গাছে ডাসা ডাসা নারকেল। সুপারিগাছও ফলবান। ১৯৬১ সালে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের এই বাড়ি তৈরির সময় গ্রাম থেকে নারকেল ও সুপারির চারা এনে রোপণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভগ্নিপতি শেখ মোহাম্মদ মুসা। বাড়ির সামনে ঝাউগাছ লাগিয়েছিলেন আরেক স্বজন। ১০ বছরের মাথায় বঙ্গবন্ধুর এক বিঘার দোতলা বাড়িটি যেন পুষ্পে-পত্রে পল্লবিত। সকাল-বিকেল নানা পাখির কূজন।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ। শেষ ফাল্গুনের দুপুর। সেদিন ছিল না শীত না গরম। আকাশ পরিষ্কার ছিল, তবে চড়া রোদ ছিল না। সকাল থেকেই আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের অসংখ্য নেতা–কর্মীর ঠিকানা এই ৩২ নম্বরের বাড়ি। কেউ ঢুকছেন আবার কেউ বের হচ্ছেন। প্রবল উত্তেজনা সবার মধ্যে, যেন উত্তপ্ত কড়াইয়ে খই ফুটছে। আজ কি স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন বঙ্গবন্ধু?
১ মার্চ থেকেই অগ্নিগর্ভ সারা দেশ। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আকস্মিকভাবে গণপরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করে আন্দোলনের আগুনে ঘি ঢেলে দিলেন। বুঝতে বাকি রইল না কারও, এটা নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগকে সরকার গঠন করতে না দেওয়ার ফন্দিফিকির। শেষতক জনতাকে রুখতে কারফিউ জারি। কারফিউর মধ্যেই প্রতিবাদী মানুষ নেমে এল রাস্তায়।
জনতাকে রুখতে গুলি চালাল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। এই কয়দিনেই ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে প্রায় শতাধিক নিরপরাধ বাঙালিকে হত্যা করল তারা।
বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ রেসকোর্সে ভাষণ দেবেন, সে ঘোষণা দেন ৩ মার্চ পল্টনে ছাত্রসমাবেশে। বলার অপেক্ষা রাখে না, জাতির জীবনে ৭ মার্চ এসেছিল ধারাবাহিক রাজনৈতিক আন্দোলনের পটভূমিতে।
বঙ্গবন্ধুর রমনা রেসকোর্স ময়দানে পৌঁছানোর নির্ধারিত সময় বেলা ২টায়। বেলা ১১টার মধ্যেই রেসকোর্স জনসমুদ্র। রিকশায়, বাসে, টেম্পোতে, যে যেভাবে পারে, সবার গন্তব্য রেসকোর্স। সব পথ যেন মিলেছে এই রেসকোর্সে।
বঙ্গবন্ধু দুপুরের খাবার খেয়ে দোতলায় নিজের কক্ষে বিশ্রাম নিচ্ছেন। বেগম মুজিব পাশে গিয়ে বললেন, তুমি কারও কথায় প্রভাবিত হবে না। যা বিশ্বাস করো, তাই বলবে।
আমরা এ লেখায় বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে রেসকোর্সে (আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) যাওয়া এবং বাড়িতে ফিরে আসার বর্ণনা তুলে আনব, নিরাপত্তার দায়িত্বরত নেতারা ও প্রত্যক্ষদর্শীদের জবানিতে।
মমিনুল হক খোকা বঙ্গবন্ধুর আপন ফুপাতো ভাই, মেজ ফুফুর কনিষ্ঠ পুত্র। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের প্রায় শুরু থেকেই তাঁর নিত্য সহচর, বিশ্বস্ত সচিব ও রাজনৈতিক সংকটসংকুল মুহূর্তে বঙ্গবন্ধুর গাড়িচালক। কলকাতা জীবন শেষ করে ঢাকায় এসে মোগলটুলীতে আওয়ামী লীগ অফিসে কয়েকটা দিন কাটানোর পর আরমানিটোলার রজনী বোস লেনে মমিনুল হক খোকার মেসেই উঠেছিলেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু পরিবারের সঙ্গে তাঁর সারা জীবনের স্মৃতি তিনি তুলে ধরেছেন ‘অস্তরাগে স্মৃতি সমুজ্জ্বল, বঙ্গবন্ধু, তাঁর পরিবার ও আমি’ বইতে। ২০০০ সালের ফেব্রুয়ারিতে সাহিত্য প্রকাশ প্রকাশিত এ বইয়ে ৭ মার্চের দিনের বর্ণনা রয়েছে। ওই দিনও বঙ্গবন্ধুর গাড়ি চালিয়েছিলেন মমিনুল হক খোকা।
আর বঙ্গবন্ধুকে ৩২ নম্বর থেকে রেসকোর্সে নিয়ে যাওয়া এবং বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব ছিল স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়ের অন্যতম ছাত্রনেতা, সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রী প্রয়াত আব্দুর রাজ্জাকের ওপর। তখন তিনি আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান। তিনিও এক সাক্ষাৎকারে সেদিনের স্মৃতিচারণা করেছেন। আর রেসকোর্সে মঞ্চের নিরাপত্তার অন্যতম দায়িত্বে ছিলেন স্বাধীনতাযুদ্ধে ঢাকা অঞ্চলের গেরিলা কমান্ডার কামরুল আলম খান খসরু (পরে ‘ওরা ১১ জন’ সিনেমার নায়ক)। তিনিও লিখেছেন এ বিষয়ে বিস্তারিত।
২০১১ সালের ২৩ ডিসেম্বর বিডি নিউজের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে আব্দুর রাজ্জাক স্মৃতিচারণা করেন এভাবে—
‘৭ মার্চ। আমার জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। সকাল থেকেই আমি ছিলাম বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সঙ্গে। ঠিক হলো তিনটি গাড়ি আমাদের সঙ্গে রেসকোর্সে যাবে। দুটি গাড়িতে থাকবে যাদের গোঁফ আছে এবং তাদের পরনে থাকবে পাঞ্জাবি। চুল থাকবে ব্যাক ব্রাশ করা। সামনের গাড়িতে আমরা। ঠিক দুইটার সময় ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে বের হন বঙ্গবন্ধু।
‘আমি অত্যন্ত চিন্তিত ছিলাম। কোনো অঘটন ঘটে কি না! তখন বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্র চারদিকে। বলা হয়েছিল, কমান্ডো অ্যাটাক করে হত্যা করা হবে। আকাশে হেলিকপ্টারও ঘুরছে। অ্যাটাক হলে বাঁচানো যাবে না।
‘৩২ নম্বর থেকে এলিফ্যান্ট রোড, তৎকালীন পিজি হাসপাতালের পাশ দিয়ে রেসকোর্সে যাওয়ার কথা।
‘যাত্রার শুরুতেই তাৎক্ষণিকভাবে আগের সব পরিকল্পনা বদলে ফেলি। আমি কৌশলটা নিলাম, যেভাবে যাওয়ার কথা ওভাবে যাব না। বঙ্গবন্ধুকে আমাদের গাড়িতে তুললাম।
গাড়ির ভেতরে বঙ্গবন্ধুকে রেখে আমরা এমনভাবে দাঁড়ালাম, যাতে তাঁকে দেখা না যায়।
‘এবার বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রওনা দিলাম নিউমার্কেট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে হাইকোর্টের পাশ দিয়ে রেসকোর্সের পথে। বিশাল জনতার ঢেউয়ের মধ্যে সোজা মঞ্চে উঠলেন তিনি। পেছনে দাঁড়িয়ে মহিউদ্দিন, আমি আর গাজীউল হক। সমাবেশে কোনো সভাপতি ছিল না। গিয়েই বঙ্গবন্ধু আমাকে বলেন, “মাইকটা দে।” জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু-স্লোগান দুটি দিতে দিতেই বঙ্গবন্ধুকে মাইক দিই। এর পরের ঘটনা তো ইতিহাস।’
ঘুর পথে বঙ্গবন্ধুকে রেসকোর্সে নেওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য রাজনীতিবিদ ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক তোফায়েল আহমেদও। ২০১৯ সালের ৭ মার্চ বিবিসির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তোফায়েল আহমেদ বলেন, আগের নির্ধারিত রাস্তা বাদ দিয়ে ভিন্ন পথে তাঁকে সেখানে নেওয়া হয়েছিল। সাদা পায়জামা–পাঞ্জাবি এবং হাতাকাটা কালো কোট পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উপস্থিত হয়েছিলেন। মঞ্চে সকাল থেকেই গণসংগীত চলছিল। বঙ্গবন্ধু সেদিন একাই ভাষণ দিয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধুকে বাড়ি থেকে রেসকোর্সে নেওয়া এবং মঞ্চের নিরাপত্তা নিয়ে বর্ণনা পাওয়া যায় কামরুল আলম খান খসরুর লেখায়। তাঁর ভাষ্য, ৫০ জন স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে তিনটি দল গঠন করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে আনা-নেওয়ার জন্য গঠিত দলে ছিলেন খসরু, মন্টু (মোস্তফা মহসীন মন্টু), হোসেন, মুরাদ, নাজিম, বাচ্চু, শান্ত প্রমুখ। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সময় মঞ্চের নিচে অবস্থানের জন্য একটা দল রাখা হয়। সে দলে ছিলেন আফজাল হোসেন ভুলকু, হালিম, বাবুল, বাচ্চু, বাবলা, মধু, সেলিম, দিলু, জয়নাল প্রমুখ। মঞ্চের আশপাশে সার্বক্ষণিক থাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত দলে ছিলেন মুরাদ, হোসেন, নাজিম, আলিমুদ্দীন, জুডোমনি, আওলাদ, আবু, নেহাল, সেলিম ভূঁইয়া, ইকবাল, ফিরু, জিয়া, পারভেজ রংপুরী প্রমুখ। (সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রমতে, আলিমুদ্দিন ছিলেন বডিবিল্ডিংয়ে মি. ইস্ট পাকিস্তান খেতাবপ্রাপ্ত। আওলাদ পরে বাংলাদেশ জুডো দলের কোচ)
খসরু লিখেছেন, ‘রাজ্জাক ভাই পুরো মঞ্চের দেখভালের দায়িত্ব দেন আমার ওপর।
মঞ্চের ওপর কে কে উঠবে তাদের নাম আমার কানে কানে বলেন। এর বাইরে কোনো ব্যক্তি যাতে মঞ্চে উঠতে না পারে, সে বিষয়ে সতর্ক করেন।’ (২০১৬ সালের ১৫ মার্চ মানবজমিন)
‘ভায়েরা আমার...’
রেসকোর্সে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের নির্ধারিত সময় বেলা ২টা নির্ধারণ করা হলেও তিনি বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন দুইটায়। জনতার ভিড় ঠেলে সভাস্থলে পৌছাতে তাঁর বেজে গিয়েছিল তিনটা, এ কথা ওই জনসভায় উপস্থিত সৈয়দ আবুল মকসুদসহ অনেকেই উল্লেখ করেছেন। সৈয়দ আবুল মকসুদ ২০১৫ সালের ২৬ মার্চ প্রথম আলোতে এক লেখায় উল্লেখ করেন, ‘তখন রমনা পার্ক ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মাঝখানে মাওলানা ভাসানী রোড এখনকার মতো প্রশস্ত ছিল না। সোহরাওয়ার্দীর দিকেও শতবর্ষী সেগুন ও মেঘশিরীষ ছিল কয়েকটি। উদ্যানটি ফাঁকা। সমাবেশের নির্ধারিত সময় ছিল বেলা দুইটা। বেলা সাড়ে ১১টার সময় কমলাপুর জসীমউদ্দীন রোড থেকে আমি গিয়ে দেখি রেসকোর্স এক জনসমুদ্র। কোনো রকমে আমি ঠাঁই পাই ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের উল্টো দিকে এক গাছের তলায়, যে গাছের ডালেও বসেছিল কয়েকজন। জনতার ভিড়ে ৩২ নম্বর থেকে সভামঞ্চে আসতে বঙ্গবন্ধুর ঘণ্টাখানেক দেরি হয়। প্রথাগত জনসভা নয়, একমাত্র বক্তা বঙ্গবন্ধু। জনতার শ্বাসরুদ্ধকর অপেক্ষার সমাপ্তি ঘটে। উচ্চারিত হয়: ‘ভায়েরা আমার...।’
আব্দুর রাজ্জাক ও সৈয়দ আবুল মকসুদ বেলা ২টার সময় বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে বের হওয়ার কথা বলেছেন। অন্যদিকে কামরুল আলম খান খসরু সময়টা উল্লেখ করেছেন বেলা তিনটা।
তবে মমিনুল হক খোকা তাঁর বইয়ে ৭ মার্চবিষয়ক অধ্যায়ে (পৃষ্ঠা ১৩২/১৩৩) লিখেছেন, ‘বেলা সাড়ে চারটা, মিঞাভাই দোতলা থেকে নেমে এসে উঠলেন আমার গাড়িতে, আমি চালক। পেছনে ট্রাকে ছিলেন আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ। চিন্তামগ্ন মিঞাভাই। গোটা জাতির ভাগ্য নির্ভর করছে তিনি আজকে কি বলবেন তার ওপর।…৩২ নম্বর থেকে রেসকোর্সে পৌঁছাতে যে সময় লাগে তার দ্বিগুণেরও বেশি সময় নিয়ে রেসকোর্সে এসে পৌঁছালাম।’
এ ক্ষেত্রে আবদুর রাজ্জাক ও সৈয়দ আবুল মকসুদের তথ্যই নির্ভরযোগ্য বলে মনে হয়।
ভাষণ শেষে
আবদুর রাজ্জাক লিখেছেন, ভাষণ দিয়ে নেমেই বঙ্গবন্ধু সোজা ওঠেন গাড়িতে। কেউ জানে না আমরা কোন দিকে, কোথায় যাচ্ছি। সেই একই কায়দায় (আগের পরিকল্পনা পাল্টে)। সমাবেশস্থল থেকে শাহজাহানপুর, মতিঝিল কলোনির পাশ দিয়ে (আজকের) শেরেবাংলা নগর হয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে।
বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সময় সমাবেশস্থলে ছিল নীরবতা। আর ভাষণ শেষে স্বাধীনতার পক্ষে স্লোগানে আবার মুখর হয়ে ওঠে ঢাকার সড়কগুলো।
কাজী আলিম-উজ-জামান: সহকারী বার্তা সম্পাদক, প্রথম আলো