একাত্তরের এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে ভারতীয় নৌবাহিনীর গোয়েন্দা পরিদপ্তরের পরিচালক ক্যাপ্টেন (পরে রিয়ার অ্যাডমিরাল) মিহির কুমার রায় ফ্রান্স থেকে পালিয়ে আসা আটজন বাঙালি নৌসেনাকে নিউক্লিয়াস ধরে মুক্তিবাহিনীর নৌকমান্ডো দল গঠনের চিন্তা করেন।
পরিকল্পনার শিরোনাম ‘জ্যাকপট—আন্ডারওয়াটার গেরিলা ফোর্স।’ পরিকল্পনায় ছিল—(১) ৬০০ জন বাঙালি তরুণকে নৌকমান্ডো প্রশিক্ষণ দেওয়া, (২) তাদের দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নৌবন্দর, পোতাশ্রয় এবং নৌপথকে অকার্যকর ও অনিরাপদ করে তোলা।
ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এপ্রিল মাসের মধ্যেই মুর্শিদাবাদ–সংলগ্ন ভাগীরথী নদীর পূর্ব তীরে পলাশী গ্রামে নৌকমান্ডোদের প্রশিক্ষণ শিবির স্থাপন করেন।
ক্যাপ্টেন রায় শিবিরের নামকরণ করেন—‘ক্যাম্প ২ পলাশী’ সংক্ষেপে ‘সি২পি’। শিবির স্থাপনের পর নৌবাহিনীর অফিসাররা ফ্রান্স থেকে আসা নৌসেনাদের সহযোগিতায় বিভিন্ন যুব শিবির ঘুরে সম্ভাব্য নৌকমান্ডোদের নির্বাচন শুরু করেন। মে মাসের প্রথম দিকে নৌকমান্ডোদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়।
বাঁশির শব্দে ভোর সাড়ে পাঁচটায় রিক্রুটদের দিন শুরু হতো। সাঁতারের পোশাকে মাঠে এসে জাতীয় সংগীতের সঙ্গে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের পর সকাল ছয়টায় শুরু হতো শরীরচর্চা আর ৫–৬ কিলোমিটার দৌড় অনুশীলন।
এরপর এক ঘণ্টার বিরতি—গোসল ও নাশতার জন্য। আটটার সময় শুরু হতো তাত্ত্বিক শিক্ষা। এ সময় রিক্রুটদের শেখানো হতো নৌকমান্ডোর দায়িত্ব ও কর্তব্য, বিস্ফোরকের ব্যবহার, জাহাজের দুর্বল জায়গা চিহ্নিতকরণ পদ্ধতি ইত্যাদি।
তাত্ত্বিক শিক্ষার পর নৌবাহিনীর ডাইভারদের তত্ত্বাবধানে নদীতে একনাগাড়ে এক ঘণ্টা সাঁতার প্রশিক্ষণ। তারপর মধ্যাহ্নভোজ ও স্বল্পকালীন বিশ্রামের জন্য ৯০ মিনিটের বিরতি।
মধ্যাহ্নভোজ শেষে ক্ষুদ্রাস্ত্র, ফায়ারিং, বিস্ফোরকের ব্যবহার সম্পর্কে সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষকেরা প্রশিক্ষণ দিতেন। এ সময় রিক্রুটদের ক্লোজ কোয়ার্টার কমবেট বা অস্ত্র ছাড়া প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করা এবং শত্রুর আক্রমণ থেকে নিজেকে বাঁচানোর কৌশল শেখানো হতো।
এসব প্রশিক্ষণ শেষে সাড়ে চারটায় রিক্রুটরা ৪৫ মিনিটের জন্য চা-বিরতি পেতেন। তারপর তাঁরা এক ঘণ্টার জন্য এনডুরেন্স সাঁতারের প্রশিক্ষণ নিতেন। দিনের প্রশিক্ষণ শেষ হলে কিছু বিরতির পর শুরু হতো রাতের প্রশিক্ষণ—অন্ধকারের মধ্যে দীর্ঘ দূরত্বের সাঁতার প্রশিক্ষণ।
মে মাসের শেষের দিকে কমান্ডার এম এন আর সামান্ত জ্যাকপট আন্ডারওয়াটার গেরিলা ফোর্সের সার্বিক দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি নৌকমান্ডোদের আসন্ন অভিযানের নামকরণ করেন ‘নেভাল কমান্ডো অপারেশন (এক্স)’, সংক্ষেপে ‘এনসিও (এক্স)’।
জুন মাসের শুরুতে লে. কমান্ডার জর্জ মার্টিস সি২পির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এ সময় রিক্রুটদের উচ্চতর প্রশিক্ষণ শুরু হয়। এর মূল বিষয়গুলো ছিল মানচিত্র পঠন, লক্ষ্যবস্তু চিহ্নিতকরণ, শত্রু এলাকায় অনুপ্রবেশ, প্রস্থান, বেঁচে থাকার পদ্ধতি, ‘লিমপেট মাইন’-এর ব্যবহার ইত্যাদি। ১৯ জুন প্রথম দল সফলতার সঙ্গে নৌকমান্ডো প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করে। পরের দল ১৭ জুন সি২পিতে এসে পৌঁছায়।
১২ জুন ভারতীয় নৌবাহিনীর প্রধান অ্যাডমিরাল নন্দা সি২পি পরিদর্শনে আসেন। তিনি বর্ষার শুরুতে এনসিও (এক্স) কার্যকর করার জন্য কমান্ডার সামান্তকে নির্দেশ দেন। কমান্ডার সামান্ত জুলাই মাসের মাঝামাঝি এনসিও(এক্স)–এর প্রথম অভিযান ‘অপারেশন জ্যাকপট’-এর পরিকল্পনা তৈরি করেন।
তাঁর পরিকল্পনার মূল বিষয়বস্তু ছিল ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ৬টি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যবস্তুতে একসঙ্গে অপারেশন জ্যাকপট পরিচালনা করা। যাতে ১৭৬ জন নৌকমান্ডো অংশ নেবেন। লক্ষ্যবস্তুগুলো ছিল চট্টগ্রাম নৌবন্দর, চাঁদপুর নদী বন্দর, দাউদকান্দি ফেরিঘাট, নারায়ণগঞ্জ নদী বন্দর, মংলা নৌবন্দর ও হিরন পয়েন্ট। অভিযানের জন্য প্রত্যেক নৌকমান্ডোকে একটি লিমপেট মাইন, এক জোড়া অ্যাবি সুইমিং ফিন, একটি চাকু, শুকনা খাবার আর ৫০ টাকা (পাকিস্তানি মুদ্রা) দেওয়া হয়। এ ছাড়া দল অধিনায়ককে একটা রেডিও এবং বিবিধ খরচের জন্য অতিরিক্ত কিছু অর্থ দেওয়া হয়। প্রতিটি গ্রুপকে একটি ৯ মি.মি. স্টার্লিং কারবাইন দেওয়া হয়।
১৫ ও ১৬ আগস্টের অপারেশন জ্যাকপট সফল হলো। ১৭ আগস্টের আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম পাতার সংবাদ শিরোনাম ছিল—‘বাংলাদেশের দরিয়ায় বিস্ফোরণে বিদেশী জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত’। সংবাদে উল্লেখ ছিল, ‘মুক্তিফৌজ জলের তলায় বিস্ফোরণ ঘটানোয় বাংলাদেশের বন্দরে সোমবার সকালে একটি বিদেশী জাহাজ দারুণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জাহাজ থেকে পাঠানো এক জরুরি বেতারবার্তায় (এসওএস) এই খবর পাওয়া গিয়েছে। বেতারবার্তাটি কলকাতায় ধরা পড়ে। সোমালিল্যান্ডের একটি জাহাজ বাংলাদেশের বন্দরে নোঙর করা ছিল।
সেখানে জলের তলে তিনটি বিস্ফোরণ ঘটে। জাহাজ থেকে পাঠানো বার্তায় বলা হয় তার দারুণ ক্ষতি হয়েছে, জাহাজের খোলে জল ঢুকেছে এবং এখন নোঙর ছেঁড়া অবস্থায় নিরুদ্দেশের দিকে ভেসে
অপারেশন জ্যাকপটের সফলতার পর ১৬০ জন নৌকমান্ডো সেপ্টেম্বর মাসে, ২৫০ জন নৌকমান্ডো অক্টোবর মাসে এবং ২৭১ জন নৌকমান্ডো নভেম্বর মাসে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন স্থানে আরও অনেকগুলো অভিযান পরিচালনা করেন। এরপর নৌকমান্ডোরা সেক্টরের পরিকল্পনানুযায়ী অভিযানে অংশ নেন। নৌকমান্ডোরা আগস্ট থেকে ডিসেম্বর মাসের মধ্যে ১৫টি পাকিস্তানি জাহাজ, ১১টি কোস্টার, ৭টি গানবোট, ১১টি বার্জ, ২টি ট্যাংকার আর ১৯টি নৌযান ধ্বংস, আটক, ক্ষতিগ্রস্ত করে বা ডুবিয়ে দেন। এতে তাদের প্রায় এক লাখ টন শিপিং বিনষ্ট হয়।
এনসিও (এক্স) ছিল হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের একটি গোপন যুদ্ধ। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর এটিই ছিল সবচেয়ে বড় নৌ অভিযান। এর মূল পরিকল্পনাকারী অ্যাডমিরাল নন্দা ও ক্যাপ্টেন রায় হলেও এটিকে কার্যকর করেন মুক্তিবাহিনীর ৪৫৭ জন দুঃসাহসী নৌকমান্ডো।
সূত্র: ‘অপারেশন এক্স’। ক্যাপ্টেন এম এন আর সামান্ত ও সন্দীপ উন্নিথান। হারপার কলিন্স পাবলিশার্স, ইন্ডিয়া। ২০১৯।
সূত্র: ১৬ আগস্ট ২০২১ প্রথম আলোর বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত