বিজ্ঞাপন
default-image

লোকটির বয়স ষাটের কাছাকাছি বলেই মনে হয় সাজ্জাদের। গলির মুখে এই রেস্তোরাঁয় বসে লোকটি চায়ে চুমুক দিচ্ছে। সমুখের প্লেটে শিঙাড়া। এখনো শিঙাড়া সে ছোঁয়নি। চায়ে চুমুক দেওয়ার ধরন দেখে মনে হয়, লোকটির কোনো তাড়া নেই। হাতে তার অনেকখানি সময়।

বয়সটা যদি ষাটও হয়, তাহলে একাত্তরে লোকটি ছিল যুবক। একাত্তরের কথা তার স্পষ্ট মনে থাকার কথা। সাজ্জাদ লোকটিকে নিরিখ করে দেখে। আজ দুপুরে তার পত্রিকার সম্পাদক বলেছিল, বিজয় দিবস উপলক্ষে আমরা যে বিশেষ সংখ্যা বের করতে যাচ্ছি, তাতে সাধারণ মানুষের কিছু সাক্ষাত্কার ছাপতে চাই। একাত্তরের স্মৃতিকথা। একাত্তর যেমন তারা দেখেছে, যেমন তাদের মনে আছে।

সাজ্জাদ ভেবেছিল কাজটা সে আগামীকাল শুরু করবে। পথে বেরিয়ে মানুষের ভিড় থেকে কিছু মানুষকে সে পাকড়াও করবে, কথা বলবে তাদের সঙ্গে। এখন বাড়ি ফেরার মুখে রেস্তোরাঁয় এই লোকটিকে দেখে সাজ্জাদের মনে হয়, একে দিয়ে এক্ষুনি সেটা শুরু করা যায়।

রেস্তোরাঁর ভেতর এসে দাঁড়ায় সাজ্জাদ। প্রায় ফাঁকা রেস্তোরাঁ। এতগুলো খালি টেবিল থাকা সত্ত্বেও লোকটির টেবিলে গিয়ে বসতে একটু ইতস্তত করে সে। ফাঁকা টেবিল ফেলে লোকটির টেবিলেই যদি সে বসে যায়, ব্যাপারটা খুব স্বাভাবিক মনে নাও হতে পারে।

লোকটির দিকে বুঝি সে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিল। লোকটি হঠাত্ নড়েচড়ে বসে। চারদিকে তাকায়। ঝপ করে চায়ের কাপে মন দেয়। তারপর চুমুক না দিয়েই চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে শিঙাড়াটা তুলে নেয়। তারপর কামড় দিয়েই গরম শিঙাড়া হঠাত্ ভাপে খপ করে ফেলে দেয় প্লেটে।

সাজ্জাদ তার সমুখে এসে বলে, আপনার এখানে বসি একটু?

লোকটি নড়েচড়ে ওঠে। চারদিকে তাকায়। যেন বা খালি টেবিলগুলো জরিপ করে নেয়। সাজ্জাদের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। যেন বা বুঝে উঠতে চায়, তার টেবিলেই কেন বসতে চায় সে। লোকটি মুখে কিছু বলে না। মাথার অস্পষ্ট একটা ভঙ্গি করে মাত্র। তাতেই যেন বলা হয়ে যায়, টেবিল তো আমার নয়, রেস্তোরাঁর! বসুন। বসবেন না কেন?

সাজ্জাদ চেয়ার টেনে বসে। চা-শিঙাড়ার অর্ডার দিয়ে লোকটিকে বলে, শীত বেশ পড়েছে, না?

শীত? হ্যাঁ, একটু। বলতে বলতে লোকটি জামার ওপর বোতামটি লাগিয়ে নেয়।

সাজ্জাদ আবার বলে, উড়িষ্যার দিকে নিম্নচাপ হয়েছে। ঢাকার আকাশেও মেঘ করেছে। ঝড় হয়তো হবে না। বৃষ্টি হতে পারে। বৃষ্টি হলে শীতটা ঝপ করে চলে আসবে।

লোকটি সিগারেট ধরায়। একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বলে, শীতের কাপড় বাজারে এখনো ভালো করে ওঠেনি।

সাজ্জাদ বলে, হ্যাঁ, দু-এক সপ্তাহের ভেতরই ফুটপাতে সোয়েটার-কম্বলের ভিড় লেগে যাবে।

লোকটি হাত নড়ে বলে, কম্বল তো নেমে গেছে। গুলিস্তানের ফুটপাতে কম্বলের ধুম লেগে গেছে।

এবার সাজ্জাদ আসল দিকে ফেরে। জিজ্ঞেস করে, কী করেন আপনি?

আমি? আমি একটা কলেজে পড়াই।

আমি সাংবাদিক।

ও! লোকটি সম্ভ্রম-মেশানো নতুন চোখে সাজ্জাদকে দেখে। জানতে চায় কোন কাগজ।

কাগজের নাম বলে সাজ্জাদ নিজের নামটিও বলে।

লোকটি বলে, আমার নাম আনোয়ার হোসেন। আমি বাংলা সাহিত্য পড়াই।

লেখার অভ্যেস আছে?

সলজ্জ হয়ে ওঠে লোকটি। প্রবল মাথা নেড়ে বলে, না, না। ওই কলেজে থাকতে দু-একটা কবিতা, মাঝে একবার গল্প লেখারও চেষ্টা করেছিলাম। হয় না। ছেড়ে দিয়েছি। তারপর সংসার। লেখক হওয়া আর হলো না।

লোকটির এই কথা যেন সাজ্জাদের খুব কাছে নিয়ে এল তাকে। সাজ্জাদ ভেবেছিল সাক্ষাত্কারের জন্য লোকটিকে তৈরি করতে বেশ কিছু সময় লেগে যাবে। এখন দেখতে পায়, চমত্কার একটি সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। সেটিকে আরও কিছুটা এগিয়ে নেওয়ার জন্য সাজ্জাদ তার নিজের ব্যর্থতার কথাও বলে।

সাজ্জাদ বলে, আমারও খুব ইচ্ছে ছিল সাহিত্য করি। কবিতা লিখি। উপন্যাসও। আমারও হয়ে উঠল না। শেষে সাংবাদিকতায় ঢুকে পড়লাম।

সিগারেট? আমার একটা সিগারেট নিন।

লোকটির বাড়িয়ে দেওয়া প্যাকেট থেকে সাজ্জাদ একটা সিগারেট তুলে নেয়। লোকটি ধরিয়ে দেয়। আরামের প্রথম ধোঁয়াটি ছেড়ে সাজ্জাদ বলে, বিজয় দিবস আসছে। একাত্তর খুব মনে পড়ছে। আচ্ছা, একাত্তরে আপনি কোথায় ছিলেন? ঢাকায়?

একাত্তরে?

হ্যাঁ, যখন পাকিস্তানি সৈন্যরা আমাদের ওপর গণহত্যা শুরু করল, যখন আমরা মুক্তিযুদ্ধ শুরু করলাম। আপনার মনে আছে নিশ্চয়ই, আপনি তো তখন যুবক।

হ্যাঁ, আমি তখন যুবক। সদ্য পাস করে বেরিয়েছি। মনে থাকবে না কেন? খুব মনে আছে। সব মনে আছে। বলতে বলতে লোকটির বুক থেকে ভারী একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।

এই নিঃশ্বাসটি কৌতূহলী করে তোলে সাজ্জাদকে। একাত্তরে নিশ্চয়ই এই লোকটির এমন কোনো অভিজ্ঞতা হয়েছিল, যার ভেতর আছে রক্ত, চিত্কার, আর্তনাদ।

ঝুঁকে পড়ে সাজ্জাদ জিজ্ঞেস করে, কী মনে আছে আপনার?

লোকটি তত্ক্ষণাত্ কোনো উত্তর করে না।

সাজ্জাদ আবার বলে, আপনি কি তখন ঢাকায় ছিলেন?

লোকটির ঠোঁট কেঁপে ওঠে মাত্র, কিন্তু কোনো কথা উচ্চারিত হয় না।

সাজ্জাদ একটু হেসে বলে, আপনার কী মনে আছে, কতটুকু মনে আছে, একটু বলুন না। আমাদের কাগজ একটা বিশেষ সংখ্যা করছে। সাধারণ মানুষ, সাধারণ নাগরিক, এই আপনাদের স্মৃতিতে একাত্তর, এ নিয়ে আমরা কিছু ছাপতে চাই। অনেক দিন তো আমাদের ভুলিয়ে রাখা হয়েছিল। আর নয়! আপনার নাম-পরিচয় ছবিসমেত সেসব কথা ছাপা হবে। একটু খুলে বলুন না!

আমি! আমি বলব! কী বলব! সবই তো সবাই জানে।

সবাই জানে, আবার জানেও না। ইতিহাস ভুলে থাকাটা জাতির জন্য ভালো নয়। জাতি ছাড়ুন, ব্যক্তিমানুষ, তার বিশেষ স্মৃতি, এর একটা আলাদা ব্যাপার আছে। আমরা যারা এখনো বেঁচে আছি, আমরা যারা একাত্তরের ভেতর দিয়ে গেছি, আমাদের সেই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতারও বড় একটা জায়গা আছে ইতিহাসে। একটা সময় আসবে, যখন আমরা কেউই থাকব না, তখনো একাত্তরের কথা হবে, সেই একাত্তর দেশটির মনে থেকে যাবে, ইতিহাসে থেকে যাবে। ভবিষ্যতের জন্য এই স্মৃতিকথাগুলো খুব জরুরি, আশা করি স্বীকার করবেন।

বলতে বলতে থেমে যায় সাজ্জাদ। থেমে যায়, কারণ, লোকটির মুখে সে লক্ষ করে এক বিপুল শূন্যতা। স্থির চোখে সে তাকিয়ে থাকে লোকটির দিকে, বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনের দিকে, একাত্তরে যে যুবক ছিল, এখন যে ষাটের কাছে, এই মানুষটির দিকে।

আনোয়ার হোসেন ধীরে মাথা নাড়ে। সাজ্জাদের একবার মনে হয়, লোকটি হয়তো কোনো কারণে ভয় পেয়েছে। তাই তাকে অভয় দেওয়ার জন্য বলে, একাত্তরের স্মৃতিকথা তো কেবল মুক্তিযোদ্ধাদের হতে পারে না। আমরা যারা সাধারণ মানুষ ছিলাম, আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধে যাই নাই, আমরা যারা ভারতে রিফিউজি হয়ে চলে যাই নাই, আমরা যারা দেশের ভেতরই থেকে গেছি, আমরা দেখেছি গণহত্যা, দেখেছি পাকিস্তানি সৈন্যদের বর্বর হামলা, অত্যাচার, নিপীড়ন, ধর্ষণ, আগুন, লুটপাট—সেই আমাদের কথাগুলোও ইতিহাসের কাছে দামি। আমাদের কথাগুলো দলিল হয়ে থাকবে ভবিষ্যতের জন্য। বলুন না আপনার কথা। আপনি নিশ্চয়ই এসব দেখেছেন। আমরা প্রত্যেকেই দেখেছি। বলুন।

আনোয়ার হোসেন দ্রুত কয়েকবার মাথা নাড়ে। কিন্তু এখনো কিছু বলে না। সাজ্জাদ অপেক্ষা করে। সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা থেকে সে জানে, অনেক সময় প্রশ্ন না করে নীরবে অপেক্ষা করলেই উত্তরটা একসময় পাওয়া যায়। হলোও তা-ই। লোকটি অনেকক্ষণ পর মৃদু কণ্ঠে বলে, একাত্তরে আমি সেই অর্থে কিছুই দেখি নাই। কিছুই না। লাশের কথা শুনেছি। চোখে দেখি নাই। আগুন লাগাতে দেখি নাই। পোড়া ঘরবাড়ি দেখেছি। অনেকে মুক্তিযোদ্ধাদের দেখেছে বলে শুনি, আমি দেখি নাই।

ঢাকায় ছিলেন?

পঁচিশে মার্চে ছিলাম না। গ্রামে ছিলাম। গ্রামে কিছুই আমরা টের পাই নাই ঢাকায় কী হয়েছে। ওই কয়েকটা দিন আকাশবাণীতে ঢাকার কথা শুনেছি। পাকিস্তানি মিলিটারির কথা শুনেছি। বাঙালি যুদ্ধ করছে শুনি। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন শুনি। চট্টগ্রাম রেডিও থেকে জয় বাংলা গান শুনি। নজরুলের দুর্গম গিরি কান্তার মরু শুনি। ঢাকায় ফেরা যাবে না সবাই বলে, কিন্তু ঢাকায় আমার মা আর ছোট ছোট ভাইবোন। তাদের জন্যে চিন্তা হয়। আল্লাহর নাম নিয়ে ঢাকার দিকে রওনা হই এপ্রিলের সেকেন্ড উইকে।

পথে কিছুই দেখেননি?

কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের ভেতর দিয়ে ঢাকায় ফেরার রাস্তা। ভয়ে ভয়ে পার হই। দারুণ ভয়। কিন্তু আল্লাহর মর্জি কিছুই হয় নাই। দাউদকান্দিতে মিলিটারি আমাদের চেক করে। খুব ভয় পাই। ওরা ছেড়ে দেয়।

লাশ দেখেননি?

না।

আগুন?

না।

কেবল একটা থমথমে ভাব। যেন শ্মশান। শব্দ নাই। মানুষ নাই। পাখিও নাই।

বলতে বলতে আনোয়ার হোসেন হঠাত্ ক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। ক্রোধ আবার কান্নার দমক তার কণ্ঠে। প্রলাপের মতো বলে চলে সে, না, আমি কিছুই দেখি নাই। আমি সেই সৌভাগ্যবানদের একজন, যার একটিও আত্মীয়স্বজন মরে নাই। আমার কেউ মুক্তিযুদ্ধে যায় নাই। সাপ-লুডু খেলা দেখেছেন? খেলেছেন কখনো, সাংবাদিক সাহেব? সাপ-লুডু খেলায় কারও কারও এমন বরাতজোর থাকে যে একবারও সাপে তাকে খায় না। সোজা ঘরে উঠে যায়।

যুক্তিটা কিংবা উপমাটা সাজ্জাদকে চমকে দেয়।

আনোয়ার হোসেন বলে চলে, আমি এমন এক হতভাগা যে নিজের চোখে একাত্তরের কিছুই দেখি নাই। তারপর দেশ যখন মুক্ত হলো, যখন বঙ্গবন্ধু ফিরে এলেন, যখন চারদিকে একাত্তরের কথা সবাই বলছে, গণহত্যার কথা বলছে, মুক্তিযুদ্ধের কথা বলছে, আমার ভেতর একটা অপরাধবোধ ক্রমেই ভারী হয়ে উঠতে শুরু করে। আমার যে ব্যক্তিগত কোনো ক্ষতি হয় নাই, এ যেন আমার সৌভাগ্য নয়, চরম দুর্ভাগ্য। যেন ইতিহাস আমাকে পাশ কাটিয়ে গেছে। সেই শোকের কথাটা এই এতগুলো বছর আমি কারও কাছে মুখফুটে বলতে পারি নাই। পাছে কেউ সন্দেহ করে, আমি পাকিস্তানের দালাল, আমি রাজাকার ছিলাম, শান্তি কমিটির লোক ছিলাম। জানেন, সেদিনের সেই গণহত্যা আর ধর্ষণ আর লুণ্ঠনের কথা, অত্যাচারের কথা যত শুনেছি, তত আমার নিজেকে মনে হয়েছে আমি অভিশপ্ত, আমার ওপর একটা অভিশাপ আছে যে আমি আমাদের দেশের এত বড় একটা ঘটনা থেকে বাইরেই রয়ে গেলাম।

খুব ধীরে সাজ্জাদ এবার বলে, কিন্তু যারা নিহত হয়েছে, যাদের ক্ষতি হয়েছে, যারা যুদ্ধে গেছে, যারা এই দেশটিকে মুক্ত করেছে, তারা আপনার আত্মীয়স্বজন না-ই বা হলো, তারা তো এই দেশেরই মানুষ।

হ্যাঁ।

তারা তো বাইরের কেউ নয়।

না।

আপনি তাদের কথা তো শুনেছেন।

শুনেছি। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে শুনেছি। বিবিসি থেকে শুনেছি।

শুনে আপনার কিছুই মনে হয়নি?

হয়েছে। আমার বুকের ভেতর দলা পাকিয়ে উঠেছে।

আর?

দিনরাত আল্লাহর কাছে মোনাজাত করেছি, এই জল্লাদদের হাত থেকে হে আল্লাহ, তুমি আমাদের উদ্ধার করো।

আর?

রেডিওতে যখন শুনেছি আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধের কথা, আল্লাহর কাছে বলেছি, আল্লাহ, ওদের তুমি বাঁচিয়ে রাখো, ওদের তুমি জয়ী করো।

আর?

আনোয়ার হোসেন গভীর চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে, আর, একদিন, বাড়ির পেছনে বৃষ্টির ভেতর অনেক রাতে ছপ ছপ পায়ের শব্দ শুনতে পেয়েছি।

পায়ের শব্দ?

হ্যাঁ, পায়ের শব্দ।

কার?

পরদিন শুনেছি মুক্তিযোদ্ধা দুটি ছেলে বৃষ্টির ভেতর আশ্রয় নিয়েছিল পেছনের বস্তিতে।

আর?

আর একটা উদ্বেগ। সে কেমন উদ্বেগ, সাংবাদিক সাহেব, আপনাকে বলে বোঝাতে পারব না। উদ্বেগ আর ভীষণ একটা তাড়া। তখন মনে হতো, প্রতিটি মুহূর্তে আমার মনে হতো, এই দেশটি যেন বিপুল বিশাল একটা উদ্বেগ হয়ে থরথর করছে।

আর কিছু?

আর কিছু না। কেবল ওই উদ্বেগ। আর ওই উদ্বেগ আমি আরেকবার দেখেছি আমার ভেতর।

কবে?

বঙ্গবন্ধু যেদিন নিহত হলেন।

সাজ্জাদ সন্তর্পণে জিজ্ঞেস করে, উদ্বেগ মানে কী? ভয়?

সঙ্গে সঙ্গে আনোয়ার হোসেন তীব্র প্রতিবাদ করে ওঠে, না, ভয় না। না, না, না। ভয় কেন? ভয় আর উদ্বেগ তো এক জিনিস না, সাংবাদিক সাহেব।

তবে? উদ্বেগটা কী রকম?

ক্রুদ্ধ কণ্ঠে লোকটি উত্তর দেয়, কী রকম আবার।

আপনি রেগে যাচ্ছেন কেন?

ক্রুদ্ধ কণ্ঠেই লোকটি প্রশ্ন করে, আপনি ভেবেছেন আমার নিজের জীবনের জন্য উদ্বেগের কথা বলছি? মোটেই না। কক্ষণো না। তখন, তখন আমার মনে হতো, সেই একাত্তরে, সেই পঁচাত্তরে, এই দেশটা বুঝি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। এই দেশটার জন্য উদ্বেগ। সবার জন্য উদ্বেগ। সবকিছুর জন্য উদ্বেগ। মুক্তিযোদ্ধারা জিততে পারবে তো?—সেই উদ্বেগ। বঙ্গবন্ধু যে গেলেন, দেশের হাল ধরবে কে—সেই উদ্বেগ। এর বেশি কিছু আপনাকে বলার মতো ভাষা আমার নেই।

সাজ্জাদ লোকটিকে একটি সিগারেট দিয়ে দেশলাই জ্বালায়। সে আলোয় লোকটির মুখ স্পষ্ট হয়ে ওঠে হঠাত্। চোখ দুটিতে অশ্রুই বুঝি চিকচিক করে ওঠে।

লোকটি প্রায় ফিসফিস করে বলে, এত বড় উদ্বেগ আমি আর কখনো জানি নাই। এই উদ্বেগ আমি আর কখনো দেখতে চাই না।

সাজ্জাদ অনেকক্ষণ ধরে দেশলাইয়ের কাঠিটা আগুনসমেত ঘোরায়। ঘোরাতে ঘোরাতে বলে, কে বলে আপনি কিছুই দেখেননি। সাপ-লুডু খেলায় সাপ আপনাকে খায়নি, কিন্তু সাপ যে আপনাকেও খেয়ে ফেলতে পারে, সেই উদ্বেগটাও একটা ঘটনা। খুব বড় একটা ঘটনা। আপনি সেই ঘটনাকে আপনার ভেতর ঘটতে দেখেছেন। এই উদ্বেগটাই ইতিহাসকে চালায়, সব দেশে, যেখানেই মানুষ স্বাধীনতার জন্য, মুক্তির জন্য লড়াই করছে।

বেশ কিছুক্ষণ সাজ্জাদের দিকে তাকিয়ে থেকে লোকটি আঁধারভাঙা জোছনার মতো স্মিত হয়ে ওঠে। পেছনের দীর্ঘদিনের অপরাধবোধ থেকে অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন যেন নির্মল হয়ে বেরিয়ে এসে সাজ্জাদকে বলে, আপনি আরেক পেয়ালা চা খান। আমি খাওয়াচ্ছি।

সূত্র: ১৬ ডিসেম্বর, ২০০৯ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত