বিজ্ঞাপন
default-image

৯ এপ্রিল সকালে তাজউদ্দীন আমীর উল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে এক পুরোনো ডাকোটা প্লেনে করে প্রস্তাবিত মন্ত্রিসভার অবশিষ্ট সদস্যদের খুঁজতে বের হন। মালদহ, বালুরঘাট, শিলিগুড়ি, রূপসা (ধুবড়ীর কাছে) ও শিলচর হয়ে পথে ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, আবদুল মান্নান ও সৈয়দ নজরুল ইসলামকে সঙ্গে করে তাজউদ্দীন আগরতলায় পৌঁছালেন ১১ এপ্রিল (একান্ত সাক্ষাৎকার, তাজউদ্দীন আহমদ, ও শরদিন্দু চট্টোপাধ্যায়)। খন্দকার মোশতাক আহমদ ও কর্নেল ওসমানী আগরতলায় অপেক্ষা করেছিলেন। এঁদের মধ্যে দুই দিন ধরে বিভিন্ন পর্যায়ে বিস্তর আলাপ-আলোচনা ও বিতর্ক চলার পর অবশেষে তাজউদ্দীন কতৃ‌র্ক প্রস্তাবিত মন্ত্রিসভার গঠন ও আয়তন বহাল থাকে। অবশ্য এই মতৈক্যে পৌঁছানোর স্বার্থে মন্ত্রিসভার ক্ষমতার পরিসরে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সাধন করা হয়।

পরে ১৭ এপ্রিলে নির্বাচিত পরিষদ সদস্যদের পক্ষ থেকে প্রচারিত পূর্ববর্তী তারিখযুক্ত (১০ এপ্রিলের) ‘স্বাধীনতা আদেশ ঘোষণায়’ শাসনতন্ত্র প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ গণপ্রজাতন্ত্রের কার্যনির্বাহী ক্ষমতা, আইন প্রণয়নের ক্ষমতা, প্রধান সেনাপতির ক্ষমতা, এমনকি প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার সদস্য নিয়োগের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির অথবা তাঁর অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির হাতে অর্পণ করা হয় এবং এই স্বাধীনতা আদেশটি ২৬ মার্চ থেকে কার্যকারিতা লাভ করেছে বলে উল্লেখ করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে এবং বিশেষ করে পরবর্তী নেতৃত্ব সম্পর্কে কোনোরূপ সিদ্ধান্তের অভাবে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বসংকট যেখানে একরূপ অবধারিত ছিল, সেখানে একটি মন্ত্রিসভার গঠন নিঃসন্দেহে ছিল এক বিরাট রাজনৈতিক অগ্রগতি।

নতুন মন্ত্রিসভা আগরতলা থেকে কলকাতা আসার পর তখনকার অন্যতম মূল প্রচেষ্টা হয়ে দাঁড়ায় নতুন সরকারকে এমনভাবে বহির্বিশ্বের কাছে উপস্থিত করা, যাতে এর পক্ষে বিভিন্ন দেশ থেকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি সংগ্রহ করা সম্ভব হয়। ১৭ এপ্রিল বিশ্বের সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সম্মুখে নবগঠিত মন্ত্রিসভার প্রকাশ্য শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান আয়োজিত হয় বাংলাদেশের দ্রুত সংকুচিত মুক্তাঞ্চলের এক প্রান্তে—কুষ্টিয়ার মেহেরপুর মহকুমার সীমান্তবর্তী গ্রাম বৈদ্যনাথতলায়, যার নতুন নামকরণ হয় ‘মুজিবনগর’। বাংলার সশস্ত্র বিদ্রোহ তখন সর্বাংশে স্তিমিত।

পাকিস্তানি বাহিনীর দ্রুত অভিযানের মুখে সমগ্র বাংলাদেশের পতন প্রায় সম্পন্ন হওয়ায় বিভিন্ন রাষ্ট্র থেকে কূটনৈতিক স্বীকৃতিলাভের আশা অনিশ্চিতকালের জন্য পিছিয়ে যায়। তিন সপ্তাহের অধিককাল ধরে পাকিস্তানের হত্যাতাণ্ডব, অগ্নিসংযোগ ও বর্বরতার মুখে বাংলার স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ যখন বিপর্যস্ত, এমনি সময় বিলম্ব সত্ত্বেও মন্ত্রিসভা গঠনের মারফত বাংলাদেশ তার বিঘোষিত স্বাধীনতা বাস্তবায়নের জন্য সঠিক রাজনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে।

সূত্র: মূলধারা ’৭১, ইউপিএল, ঢাকা

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০১১ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত