বিজ্ঞাপন
default-image

ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার যে গ্রামে সিপাহি হামিদুর রহমানের জন্ম, তার নাম খোর্দ্দ-খালিশপুর। পরে নামটি বদলে এই বীরশ্রেষ্ঠর নামানুসারে ‘হামিদনগর’ করার সরকারি সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত আটকে আছে শুধু ঘোষণাতেই। সরকারি নথিপত্রে আজ পর্যন্ত ‘খোর্দ্দ-খালিশপুর’ নামই ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে এলাকাবাসীর কাছেও হামিদনগর নামটি পরিচিত হয়ে ওঠেনি।

মহেশপুর উপজেলার খালিশপুর বাজারের কাছেই গ্রামটির অবস্থান। এখানে ১৯৫৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি জন্ম নেন মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্য সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় খেতাব বীরশ্রেষ্ঠ উপাধি পাওয়া হামিদুর রহমান। ১৯৭১ সালের ২৮ অক্টোবর মৌলভীবাজারের রণাঙ্গণে শহীদ হন তিনি। গ্রামে তাঁর নামে ১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় একটি কলেজ, যেটি পরে সরকারীকরণ হয়েছে। কলেজ প্রাঙ্গণে হয়েছে বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর। ২০০৮ সালের শুরুর দিকে এটি উদ্বোধন করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা (স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় এবং শ্রম মন্ত্রণালয়) আনোয়ারুল ইকবাল। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি গ্রামটির নাম হামিদনগর করার সরকারি সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন।

হামিদুর রহমানের ভাতিজা মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সরকারি ওই সিদ্ধান্ত আজ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি। নানা প্রতিবন্ধকতায় এলাকাবাসীর কাছে হামিদনগর নামটি পরিচিত হয়ে ওঠেনি। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বীরশ্রেষ্ঠর পরিবার দাবি জানিয়ে আসছে। কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না।

default-image

সরকারি ওই ঘোষণা বাস্তবায়নের পথে প্রধান অন্তরায় সরকারি দপ্তরগুলোই। সরকারি নথিপত্রেও গ্রামের নাম খোর্দ্দ-খালিশপুর ব্যবহৃত হচ্ছে। স্থানীয় এসবিকে ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) কাগজপত্রেও হামিদনগর লেখা হচ্ছে না। নাগরিকত্ব ও জন্মনিবন্ধন সনদসহ সব কাগজপত্রে তারা খোর্দ্দ-খালিশপুর লিখছে। ফলে এলাকাবাসীও আগের নামটাই ব্যবহার করেন।

এ প্রসঙ্গে ইউপি চেয়ারম্যান আরিফান হাসান চৌধুরী বলেন, সরকারি কোনো নির্দেশনা না পেলে তাঁরা গ্রামের নাম বদলাতে পারেন না। ইউপি কর্তৃপক্ষ আজ পর্যন্ত কোনো গেজেট পায়নি। ফলে নথিপত্রে গ্রামটির নাম খোর্দ্দ-খালিশপুরই লিখতে হচ্ছে।

চার ভাই, দুই বোনের মধ্যে হামিদুর রহমান ছিলেন বড়। বাবার নাম মৃত আক্কাচ আলী। মায়ের নাম মৃত কায়দাছুন্নেছা। ভাই শুকুর আলী ও ফজলুর রহমান মারা গেছেন। অপর ভাই হামজুর রহমান বেঁচে আছেন। তবে শারীরিকভাবে তিনি খুবই অসুস্থ। হামিদুরের দুই বোন রিজিয়া খাতুন ও আছিয়া খাতুনও জীবিত।

সম্প্রতি সরেজমিনে হামিদনগর গ্রামে গিয়ে কথা হয় বীরশ্রেষ্ঠর ভাতিজা হাফিজুর রহমানের সঙ্গে। তিনি জানান, তাঁদের পরিবারটি ছিল খুবই অসচ্ছল। ভারত থেকে এসে এই গ্রামে বসতি স্থাপন করেন তাঁরা। দাদা আক্কাচ আলী দিনমজুরের কাজ করে সংসার চালাতেন। বড় ছেলে হামিদুর রহমান ছোটবেলা থেকেই বাবার সঙ্গে কাজে যেতেন। ফলে বেশি দূর পড়ালেখা করা হয়ে ওঠেনি। খুবই সহজ-সরল মানুষ ছিলেন হামিদুর। মানুষের উপকার করা ছিল নেশার মতো। নিজের কাজ ফেলেও অন্যের উপকারে ছুটতেন তিনি।

১৯৭০ সালে হামিদুর রহমান প্রথমে আনসার বাহিনীতে যোগ দেন। সেখানে কিছুদিন চাকরি করার পর নৌবাহিনীতে চাকরি পান। ১৯৭১ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ওই চাকরিতে যোগদান করেন। এরপরই শুরু হয়ে যায় স্বাধীনতাযুদ্ধ। দেশমাতৃকার টানে ওই যুদ্ধে যোগ দেন হামিদুর। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মাকে দেখার জন্য একদিন বাড়িতে এসেছিলেন তিনি। তার কয়েক দিন পরই ছিল ঈদুল ফিতর। বলে গিয়েছিলেন ঈদের জন্য টাকা পাঠাবেন। সেই টাকা আর পাঠাতে পারেননি। মৌলভীবাজারের ধলই এলাকার রণাঙ্গনে শহীদ হন এই বীর সন্তান। ভারত সীমান্তের এলাকাটি জেলার সদর থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। সেখানকার ধলই সীমান্ত ফাঁড়িটি ছিল মুক্তিযুদ্ধের সময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সেটি দখল করে নেয়। ফলে মুক্তিযোদ্ধারা হানাদার বাহিনীর বাধার সম্মুখীন হচ্ছিলেন। অক্টোবরের শেষ দিকে মুক্তিযোদ্ধারা ওই ফাঁড়িতে হামলা চালান। কিন্তু কিছুতেই সুবিধা করতে পারছিলেন না। ফাঁড়ির দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের একটি এলএমজি ছিল প্রধান অন্তরায়। সেটি নিষ্ক্রিয় করার দায়িত্ব পড়ে হামিদুর রহমানের ওপর। ২৮ অক্টোবর তিনি একাই অকুতভয়ে এগিয়ে গিয়ে ওই এলএমজি নিষ্ক্রিয় করেন। কিন্তু সেটি নিস্তব্ধ করতে পারলেও শত্রুর বুলেটে তিনি শহীদ হন।

ভাতিজা মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, পরে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে তাঁরা চাচার শহীদ হওয়ার কথা জানতে পারেন। লাশটি সীমা‌ন্তের ওপারে ভারতের আমবাসা গ্রামে নিয়ে সমাধিস্থ করেছিলেন সহযোদ্ধারা। ৩৬ বছর পর তাঁর দেহাবশেষ ভারতের মাটি থেকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়।

সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে ১৯৮১ সালের ২৪ ডিসেম্বর হামিদুরের পরিবারকে একটি বাড়ি বানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রায় তিন কোটি টাকা অর্থায়নে সেই বাড়িটি ভেঙে বর্তমানে চারতলা ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। ইতিমধ্যে একতলার কাজ শেষ হয়েছে। আর পরিবারটি প্রতি মাসে সরকারি ভাতা হিসেবে ৩৫ হাজার টাকা পায়। এই অর্থ পরিবারের সদস্যরা ভাগাভাগি করে নেন। হামিদুরের নামে প্রতিষ্ঠিত গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরে গ্রন্থাগারিক হিসেবে কাজ করেন তাঁর ভাতিজা মোস্তাফিজুর।

হামিদুর রহমানের নামে গ্রামে কলেজের পাশাপাশি একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ও রয়েছে। এ ছাড়া ঝিনাইদহ জেলা শহরের একটি স্টেডিয়াম তাঁর নামে নামকরণ করা হয়েছে।

খালিশপুর বাজার থেকে যে সড়ক ধরে হামিদনগরে যেতে হয়, সেটি আধাপাকা। সড়কটি পাকা করার দাবি এলাকাবাসীর। হামিদুর রহমানের পরিবারের পক্ষ থেকে এ–সংক্রান্ত একটি আবেদন করা হয়েছিল। পরে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে সড়কটি পাকা করার সুপারিশ আসে। তার ভিত্তিতে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) কর্মকর্তারা সড়কটি পরিদর্শনও করেন। কিন্তু পরে আর কোনো অগ্রগতি নেই। এ ছাড়া সড়কটির প্রবেশমুখে খালিশপুর বাজারে বীরশ্রেষ্ঠর তথ্যসংবলিত একটি তোরণ নির্মাণের দাবি এলাকাবাসীর। তাঁরা বলছেন, এমন তোরণ থাকলে মানুষ সহজেই বুঝতে পারবেন, এই সড়কে বীরশ্রেষ্ঠর বাড়ি। এ ছাড়া বীরশ্রেষ্ঠর নামে গ্রামে প্রতিষ্ঠিত কলেজের পাশে ৩৭ বিঘা খাসজমি রয়েছে। সেখানে ইকোপার্কের দাবি হামিদুরের পরিবারের। তারা এ বিষয়ে আবেদন করেছিল বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব বরবার। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী ২০১৯ সালের ৯ এপ্রিল ওই আবেদনে সুপারিশও করেন। পরে পর্যটন মন্ত্রণালয় থেকে এ–সংক্রান্ত একটি চিঠি থেকে ট্যুরিজম বোর্ডে পাঠানো হয়েছে।

ভাতিজা মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, হামিদুর রহমানের মৃত্যুদিবসটি ঠিকমতো পালিত হয় না। তাঁর নামে প্রতিষ্ঠিত কলেজের কর্তৃপক্ষ প্রতিবছরের ২৮ অক্টোবর ছোটখাটো আয়োজন করে থাকে। সরকারিভাবে দিবসটি পালনের পাশাপাশি কলেজ প্রাঙ্গণে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের দাবি করেন তিনি।

ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, তিনি কয়েক দিন আগে বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের বাড়ি ও তাঁর নামে প্রতিষ্ঠিত কলেজ পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। এ সময় সেখানে পরিবারের পক্ষ থেকে ইকো পার্ক প্রতিষ্ঠার দাবি করা হয়েছে। এ ছাড়া বীরশ্রেষ্ঠের গ্রাম ঘিরে ছোট ছোট কয়েকটি বিষয় রয়েছে। এগুলো খোঁজখবর নিয়ে খতিয়ে দেখার পর তিনি ব্যবস্থা নেবেন।