পাকিস্তানের অপশাসনের বিরুদ্ধে আমাদের প্রায় আড়াই দশকের সংগ্রামের শেষ পর্যায়টি সূচিত হয় ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চে ছয় দফা দাবি উত্থাপনের মধ্য দিয়ে। ছয় দফার প্রথম দফাটি ছিল ‘শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ও রাষ্ট্রের প্রকৃতি’-সম্পর্কিত, যাতে পাকিস্তানকে একটি ‘ফেডারেশনভিত্তিক রাষ্ট্রসংঘ’ হিসেবে দেখা হয়েছিল। কিন্তু সর্বজনীন ভোটাধিকার, মুদ্রানীতি, রাজস্ব ও শুল্ক, বৈদেশিক বাণিজ্য ইত্যাদি নিয়ে দফাগুলোতে যেসব প্রস্তাবনা ছিল, সেগুলো যে সামরিক শাসনে অভ্যস্ত পাকিস্তান রাষ্ট্রে অর্জন করা সম্ভব হবে না, সেই সন্দেহটি সবারই ছিল। সেটি প্রমাণিত হলো যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর সহযোগীদের কারাগারে নিক্ষেপ করা হলো, আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ গুলি চালাল। কিন্তু ছয় দফার আন্দোলনটি যত তীব্রতা পেল, ততই এই বিষয়টি স্পষ্ট হলো যে ছয় দফার আড়ালে যে রাষ্ট্রের প্রতিকৃতি আঁকা হয়েছে, তা বাংলাদেশ, যেহেতু ছয় দফা আন্দোলন ছিল গণতন্ত্র, আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং নিজেদের সম্পদের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার অধিকার নিয়ে।
ছয় দফা মানা না হলে পুরোনো রাষ্ট্রকাঠামোতে ফিরে যাওয়ার আর কোনো সুযোগ নেই—এ রকম ঘোষণা বঙ্গবন্ধু বহুবারই দিয়েছেন এবং তাঁর দৃষ্টি তিনি নিবদ্ধ করেছিলেন ছয় দফা-পরবর্তী একটি বাস্তবতায়, যাতে আত্মনিয়ন্ত্রণের সংগ্রামটি স্বাধীনতাসংগ্রামে রূপ নেবে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তিনি যে ভাষণ দেন, তাতে একদিকে মুক্তিযুদ্ধের অনিবার্যতা সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য এবং মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য কিছু দিকনির্দেশনা যেমন ছিল—অন্যদিকে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ‘প্রকৃতি’রও একটি রূপরেখা ছিল। ৭ মার্চের পর বাংলাদেশে পাকিস্তানের শাসন সীমাবদ্ধ ছিল এর সামরিক উপস্থিতিতে, কার্যকর শাসনব্যবস্থা ছিল বঙ্গবন্ধু এবং বাঙালিদের হাতে। ২৫ মার্চ মধ্যরাত থেকে পাকিস্তান একটি দখলদারি শক্তি হিসেবেই থেকে গেল, যাকে দেশছাড়া করার জন্য আমাদের আর মাত্র ৯টি মাস প্রয়োজন ছিল।
১৯৭১-এর ১০ এপ্রিল যখন স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এবং ১৭ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠা পেল, আমাদের মনে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রকৃতি নিয়ে তাই কোনো দ্বিধা ছিল না। আমরা জানতাম, এটি একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হবে, যার মালিকানা থাকবে জনগণের হাতে। আমরা জানতাম, এই রাষ্ট্র সব অর্থে পাকিস্তানি রাষ্ট্রের বিপরীত একটি রাষ্ট্র হবে, অর্থাৎ এটি হবে মানবিক, উদারপন্থী, অসাম্প্রদায়িক এবং শিক্ষায়-সংস্কৃতিতে অগ্রসরমাণ একটি রাষ্ট্র, যেখানে মানবাধিকারসহ সব অধিকার সুরক্ষিত হবে।
স্বাধীন বাংলাদেশে স্বাধীন মতপ্রকাশের জন্য কেউ নির্যাতিত হবে, এটি আমাদের ভাবনায় স্থান পায়নি, যেমন পায়নি কৃষক-শ্রমিকের দাবিগুলো অর্জনের ব্যাপারে কোনো সন্দেহ। সে জন্য ১০ এপ্রিল যখন স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র জাতির সামনে তুলে ধরা হলো, আমরা দেখলাম সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার—এই তিন মন্ত্রেই বাঙালির রাজনৈতিক সাধনা ও সংগ্রামের উদ্দেশ্যকে তুলে ধরা হয়েছে। আমরা নিশ্চিত হলাম, বাংলাদেশে এ আদর্শগুলো হবে রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি।
বাংলাদেশ স্বাধীন হলে আমরা একটি চমৎকার সংবিধান পেলাম, যাতে প্রকারান্তরে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার একটা জায়গা করে নিল। একটি গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এসব আদর্শ অর্জন করা সম্ভব, এ রকম একটি প্রত্যয় আমাদের জন্ম নিল। কিন্তু সেই প্রত্যয়টি একটু একটু করে শক্তি হারাল এবং একসময় আমরা দেখলাম, সাম্যের জায়গায় অসাম্য আছে মুখব্যাদান করে, মানবিক মর্যাদা উপেক্ষিত এবং সামাজিক সুবিচার দাবি ও অর্জন করতে পারে তারাই, যাদের ক্ষমতা ও অর্থ আছে। সমাজতন্ত্র কবেই নির্বাসিত হয়েছে পুঁজিবাদের আগ্রাসনে, মুক্তবাজার অর্থনীতির ঝাপটায়; গণতন্ত্রও নির্বাসিত হয়ে একসময় ফিরে এসেছে, কিন্তু ভগ্ন স্বাস্থ্য নিয়ে। মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা শহীদ হয়েছিলেন, তাঁরা চোখে যে স্বপ্নটা নিয়ে গেছেন, তা ছিল ওই সাম্য-মর্যাদা-সুবিচারের, এক আদর্শিক সোনার বাংলার। সেই স্বপ্নটা কি ফিরিয়ে আনা যায় না, তার বীজগুলো আবার নতুন করে কি বোনা যায় না?
২.
২০১৯ সালের স্বাধীনতা দিবসে দাঁড়িয়ে আমরা বাংলাদেশের যে ছবিটা দেখি, তাতে একদিকে উন্নয়নের উজ্জ্বল কিছু রং আছে যা আমাদের কৃষক, শ্রমিক ও সংগ্রামী নারীরা, আমাদের অবহেলিত জনপদগুলোর তরুণেরা কষ্টের এবং পরিশ্রমের তুলিতে লাগিয়েছেন। কিন্তু অন্যদিকে আছে কিছু গাঢ় রং, যেগুলো একটা নেতির ছবি তুলে ধরে যার অনেকটা জুড়ে আছে বৈষম্য। এই বৈষম্য ধনী-গরিবের, গ্রাম-শহরের, মালিক-শ্রমিকের
ক্রমবর্ধমান পার্থক্যের।
আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৮-এর ঘর ছুঁতে যাচ্ছে, কিন্তু হতদরিদ্রদের সংখ্যা এখনো উল্লেখযোগ্য। বিপুলসংখ্যক মানুষ স্বাস্থ্যসেবাবঞ্চিত, তারা এবং তাদের সন্তানেরা পুষ্টির জোগান পায় না। শিক্ষা থেকে দূরে অসংখ্য শিশু। দুর্নীতি বেড়েছে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত হচ্ছে, স্থানীয় থেকে জাতীয় নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। সর্বত্র একটা বেপরোয়া ভাব। রাজপথ অনিরাপদ, প্রতিদিন মানুষ মরছে রাস্তায়, অথচ পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলো সরকারকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে তাদের আধিপত্য বজায় রেখেই চলছে। পুলিশও তাদের বাগে আনতে অপারগ, কারণ তারা সমর্থন পায় ক্ষমতাসীনদের থেকে। কেন এমন হবে?
৩.
উত্তর খোঁজার জন্য আমাদের আবার একাত্তরে ফিরে যেতে হবে। স্বাধীনতাযুদ্ধ সব বাঙালিকে একটা অভিন্ন জায়গায় দাঁড় করিয়েছিল এবং সেটি ছিল বাঁচা-মরার লড়াইয়ের ময়দান। গ্রামের মানুষ তাদের দরজা খুলে দিয়েছিল শহরের মানুষের জন্য, তাদের সামান্য খাবারের থালাও বেড়ে দিয়েছিল তাদের সামনে।
এই ছিল আমাদের চেতনা। কিন্তু যুদ্ধ শেষ হলে আমরা ফিরে গেছি আমাদের শ্রেণির খোলসে। ১৯৭৪ সালে যখন উত্তরবঙ্গে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, হাজার হাজার মানুষ ঢাকা শহরে এসে উঠেছে। কিন্তু ঢাকাবাসী তাদের মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে।
একাত্তর আর চুয়াত্তরের এই তফাত আমাদের দেখিয়ে দিল, মানুষ এমনিতে বদলায় না, মৌলিকভাবে তো নয়ই। তাকে বদলাতে পারে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও রাষ্ট্র—যদি তা হয় মানবিক, যদি তা আইনকে মূল্য দেয়, যদি তা সুবিচার এবং সাম্যের পক্ষে থাকে।
১৯৭৫-এর পর রাষ্ট্রের চরিত্র বদলে গেছে। এটি ক্রমাগত পাকিস্তানকে অনুকরণ করেছে। সংস্কৃতি অবহেলিত হয়েছে, শিক্ষায় বৈষম্য বেড়েছে। তিন ধারায় বিপর্যস্ত শিক্ষা বিত্তশালীদের জন্য সুযোগের দরজা খুলে দিয়েছে। ধর্ম নিয়ে রাজনীতি হলে কী বিপদ হতে পারে, তা একাত্তরে আমরা দেখেছি, অথচ বাংলাদেশে তা উৎসাহিত হলো, এর ফলে সাম্প্রদায়িকতা বেড়েছে। ১৯৯০-তে গণতন্ত্র ফিরল বটে, কিন্তু তাকে কাজে লাগানো হলো দল ও
ক্ষমতার সেবায়। একাত্তর অবহেলিতই থেকে গেল। মুক্তিযুদ্ধ হয়ে থাকল ভুলে যাওয়া—অন্তত রাষ্ট্রীয়ভাবে—একটি ঘটনা।
৪.
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম থেকে দীর্ঘ কয়েক দশক আমরা একাত্তর থেকে অনেক দূরে থাকায় একটি যে ক্ষতি হয়ে গেল, তা এই, আমরা আমাদের স্মৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি থেকে আমরা ক্রমাগত দূরে সরে গেছি। যে তরুণের জন্ম হয়েছে আশির শুরুতে, তার মানস গঠনের কালটিতে এসব দূরত্ব অনেক ফাঁক রেখে দিয়েছে, যা দিয়ে কিছু আরোপিত ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং মতবাদ ঢুকে পড়েছে। আমাদের সমাজে উগ্রতা, অসহিষ্ণুতা এবং স্বার্থপরতার যেসব চর্চা দেখি, এর মূলে আছে এসবের অবদান। এগুলো পরিষ্কার করাটা খুবই কঠিন। তার জন্য প্রয়োজন জীবনঘনিষ্ঠ শিক্ষা, সংস্কৃতির চর্চা এবং রাষ্ট্রীয় থেকে ব্যক্তিজীবনে শুদ্ধাচার ও সহনশীলতার চর্চা। কিন্তু সেসবের আয়োজন যাঁরা করবেন—রাষ্ট্র, সরকার থেকে নিয়ে পরিবার ও নানা প্রতিষ্ঠান—তাদের তরফ থেকে আগ্রহের পরিবর্তে আমরা অনীহাই দেখি। রাষ্ট্র যদি নাগরিকের অধিকার লঙ্ঘন করে, পরিবার নানা কারণে (প্রধানত, দুর্নীতি, বাজারের চাপ এবং নানাবিধ বিচ্ছিন্নতার কারণে), প্রতিষ্ঠানগুলো হয়ে দাঁড়ায় অস্বচ্ছ এবং কর্তৃত্বপরায়ণ, তাহলে তরুণদের পরিবর্তনে আগ্রহী কারা করবে? আর যদি এ কাজ করা না হয়, তাহলে শহীদদের স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে।
৫.
কাজটা কঠিন, কিন্তু একেবারে যে অসম্ভব, তা নয়। এ জন্য প্রথমেই প্রয়োজন রাজনৈতিক সংকল্প। রাজনীতিকেই পাল্টাতে হবে, রাজনৈতিক দলগুলোকে গণতন্ত্রের সব শর্ত যথাযথ পালনের সদিচ্ছা এবং চর্চা দেখাতে হবে। রাজনীতি যদি শুদ্ধ না হয়, তাহলে পরিবর্তনের কাজটা হয়তো হাতেই নেওয়া যাবে না।
জীবনের শুরু থেকে আমাদের সন্তানদের শিক্ষা ও সংস্কৃতি দিয়ে তৈরি করতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করতে হবে। একমাত্র শিক্ষাই পারে স্মৃতির সম্পদগুলোকে চিরস্থায়ী করতে, সংস্কৃতি পারে সেগুলোকে প্রতিদিনের কাজকর্মে সক্রিয় করতে।
গত বছর আগস্টে নিরাপদ সড়কের দাবিতে তরুণেরা যখন রাস্তায় নেমেছিল, তাদের একটি উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্রের মেরামত করা। বাংলাদেশে একাত্তরের শহীদদের স্বপ্নের বীজ নতুন করে বোনার জন্য ওই তরুণদের হাতে একাত্তরকে তুলে দিতে হবে। তারা যদি আমাদের স্মৃতির, ইতিহাসের এবং একাত্তরের আদর্শগুলোর মালিকানা গ্রহণ করে, সব ক্ষেত্রে একটা বড় পরিবর্তন আসবে।
আমার আশপাশের প্রায় সবাই এ ব্যাপারে হতাশ, কিন্তু আমি তরুণদের দীর্ঘদিন থেকে দেখছি বলে হতাশ হতে পারি না। আজ না হলেও আগামীকাল, অথবা পরশু, স্বপ্নের এই বীজ বপনের এবং ফসল ঘরে তোলার কাজ শুরু হবে। এই সম্ভাবনা না থাকলে তো একাত্তর এবং আমাদের স্বাধীনতাই আসত না।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ
সূত্র: ২৬ মার্চ ২০১৯, ১২ চৈত্র ১৪২৫, মঙ্গলবার, প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।