর্মি এসেছে ওপরে। এসে তারা বলছে, মিসেস মোয়াজ্জেম কাহা? আমি তখন জানালার পাশে খাটের মধ্যে বসা। সেটা শুনে আমি মনে মনে ভাবলাম, সর্বনাশ! ওরা নিশ্চয় ফন্দি করেছে যে কান টানলে মাথা আসবে, মানে আমাকে ধরলে তাঁকে পাওয়া যাবে। তারপর ওরা আবার বলছে, কমান্ডার মোয়াজ্জেম কো বাঙালি বাননেকা শখ থা, উনকো আচ্ছি তারা বাঙালি বানা দেগে। তারা খুবই হিংস্র মুডে এই কথাগুলো বলল। তাদের দেখে আমার মনে হলো, ওরা আমার সমস্ত বুকের রক্ত টেনে খেয়ে ফেলবে। এই সময় ভাগ্নি আবার আমার মুখের দিকে তাকিয়ে। সে ইশারায় আমার কাছে জানতে চাচ্ছে ওদের কাছে সে কী বলবে। তারপর সে কী বুঝল জানি না। আমার ভাগ্নি উর্দুতে বলছে যে আমরা জানি না উনি কোথায়। ওনারা তো নিচে থাকেন। আমি তখন কাঁপছি। ভয়ে আমার তখন মনে হচ্ছে আমি ওদের বলি যে আমিই মিসেস মোয়াজ্জেম। আমার ওপর দিয়ে যা হয় হবে। কিন্তু আমার মুখ দিয়ে কোনো কথাবার্তা বের হলো না।
ইন দ্য মিন টাইম দেখলাম, আর্মি ওপর থেকে নিচে চলে যাচ্ছে। একটু পরে দেখলাম আমার ভাগ্নি জামাই ওপরে আর বাকিদের নিচে লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়েই রেখেছে। ভাগ্নি জামাই শুধু ছাড়া পাওয়া। এদিকে পাক আর্মি যখন বলেছে মিসেস মোয়াজ্জেম কোথায়, তখন উনি মানে আমার স্বামী বোধহয় সে কথা শুনেছেন। উনি তখন বোধহয় ভেবেছেন যে আমার ওপর পাক আর্মি টর্চার করবে বা বেইজ্জতি করবে।
এই অবস্থায় আমার স্বামী বের হয়ে নিচে গিয়ে ওদের কাছে ধরা দেন। ওদের গিয়ে বললেন, আমিই কমান্ডার মোয়াজ্জেম। তখন কিন্তু পাক আর্মি তাঁর কথায় বিশ্বাস করেনি। ওরা ভেবেছে অন্য কেউ কমান্ডার মোয়াজ্জেম সেজে ওদের মিসগাইড করছে। তখন ওনাকে ওরা বলছে—বলো, পাকিস্তান জিন্দাবাদ। উনি তখন বলেছেন—না, আমি পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলব না। তোমরা যা-ই বলো, আমিই কমান্ডার মোয়াজ্জেম। তখন আরও দু-একজন লোক ওখানে ছিল। আমার ভাগ্নি জামাইরা এবং অন্যরা। গিয়ে বলছে যে হ্যাঁ, ইনিই কমান্ডার মোয়াজ্জেম। তখন পাক আর্মি আমার ভাগ্নি জামাই এবং অন্যদের বলছে যে যাও আপনা জান লেকে ভাগো। ওরা ওদের ছেড়ে দিল। ওনাকে আবার তারা বলছে—বলো, পাকিস্তান জিন্দাবাদ। উনি তখন আঙুল উঠায়ে বলছেন—না, বলব না। ওনার দফা ছিল এক দফা। বাংলাদেশ স্বাধীন চাই। আর কোনো দ্বিতীয় দফা নেই। স্বায়ত্তশাসন বা এটা-ওটা না, একেবারে স্বাধীনতা। এরপর উনি বললেন, এক দফা জিন্দাবাদ। তখন ওরা তাকে গুলি করে। গুলি করলে উনি পড়ে যান। তখন পাক আর্মি গালি দিয়ে বলে, শুয়ার কি বাচ্চা, বল পাকিস্তান জিন্দাবাদ। উনি তার পরও আবার শোয়া অবস্থায় বললেন যে এক দফা জিন্দাবাদ। তখন পাক আর্মি আবার তাঁর উপরে গুলি করে।
আমার সামনেই পাকিস্তানি আর্মি আমার ভাইদেরকে হত্যা করলো
রাবেয়া খাতুন
পিতা: মরহুম মোহাম্মদ শামসুদ্দীন
রানী বাজার, বোয়ালিয়া, রাজশাহী
১৪ এপ্রিল ১৯৭১-এ প্রথম একদল পাকসেনা সকাল আটটার দিকে। আমাদের বাড়িতে ঢুকে আমার বড় ভাইয়ের ঘড়ি, রেডিও, টাকা-পয়সা এবং আমাদের আরও কিছু জিনিস লুট করে নিয়ে যায়। তারপর আবার ১০টার দিকে আরেক দল পাকসেনা আসে। ওরা আমাদের বাড়িতে ঢুকে চারজনকে গুলি করে। তাদের তিনজন সঙ্গে সঙ্গেই মারা যায়। আরেকজন গুরুতরভাবে আহত হয়েছিল। বর্তমানে সে পঙ্গু হয়ে বেঁচে আছে।
প্রথম আমাদের সবাইকে তারা ঘর থেকে বের করে আনে। তারপর বলছে, ইন্দুর কাহা হ্যায়। তো আমরা সবাই বলছি কি! এখানে ইন্দুর নাই। ইন্দুর মানে ওরা হিন্দুকে বুঝাচ্ছিল। মানে হিন্দু কোথায় আছে? পাকিস্তানি মিলিটারিদের বোধহয় ধারণা হয়েছিল যে বাংলাদেশে যত লোক আছে সব হিন্দু। এরা কেউ মুসলমান না।
আমাদের রানী বাজারের বাড়িটা ছিল বদরুল আমিনের বাড়ির সামনে। আমাদের বাড়ি মানে আমার বাবার বাড়ি। পাকিস্তানি বাহিনীর দ্বিতীয় দল, এসে বলল, ইন্দুর কাহা হ্যায়। আমরা বললাম, ইন্দুর এখানে কেউ নাই, আমরা সব মুসলমান। সেদিন বাড়িতে আমার দুই ভাই উপস্থিত ছিল। আমার দুই দুলাভাই ছিল। ভাবি ছিল। আমার মা তখন পাকিস্তান আর্মিকে বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে বলছে যে এই দুজন আমার জামাই। আর এই দুজন আমার ছেলে। খান সেনারা আমার আম্মা আর আমার ভাবিকে বলল যে তোমরা ঘরে ঢোকো। তখন আমার আম্মা বিপদ আঁচ করতে পেরে ওদের হাত-পা চেপে ধরে। আম্মা তাদের আবার বলেছে, বাবা এই দুইটা আমার ছেলে আর এই দুইটা আমার জামাই, আমার আর কেউ নাই। তখন ওরা বন্দুকের বাঁট দিয়ে আম্মাকে, আমাকে এবং ভাবিকে ঠেলে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে আমার ভাইদের লক্ষ্য করে গুলি করে। আমরা ঘরের জানালা দিয়ে দেখি যে ওরা সব পড়ে গেল। চারদিকে রক্তে সয়লাব। আম্মা তখন ঘর থেকে বেরিয়ে একটা গ্লাসে পানি নিয়ে গিয়ে ‘লা ইলাহা ...’ কলেমা পড়ে তাদের মুখে পানি দিতে দিতে বলতে লাগল—‘আমার সব শেষ হয়ে গেল রে, আমার সব শেষ হয়ে গেল।’ আমিও তখন তাড়াতাড়ি পানি নিয়ে গেছি।
আমার এক দুলাভাই তখনো ছটফট করছিল। তখন পাকবাহিনীর একজন বলছে, উসকো শুট করো। এ সময় অন্য মিলিটারি বলছে, নো, গুলি মাত করো। এই কথা বলে ওরা সব আমাদের বাড়ি থেকে চলে গেল। তখন আমার দুই ভাইয়ের একজনের বয়স ছিল ৩২/৩৩। আরেকজনের বয়স ৩০ হবে। দুই দুলাভাইয়ের একজনের বয়স ৪০ আরেকজনের বয়স ৩৫ বছরের মতো। পাকবাহিনী দুবার করে গুলি করছিল। আমার বড় ভাইয়ের একটা লেগেছিল পায়ে। পায়ের হাঁটুর কিছু ছিল না। একদম চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছিল। ভাইয়ার পেটেও গুলি লেগেছিল। আর আমার ছোট ভাইটার কানে ও পেটে গুলি করেছিল। দুলাভাইদের একজন ছিল মামাতো দুলাভাই, আরেকজন ভাবির দুলাভাই। ওরা আমাদের বাসায় এসেছিল। ভাবির দুলাভাইকে মেরেছিল দুটা গুলি। তার একটা হাতে লেগেছিল আরেকটা পেটে লেগেছিল। সে তখনো বেঁচে ছিল। আর মামাতো দুলাভাইয়ের পেটে আর পায়ে গুলি লেগেছিল। আমার দুই আপন ভাই এবং মামাতো দুলাভাই সঙ্গে সঙ্গেই মারা গেছে। ভাবির দুলাভাই বেঁচে যান। পনেরো দিন পর অপারেশন করে তার গুলি বের করা হয়। সে বর্তমানে বেঁচে আছে। তবে তার বাম হাতটা পঙ্গু হয়ে গেছে।
আমাদের বাড়ির পাশেই হিন্দু বাড়ি ছিল। মিলিটারিরা আমাদের বাসায় ১৪ তারিখে ঢুকে ওই ঘটনা ঘটালেও পাশের হিন্দু বাড়িতে কিন্তু ওরা ওই দিন ঢোকেনি। মিলিটারিরা ওদের ১৫ তারিখে মেরে ফেলে।
এদিকে দুদিন আমাদের বাড়িতে লাশ পড়ে থাকল। তখন আমাদের বাড়িতে কেউ তো আসে না। পাকবাহিনী নাকি বলেছিল, কেউ যদি কারও বাসায় যায় বা কারও লাশ মাটি-টাটি দেওয়ার ব্যবস্থা করে, তাহলে তাদেরও হত্যা করা হবে। তাই হয়তো ভয়ে কেউ আমাদের বাড়িতে আসেনি। দুই দিন পর আমার আম্মা বলল যে আমি ওদের জন্ম দিয়েছি, কোলে করে মানুষ করেছি। আমি আমার ছেলেদের লাশ কুকুর-শিয়ালকে খাওয়াতে পারি না। আমি নিজেই আমার ছেলেদের লাশ মাটি দেব। তখন আম্মা, আমি আর আমার ভাবি বাড়ির উঠানে মাটি খুঁড়ে আমরাই তিনজনকে কবর দিলাম।
আমাদের সাহায্য করার কেউ ছিল না। লাশ তো আর বেশি দিন ফেলে রাখা যায় না। লাশ তখন ফুলে উঠেছে। আর একদিন গেলেই ফেটে যাবে এমন অবস্থা। তাই আম্মা বলছে যে আমিই ওদের কবর দেব। এই কথা বলে আম্মা বাড়ির উঠানে মাটি খুঁড়তে লাগলেন। আমি আর ভাবিও মাটি খোঁড়ার কাজ শুরু করলাম। আমরা তিনজন মিলে মাটি খুঁড়ে ওদের কবর দিলাম। তাদের কবর আমাদের বাড়িতে এখনো আছে। আমি তখন দশম শ্রেণীর ছাত্রী। বুঝবার মতো বয়স আমার হয়েছিল। আমার সামনেই ওই মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড ঘটে এবং সে দৃশ্য আজও আমি ভুলতে পারি না।
মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্রের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১: নারী বই থেকে নেওয়া
সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০০৮ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত