বিজ্ঞাপন
default-image

কমান্ডার মাহবুব ভাই এই কাজটা আমাকেই কেন দিলেন? এই কাজটা আমি করতে চাই না। এটা একটা করার মতো কাজ হলো! এর চেয়ে যদি বলতেন, ওই যে ওখানে পিঠমোড়া করে বাঁধা আছে সগির রাজাকার, যাও, ফায়ার করো, করতে পারতাম। হাত কাঁপত না। বেয়নেট চার্জ করে মারতে বললে কষ্ট হতো, তবু দেশের শত্রুদের মারতে গিয়ে হাত কাঁপলে তো চলে না। সত্য বটে, দুর্বল চিত্তের ছেলে হিসেবে ছোটবেলা থেকেই আমার দুর্নাম আছে। আমাদের বাড়িতে যখন আমি ছাড়া আর কোনো পুরুষ থাকত না, তখন আম্মারা খুবই মুশকিলে পড়তেন মুরগি জবাই করা নিয়ে। আমার ভাইয়েরা অবলীলায় টিউবওয়েলের পাড়ে দাঁড়িয়ে মুরগি জবাই করতে পারতেন, কিন্তু আমার বেলায় সেটা ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে নিষ্ঠুর কাজ। একটা গলা-কাটা মুরগি যখন রক্তাক্ত শরীর নিয়ে তড়পাতো, আমার নিজের কলজেই তখন যেন ছিঁড়ে যাওয়ার জোগাড়। একবার রংপুর শিশুমঙ্গল হাসপাতালে গিয়ে, আমার ছোটভাই আমিনের জন্মের সময়, একটা পা-কাটাপড়া রোগী দেখে আমি ওখানেই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম।

কাপুরুষতার এত সব উদাহরণ বয়ে বেড়ানো সত্ত্বেও নিতান্ত সময়ের প্রয়োজনে আমি মুক্তিযুদ্ধে এসেছি। আর যুদ্ধটা একটা নেশার মতো। এর ভেতরে ঢুকে গেলে পরিস্থিতিই আপনাকে সাহসী করে তুলবে। যখন ঘাঘট নদীর মরা খালের এপারে-ওপারে যুদ্ধ চলছিল, দুই পক্ষই ফায়ার রেঞ্জের ভেতরে, ওই তো ওপাশে খাকি উর্দি পরা পাকিস্তানি সৈন্যদের দেখা যাচ্ছে, রোদে চিকচিক করছে তাদের হেলমেট, তখনো লক্ষ্যস্থির করে গুলি ছুড়তে আমার হাত কাঁপেনি। মাথার ওপর দিয়ে শিস দিয়ে যায় তপ্ত সিসা, একটুখানি এদিক-ওদিক হলেই জীবনাবসান, মৃত্যু, এখানেই আমাকে পড়ে থাকতে হতে পারে লাশ হয়ে, যুদ্ধের ময়দানে কিন্তু এ কথাটা একটিবারের জন্যও মনে হয় না। অথচ জীবনের চেয়ে মনে হয় মৃত্যুই বড় সত্য এখানে, এখন। তবুও আমরা হাসি, গান গাই, ইয়ার্কি-ফাজলামো করি, রান্নায় লবণ কম হলে পাতে লবণ নিই, খেতে বসে হাতের আঙুল চেটেপুটে খাই। সব ঠিক আছে, কিন্তু এই কাজটা আমি করতে চাই না। মোতালেবের বাবাকে মোতালেবের মৃত্যুর খবরটা পৌঁছে দেওয়া।

মোতালেব শহীদ হয়েছে। সাতগড়া ব্রিজ অপারেশনে গিয়ে। আমরা তাকে শুইয়ে রেখেছি নদীর ধারে। একটা বাঁশবাগানের পাশে। সেও আজ থেকে সপ্তাহ তিনেক আগে। মোতালেবের শাহাদতের খবরটা তার বাড়িতে দেওয়া হয়নি। এই তিন সপ্তাহে আমাদের সে ফুরসত ছিল না।

আজকে ফুরসত মিলেছে। আমরা দেওপাড়ার হাইড আউট থেকে সরে যাচ্ছি বলদিপুকুরের দিকে। পথে, মাইল দুয়েক ঘুর-পথ ধরলেই মোতালেবের বাড়ি। আমাদের দলের ২১ জন যোদ্ধা কমান্ডার মাহবুব ভাইয়ের নেতৃত্বে হাঁটছি। সবার পরনে সাধারণ পোশাক। কেউ লুঙ্গিপরা, কারো পরনে পায়জামা। কারো বা পরনে ট্রাউজার। সবার পিঠে একটা করে ঝোলা। ঝোলার মধ্যে অস্ত্রশস্ত্র, গোলা-বারুদ। বিকেলবেলা রওনা হয়েছি। এখন ভরসন্ধ্যা।

ঝিম ধরে আছে চারপাশটা। সারাটা দিন আজ গরম গেছে। এখন একটু ঠাণ্ডা বাতাস বইতে শুরু করল। মনে হয় কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে। লোকালয়গুলো ফাঁকা ফাঁকা। বাঁশঝাড়ের নিচ দিয়ে মরা পাতা মাড়িয়ে আমরা চলেছি। মচমচ শব্দ হচ্ছে। ঝিঁঝির ডাকের সঙ্গে এই শব্দ মিলে একটা অর্কেস্ট্রা তৈরি হচ্ছে। এই সময় মাহবুব ভাই কাশি দেন। তার মানে তিনি কিছু বলতে চান। আবার কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে বলেন, আনিস।

জি মাহবুব ভাই। আমি তার থেকে একটু পিছিয়ে পড়েছি। জোরে হেঁটে তার কাছাকাছি চলে আসি।

সামনে বৈদ্যর ভিটা থেকে তুমি বামে যাবা।

জি মাহবুব ভাই।

আড়াইঘাটা যাবা।

জি? আমার বুক কেঁপে ওঠে। এই বুঝি মাহবুব ভাই বলেন, আড়াইঘাটায় গিয়ে মোতালেবের বাবার সঙ্গে দেখা করবা। আমি এটা পারব না। অন্য কাউকে বলুন না কেন! আমাকেই কেন এই কঠিন কাজটা করতে হবে।

মাহবুব বলেন, আড়াইঘাটায় গিয়ে মোতালেবের বাবার সঙ্গে দেখা করবা। তোমার সঙ্গে মিজান যাবে।

জি আচ্ছা।

জি আচ্ছা বলেই নিজের ওপরে রাগ লাগে। কী বলতে চাইলাম আর কী বললাম।

মোতালেবের বাড়িতে যেতে আমাকেই কেন বাছা হচ্ছে, তা অনুমান করতে কষ্ট হয় না। মোতালেব আর আমি একই স্কুলের ছাত্র ছিলাম। ও আমার দুই ক্লাস জুনিয়র। ওর বাবা ওই স্কুলেরই হেড মাওলানা। হেড মাওলানা কথাটাও কথার কথা। কারণ আমাদের গোপাললাল (জিএল) বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ে আমরা চিরকাল একজন মাওলানাই দেখে এসেছি। কিন্তু তবু মোতালেবকে জিজ্ঞেস করলে মোতালেব বলত, আমার বাবা হেড মাওলানা।

মোতালেবকে আমরা আড়ালে ডাকতাম মাউরা বলে। মাউরা মানে যার মা নাই। আমরা ছড়া কাটতাম, মা নাই তুই মাউরা, বাপ নাই তো বাউরা, দুইটা বাপ তো জাউরা। আমাদের জানা ছিল, মোতালেবের জন্মের সময় ওর মা মারা যান। তবে তাকে ঘিরে আরেকটা রহস্যময় কৌতূহল আমাদের মনে ছিল। মোতালেব নাকি ওর ফুপুর দুধ খেয়ে বড় হয়েছে। আসলে দুগ্ধপোষ্য শিশুকে নিয়ে তার বাবা আবদুল গনি মুশকিলে পড়েছিলেন। তিনি তার ছেলেকে তার বোনের হাওলায় অর্পণ করেন। সেই থেকে মোতালেব তার ফুপুকেই মা ডেকে এসেছে। মোতালেবের দাদা তখন বেঁচে। বিধবা ফুপু আড়াইঘাটায় পিত্রালয়েই থাকতেন। মোতালেবের দাদা বহু চেষ্টা করেন তার বিপত্নীক ছেলে আবদুল গনিকে আরেকবার বিয়ে করাতে। কিন্তু আবদুল গনি রাজি হন না। তাকে বৈরাগ্যে পেয়ে বসে। কিছু দিন দরওয়ানির পীর সাহেবের কাছে গিয়ে বসে থাকতেন। তার মুরিদানা গ্রহণ করেন। পরে স্ত্রী বিয়োগের শোক খানিকটা মন্দীভূত হলে তিনি সংসারে ফিরে আসেন। জিএল স্কুলের মাওলানার চাকরি গ্রহণ করেন। আর বলে বেড়ান, এই জীবনে আর কিছু চাই না, মোতালেবটা মানুষ হলেই হয়। আমরা মোতালেবের জীবনের এই করুণ দিকটাকে সহমর্মিতার সঙ্গে বিচার করতাম না। ছোটরা খুব নিষ্ঠুর ধরনের হয়। আমরাও ছোটবেলায় মোতালেবের সঙ্গে নানা ধরনের নিষ্ঠুর কৌতুক করতাম।

আমরা শুনেছি, ক্লাস থ্রি পর্যন্ত মোতালেব স্কুলে আসত তার বাবার কাঁধে চড়ে। আমি গোপাললাল স্কুলে ভর্তি হই ক্লাস সিক্সে। তারপর থেকে দেখতাম মোতালেব তার বাবার সাইকেলের সামনে বসে স্কুলে আসে। হেড মাওলানা স্যারের বয়স আসলে কত, তা বোঝা না গেলেও দাড়ির কারণে আমাদের কাছে তাকে বুড়া বলে মনে হতো। আমরা মোতালেবকে খেপাতাম, কী রে মোতালেব, তুই তোর বুড়া বাপের ঘাড়ে চড়ি স্কুলে আসিস ক্যান?

মোতালেব রেগে যেত। ঘাড়ে চড়ি ক্যান আসব, বাবার সাইকেল আছে না?

বুড়া মানষে সাইকেল চালায় আর তুই চ্যাংড়া মানুষ তার সামনে বসিস! তুই সাইকেল চালাবার পারিস না। তোর বাপক সামনে বসায়া নিয়া আসবু।

কেউ একজন ফোড়ং কাটে।

ছেলেদের সঙ্গে মোতালেব কোনো দিনও পেরে উঠত না। সে তখন হেড স্যারের কাছে নালিশ করার হুমকি দিত। আমরা সটকে পড়তাম। গোপাললাল স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন খুবই কড়া মানুষ। তার একটা সেঙ্শাল বেত ছিল। হবিবর পিয়ন রোজ বুধবারে সেই বেতটায় সর্ষের তেল মেখে রোদে মেলে দিত।

মোতালেবকে ট্রেনিং সেন্টারে দেখে আমি বিস্মিত হয়েছিলাম। আমি এখন বিএ দিচ্ছি কারমাইকেল কলেজ থেকে। দেশের এই পরিস্থিতিতে আমার বয়সী ছেলে যুদ্ধে না এসে পারে না। ঊনসত্তরের গণআন্দোলন, সত্তরের নির্বাচন আর মার্চের অসহযোগ আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলো তার নিজস্ব ঝড়োগতিতে বাঙালিকে যুদ্ধের ভেতরে নিয়ে এসেছে। কেউ এর বাইরে নেই। প্রতিটি বাঙালিই আজ মুক্তিযোদ্ধা। আমার মতো রক্ত দেখে অজ্ঞান হয়ে পড়া কাপুরুষও তাই আজ রণাঙ্গনে। রাইফেল চালাতে পারে, গ্রেনেড চালাতে পারে। আব্বাও অনুমতি দিয়েছেন যুদ্ধে যোগ দেওয়ার। কারণ তার মনে হয়েছে, বাড়িতে থাকাটাই বরং বেশি বিপজ্জনক। দালাল রাজাকাররা কাউকে না পেলে নিরীহ ছেলেদেরই তুলে দেয় পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে। তাই পাড়ার আর ছেলেদের সঙ্গে আমিও সিদ্ধান্ত নিই সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার। বুড়িমারি বর্ডার বাড়ির খুবই কাছে। সীমান্ত পাড়ি দেওয়াটা কোনো কঠিন কাজ ছিল না।

কিন্তু ট্রেনিং সেন্টারে গিয়ে মোতালেবকে দেখে আমি অবাক হই। সে আমাকে পেছন থেকে ডেকেছিল, আনিস ভাই। আমি পেছনে তাকাই। কে?

আমি আবদুল মোতালেব।

কোন আবদুল মোতালেব।

হেড মাওলানা স্যারের ছেলে।

তুমি এখানে কী করো?

যুদ্ধ করতে আসছি।

ক্যান? তোমার বাবা?

বাড়িত আছে।

তোমাক আসতে দিল।

হ্যাঁ দিছে।

স্যারের না শরীর খারাপ।

হ্যাঁ। কোমরে ব্যথা। চলতে-ফিরতে কষ্ট হয়।

তোমার ফুপুআম্মাও না...

হ্যাঁ, মা মারা গেছে। দেড় বছর হয়।

তাহলে তুমি আসছ ক্যান?

যুদ্ধ করবার। জয় বাংলা করা লাগবে না?

তোমার বাবা...

আছে কষ্ট করি।

কী কয়?

কয়, ন্যায়ের সঙ্গে অন্যায়ের যুদ্ধ। তুমি ন্যায়ের জন্য লড়বা। অবশ্যই জয়লাভ করবা। যাও।

আমার চোখ ভিজে আসে। মাওলানা স্যারের মতো লোক তার অন্ধের যষ্ঠি একমাত্র কিশোর ছেলেকে যুদ্ধে পাঠিয়েছেন। আঠারো বছরের কিশোর। এখনো গালে ক্ষুর পড়েনি। হালকা মোলায়েম রোম ঠোঁটের ওপরে। গালে।

এই দেশ কি স্বাধীন না হয়ে পারে?

এই মোতালেব মারা গেল সাতগড়া ব্রিজ অপারেশনে। মোতালেবের ব্রেনটা ভালো হয়নি। সে দুইবার ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছে। পাস করতে পারেনি। তবে তার সাহসটা অসাধারণ। আর লক্ষ্যভেদ করার ব্যাপারে সে একটা প্রতিভা। চানমারিতে রাইফেল দিয়ে টার্গেট প্রাকটিস করার সময়ে তার হাতের টিপ দেখে আমাদের শিখ ট্রেইনার ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। হামলোগ তাজ্জব বন গয়া। এ মানুষ নাকি ভূত!

মোতালেব রাতের বেলা ঘুমের মধ্যে কাঁদত। আমি ভাবতাম জেগে জেগে কাঁদছে। আমি আস্তে আস্তে বলতাম, মোতালেব। কী হইছে?

মোতালেব সাড়া দিত না। তখন তাকে ঝাঁকি দিয়ে জাগিয়ে দিলে সে পাশ ফিরে শুয়ে ঘুম দিত। পরের দিন সকালে জিজ্ঞেস করলে সে রাতের ঘটনার কিছুই মনে করতে পারত না।

সাতগড়া ব্রিজ অপারেশনে মোতালেব মারা গেল। ব্রিজটা দুজন রাজাকার পাহারা দেয়, এটাই আমরা জানতাম। ব্রিজটার একটা স্ট্রাটেজিক গুরুত্ব ছিল। এই রাস্তা দিয়ে একটা পাকিস্তানি ক্যামেঙ্ রসদ ও সৈন্য আনা-নেওয়ার জন্য লরি জিপ চলাচল করত। এটা উড়িয়ে দিলে পাক আর্মি বিপদে পড়বে। আগের রাতেও রেকি করা হয়েছে। দুইজন রাজাকারই পাহারা দেয়। দিনের বেলাও রেকি করা হয়েছে আবার। রাজাকার দুইজনই। পাঁচজন মাত্র এফএফ পাঠানো হলো ব্রিজে। বাকিদের দুই ভাগ করা হলো। একদল গেল উত্তরের দিকে। যাতে উত্তরের ক্যামঙ্ থেকে পাকিস্তানি সৈন্যরা চলে আসতে না পারে। আরেক দল দক্ষিণে, সৈয়দপুরের দিক থেকে যেন আক্রমণ না আসে, সেটা নিশ্চিত করতে। কিন্তু আমাদের ভাগ্য ছিল খারাপ। রাত ১০টায় মোতালেব-সমেত পাঁচজন যখন ব্রিজের কাছে যায়, রাজাকার দুজনকে নিরস্ত্র করে ব্রিজের নিচে বোমা পেতে তারা নীরবে চলে আসবে, এতটুকুনই ছিল তাদের দায়িত্ব, তখন ব্রিজের ওপরে এক লরি পাকিস্তানি সৈন্য মোতায়েন ছিল, তারা তা জানত না। মোতালেব আর শাজাহান ব্রিজের উত্তরের রাজাকারটিকে ধরে ফেলবে বলে নীরবে ক্রলিং করে তার কাছে যায়। তাকে পেছন দিক হঠাত্ মোতালেব জড়িয়ে ধরে বলে, অস্ত্র ফেল হারামজাদা। আমরা মুক্তি। তখনই হঠাত্ ট্রাকের হেডলাইট জ্বলে ওঠে, আর প্রহরারত পাকিস্তানি সৈন্যরা ফায়ার ওপেন করে। শাহজাহান গড়িয়ে রাস্তা থেকে খাদে নেমে নদীতে লাফিয়ে পড়ে। মোতালেবও একই কাজ করবে বলে দৌড় ধরেছে। গুলি এসে তার গলা ভেদ করে। মোতালেব নদীতে লাফ দেয়।

তিন দিন পরে নদীর ভাটিতে তার লাশ ভেসে উঠলে আমরা সেটা উদ্ধার করি। লাশ তখনই গোরস্থ করা ছাড়া আমাদের আর উপায় ছিল না। নদীর ধারে একটা বাঁশঝাড়ের ছায়ায় কবর খুঁড়ে আমরা তাকে শুইয়ে রাখি। তার শরীর ফুলে উঠেছিল। কিন্তু মুখখানা ছিল একই রকম কৌশরক মায়া-মাখা। ওই মুখের দিকে তাকিয়ে আমি হাউমাউ করে কেঁদে উঠেছিলাম।

কমান্ডারের নির্দেশ। মোতালেবের বাবাকে তার একমাত্র ছেলের মৃত্যুসংবাদ দেওয়ার জন্য আমি আর মিজান হাঁটছি আড়াইঘাটার দিকে। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নেমে এসেছে। চারদিকে কুকুর আর শেয়ালের ডাক। ঝোঁপ-ঝাড়ে জোনাকির মিটিমিটি আলো।

আমার আর মিজানের মুখে কোনো কথা নেই। আমাদের সঙ্গে মোতালেবের ঝোলাটাও আছে। ঝোলায় মোতালেবের কিছু কাপড়চোপড়। আইডি কার্ড। আইডি কার্ড গুরুত্বপূর্ণ। কেননা তাতে ওর একটা ফটোগ্রাফ আছে। হেড মাওলানা স্যারকে এসবই হস্তান্তর করতে হবে।

আড়াইঘাটায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত আরো বেড়ে যায়। স্যারের বাড়িটা ঠিক কোন জায়গায় কে জানে? মেঘের ফাঁকে চাঁদ উঠেছে। তারই আলোয় পথের ধারে দেখা মেলে এক কিশোরের। তাকে জিজ্ঞেস করি, জিএল স্কুলের হেড মাওলানা স্যারের বাড়ি কোন দিকে? ছেলেটা বলে, আমার সঙ্গে আইসেন।

বাংলার সব গ্রাম দেখতে একই রকম। সব বাড়িগুলোও। চাঁদের আলোয় শান্ত নিরিবিলি গ্রামগুলোকে আজ বড় করুণ বলে মনে হচ্ছে।

একটা উঁচু গাছপালায় ঢাকা ভিটে দেখিয়ে ছেলেটা বলে, ওই বাড়ি হয়।

আমাদের দেখেই দুটো কুকুর ঘেউ ঘেউ করতে করতে ছুটে আসে।

ছেলেটাই আমাদের ভিটেয় ওঠার পায়ে চলা পথ দেখিয়ে নিয়ে চলে। দুটো পুকুরের মধ্যবর্তী পথ বেয়ে বিষকাটালির ঝোপ পেরিয়ে আমরা ভিটের দিকে এগোই। কিশোরটা সাপের ভয়ে একটা লাঠি হাতে ঝোপে বাড়ি দিয়ে মুখে হেট হেট শব্দ করছে। সাপ নাকি কানে শোনে না! শব্দ করলে কি লাভ হবে?

আঙিনার ভেতরে ঢুকতেই আমার বুক কাঁপতে থাকে। হেড মাওলানা স্যারকে আমি এই খবর দেব কেমন করে। খবর শোনার পর তার প্রতিক্রিয়া কী হবে?

আঙিনা জুড়ে পড়ে আছে চাঁদের আলো। একটা ডালিম নাকি মেহেদি গাছ দেখা যায় উঠোনের এককোণে।

একটা কাঠের দেয়াল আর টিনে ছাওয়া বাংলাঘরের বারান্দায় আমরা উঠে পড়ি। এদিক ওদিক তাকাই। আকাশে চাঁদটা বোধহয় মেঘে ঢেকে গেল। উঠোনটা অন্ধকার হয়ে পড়ে। ভেতরে মনে হয় লণ্ঠন জ্বলছে। খোলা জানালা দিয়ে তার আলো এসে পড়েছে বারান্দার চালে। ছেলেটা বলে, চাচা, জাগি আছেন বাহে।

হ্যাঁ। কে?

মুই ময়না। তোমার কাছে সাগাই আসছে।

কেটা? দুয়ারটা ধরি টান দে। খুলি যাবে।

ময়না দরজার কড়া ধরে টান মারে। টুক করে ছিটকিনি পড়ার শব্দ হয়। সে কপাট ঠেললে ক্যাঁকো শব্দ তুলে দরজা খুলে যায়।

আমরা ভেতরে প্রবেশ করি।

ময়না হারিকেনের আলো বাড়িয়ে দেয়।

স্যার কাঁথা গায়ে শুয়ে আছেন। তিনি বিছানায় উঠে বসেন। একটা বিড়াল তার পাশ থেকে লাফিয়ে জানালা দিয়ে পালিয়ে যায়।

আসসালামু আলায়কুম।

কেটা? স্যার গলা খাকারি দিয়ে বলেন।

স্যার আমি আনিস, স্যার। আপনার ছাত্র।

ও বাবা আনিস। বড় হয়া গেছ বাবা। আসো। ওই চেয়ারটা টানি নিয়া বসো।

ও মিজান, স্যার। আমার সঙ্গে আসছে।

বসেন। ওই চেয়ারটাতে বসেন। কী খবর বাবা।

স্যার, আমি তো স্যার যুদ্ধে গেছি।

হ্যাঁ। আবদুল মোতালেব চিঠিতে তোমার কথা লেখছিল। আবদুল মোতালেব কোনো খবর দিছে বাবা?

স্যার। একটা খারাপ খবর আছে... আমি ডানহাত দিয়ে বাঁ হাতের আঙুল ফোটাই। মুখে কথা সরে না। কোথায় যেন পড়েছিলাম, এই পৃথিবীতে সবচেয়ে ভারী জিনিস হলো পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ। আর হেড মাওলানা স্যারের ব্যাপারটা আরো কঠিন। মোতালেব তার একমাত্র ছেলে। এই রোগগ্রস্ত নিঃসঙ্গ পিতার একমাত্র ভরসার স্থল। আমার ঠোঁট কাঁপে। মুখে কথা সরে না।

স্যার বলেন, কী খবর বাবা বলো।

আমি বলি, স্যার আবদুল মোতালেব স্যার...শহীদ হইছে!

স্যার কোনো কথা বলেন না।

আমরা দুজনও না।

অসহ্য নীরবতা আমাদের বুকের ওপরে পাহাড়ের ওজন নিয়ে চেপে বসে থাকে।

আমি বলি, যুদ্ধ করতে গিয়া শহীদ হইছে। গলায় গুলি লাগছিল। আগস্ট মাসের ২৩ তারিখে। রাত্রি ৮টার পরে গুলি লাগে।

স্যার স্থির হয়ে আছেন। লণ্ঠনের আলোয় তার চোখ, চোখের পাতা পিতলের মূর্তির বলে মনে হয়।

আমি বলি, স্যার ওর জিনিসপাতি এই পোঁটলাটায় আছে। আর স্যার এইটা হলো আবদুল মোতালের আইডি কার্ড। এইটায় ওর একটা ফটো আছে।

স্যার আমাদের কথা শুনছেন বলে মনে হয় না। তিনি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকেন। তারপর একটু একটু করে তার চোখের নিচে জল জমতে থাকে। স্বর্ণবিন্দুর মতো একটা একটা করে অশ্রুর ফোঁটা জমে। বেরুতে থাকে। এরপরে তিনি হঠাত্ ডুকরে ওঠেন। হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন।

কাঁদুন। কেঁদে কেঁদে এই সর্বস্ব হারানো বৃদ্ধ মনের শোকভার যদি কিছু কমাতে পারেন।

কিন্তু আমার তো তাকে কিছু বলতে হবে। আমি বলি, স্যার। ও শহীদ হইছে। আপনি তো স্যার ওকে বলছিলেন এটা ন্যায়ের সঙ্গে অন্যায়ের যুদ্ধ। ও ন্যায়ের পক্ষে যুদ্ধে মারা গেছে। ও তো স্যার শহীদ। ডাইরেক্ট বেহেশতে যাবে ইনশাল্লাহ। আপনি কাঁদবেন না স্যার।

স্যার বলেন, আমি কি বাবা ছেলে হারানোর দুঃখে কানতেছি? না। আমি কানতেছি অন্য কারণে। আমার দুঃখ হইল, আমার কেন খালি একটা মাত্র ছেলে?

আমি মাথা নিচু করি। কথা তো ঠিক। আমার মুখে আর কথা জোটে না। তবু তো একটা কিছু বলা দরকার। এই পরিস্থিতিতে পড়তে চাইনি বলেই তো এইখানে আসতে চাইনি। মাহবুব ভাইটা যে কী না! মনের ভেতরে কোনো কথা নেই, তবু সান্ত্বনা দেবার জন্যে যান্ত্রিকভাবে কথা খুঁজে বের করি, বলি, স্যার, আমরা তো আছি স্যার আমরা তো আপনের ছেলের মতোই।

স্যার খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলেন, আজকে যদি আমার আর একটা ছেলে থাকত, তাকে আমি তোমার সঙ্গে দিতাম। সেও যুদ্ধে যাইত। আমাকে আল্লাহ কেন মাত্র একটা ছেলে দিল। আরেকটা থাকলে তো সেও যুদ্ধে যাইতে পারত।

কান্না গোপন করতে খোলা দরজা দিয়ে বাইরে তাকাই। উঠোনে আবার চাঁদের আলো এসে পড়েছে। মনে হয় মেঘ সরে যাচ্ছে।

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০০৪ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত