পাকিস্তানের মুষ্টিমেয় সহযোগী ছাড়া বাংলাদেশের প্রত্যেক মানুষের জয় হয়েছিল ১৯৭১ সালের ষোলোই ডিসেম্বরে। সে-বিজয় অবশ্য অর্জিত হয়েছিল অশ্রু আর সম্ভ্রম, স্বেদ আর রক্তের বিনিময়ে। ফিরে না-আসা মুক্তিযোদ্ধার জন্যে, হারিয়ে-যাওয়া বুদ্ধিজীবীর জন্যে, সম্ভ্রমহারা নারীর জন্যে সেদিনও মানুষ ক্রন্দন করেছে। পেরেছে কাঁদতে গলা ছেড়ে। প্রায় ন মাস তার কান্নারও অধিকার ছিল না। হর্ষের সঙ্গে হয়তো যোগ হয়েছে বিমর্ষের, তবু এসেছে স্বস্তি, এসেছে মুক্তি—যে-মুক্তির অপেক্ষায় দিনের পর দিন, রাতের পর রাত কেটেছে কত মাস ধরে।
সেই যে জয়ী হয়েছিল মানুষ, পরেও তাকে জয়ী হতে হয়েছে বাধা পেরিয়ে। হার মানেনি বাংলাদেশের মানুষ। ১৯৭৫ সালে শুরু হয়েছিল একাত্তরের ঐক্যে ফাটল ধরা। তারপর, একাত্তরের মতো না হলেও, প্রায় ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল বাংলাদেশের মানুষ ১৯৯০ সালে। স্বৈরাচারের কবল থেকে ফিরিয়ে এনেছিল গণতন্ত্র। গণতন্ত্র আছে বলেই মানুষ নানা দলে-উপদলে ভাগ হয়ে আছে। তবে দেশের ডাক এলে দল–মতনির্বিশেষে, ধর্ম-নৃগোষ্ঠীনির্বিশেষে, নারী-পুরুষনির্বিশেষে একযোগে সাড়া দেবে দেশমাতৃকার সন্তানেরা।
একটু ভেবে দেখলেই বোঝা যাবে, দেশের ডাকে মানুষ অহরহ সাড়া দিচ্ছে। তার জন্যে গগনবিদারী স্লোগানের দরকার হয় না, অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করতে হয় না। যে-যুদ্ধ বাংলাদেশের মানুষ প্রতিনিয়ত করে যাচ্ছে, যে-যুদ্ধে সে অহরহ জয়ী হচ্ছে, তা হলো দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার যুদ্ধ। ১৯৭১ সালে বিজয়ের লগ্নে কোথায় ছিলাম আমরা, আজ কোথায় চলে এসেছি! অহংবোধসম্পন্ন যে সব পণ্ডিত, বাংলাদেশের বিজয়লাভে ক্ষুব্ধ সেসব বিশ্ব-মোড়ল বাংলাদেশের করুণ পরিণামের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, তাঁদের পাণ্ডিত্য ও দর্প চূর্ণ করে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের আদর্শ দৃষ্টান্তরূপে সারা বিশ্বের সম্ভ্রম আদায় করে নিয়েছে। পদ্মা সেতুর বিষয়টা একটা প্রতীকী উদাহরণ। বাংলাদেশের মানুষ আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়েই কৃষি, শিল্প, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যবসা, বাণিজ্য, যোগাযোগ, আবাসন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মতো ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব অর্জনের পরিচয় দিয়েছে। এই আত্মশক্তি সুপ্ত ছিল, সুপ্তই থেকে যেত যদি না আমরা ১৯৭১ সালের ষোলোই ডিসেম্বর ঘটাতে পারতাম।
স্বাধীন হয়েছি বলেই আমাদের অন্তরস্থিত শক্তি বিকাশের সুযোগ পেয়েছে। কবি যে বলেছিলেন, ‘সরল নায়ক আমরা জনতা সেই অনন্য’, বাস্তবে তার পরিচয় পাওয়া গেছে। আমরা ক্ষুধাকে জয় করেছি, দারিদ্র্যকেও জয় করার পথে। অস্বাস্থ্যের বিরুদ্ধে জয়ী হয়েছি বলে আমাদের গড় আয়ু বেড়েছে। আমরা তৈরি পোশাক রপ্তানি করছি—এমনকি খাদ্যও। প্রবাসী জনশক্তি আমাদের অর্থনীতির চাকা নিরন্তর সচল রেখেছে। আমরা কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করেছি, আমাদের ছেলেরা বিদেশে গিয়ে তরুণ বিজ্ঞানীর সম্মান লাভ করছে। আমরা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সাফল্য লাভ করছি, কোন সব অজ পাড়াগাঁ থেকে উঠে এসে আমাদের মেয়েরা বিদেশে গিয়ে ফুটবল খেলছে, ক্রিকেট খেলছে। আমাদের স্থপতিরা একের পর এক আন্তর্জাতিক সম্মান বয়ে আনছে। এমন আরও আছে। আর তা সম্ভবপর হয়েছে আজ থেকে ৪৭ বছর আগের এই দিনটির জন্যে।
নৈরাশ্যবাদীরা আমাদের বিফলতার তালিকাও তৈরি করতে পারেন এবং তার জন্যে কল্পনাশক্তিরও প্রয়োজন হয় না। আমি জোর দেব সাফল্যের দিকে। সেই সঙ্গে বলব, আমাদের আত্মতৃপ্তির সুযোগ নেই। যে-কোনো সংগ্রামী মানবগোষ্ঠীর পক্ষে তার যাত্রাপথের শেষ নেই। আমরা সফল হয়েছি, আরও সাফল্য চাই। একাত্তরের ডিসেম্বরে এসে আমরা বসে থাকিনি। প্রতিদিনই আমাদের যুদ্ধ চলছে। বেঁচে থাকার সংগ্রাম, আরও ভালোভাবে বেঁচে থাকার সংগ্রাম, জীবনের মান ক্রমশ উন্নত করার সংগ্রাম, বিশ্বসভায় মর্যাদার আসন লাভ করার সংগ্রাম—এর সবই আমাদের সামনে আছে। আর এসব সংগ্রামে আমরা জয়ী হব, তাতে আমার কোনো সন্দেহ নেই। দেশের সাধারণ নর-নারী আমাদের অশেষ সম্ভাবনার উৎস। অর্ধশতাব্দীর কম সময়ে একটি বিধ্বস্ত দেশ ও একটি পঙ্গু অর্থনীতিকে আমরা যেভাবে এখানে নিয়ে আসতে পেরেছি, সেখান থেকেই তো ভরসা পাই। গতকাল যা করেছি, আজ যা করছি এবং আগামীকাল যা করতে সমর্থ হব, তা একই সূত্রে গাঁথা। বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছে, তার সুফলও লাভ করেছে। আমাদের অগ্রযাত্রা কেউ থামাতে পারবে না।
আর তার জন্যে বারবার আমরা স্মরণ করব সেই আদি ষোলোই ডিসেম্বরকে।
আনিসুজ্জামান: জাতীয় অধ্যাপক।
সূত্র: ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ সালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত