বিজ্ঞাপন
default-image

সদালাপী ও মানবতাবাদী একজন চিকিৎসক ছিলেন শহীদ হোসেন আহমেদ। আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করার সময় তাঁকে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদার সেনারা। দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার মাত্র ১৮ দিন আগে একাত্তরের ২৮ নভেম্বর বিকেলে তিনি শহীদ হন।

শহীদ হোসেন আহমেদের জন্ম মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের শমশেরনগরে, ১৯২২ সালের ১ জানুয়ারি। তাঁর বাবার নাম শেখ মোহাম্মদ ছনু, মা সবজান বিবি। তাঁরা ছিলেন দুই ভাই। হোসেন আহমেদ ১৯৪৪ সালে কলকাতার দ্য রয়েল কলেজ অব ফিজিশিয়ান থেকে হোমিওপ্যাথির চিকিৎসার ডিগ্রি নেন। পরে ১৯৬৬ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি থেকেও হোমিওপ্যাথি বিষয়ে উচ্চতর
ডিগ্রি লাভ করেন। অনেক দুরারোগ্য রোগের নিরাময় করায় চিকিৎসক হিসেবে এলাকায় খ্যাতিমান ছিলেন তিনি। বয়স্ক বা তাঁর কাছে
আসতে না পারলে তিনি তাঁদের বাড়িতে গিয়ে চিকিৎসা করতেন। দরিদ্র রোগীদের কাছ থেকে কোনো অর্থ নিতেন না। চিকিৎসার পাশাপাশি
তিনি নিয়মিত লেখালেখি করতেন। স্থানীয় সাহিত্যাঙ্গনেরও অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি। তুর্কী তোফান নামে তাঁর একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। পত্রপত্রিকায় চিকিৎসা বিষয়ে নিবন্ধ লিখতেন।

কমলগঞ্জের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সিদ্দিকুর রহমান বলেন, সে সময়ের খ্যাতিমান চিকিৎসক ছিলেন হোসেন আহমেদ। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের মুন্সিবাজার ইউনিয়নের নারায়ণক্ষেত্র গ্রামে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে যুদ্ধে বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। তাঁরা যন্ত্রণায় আর্তনাদ করছিলেন। চিকিৎসার প্রয়োজন ছিল। এমন সময় হোসেন আহমেদ পাশের একটি গ্রামে রোগী দেখে ফিরছিলেন। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের কথা শুনে তিনি ঘটনাস্থলে গিয়ে তাঁদের চিকিৎসা দিতে শুরু করেন। স্থানীয় রাজাকাররা এটা দেখে ফেলে। তারা পাকিস্তানি সেনাদের কথাটি জানিয়ে দেয়। ঘাতক সেনারা ঘটনাস্থলে ফিরে এসে নির্বিচারে গুলি চালাতে থাকে। আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে চিকিৎসক হোসেন আহমদও ঘটনস্থলে শহীদ হন। সে সময় তাঁর লাশ শমশেরনগরে নিয়ে আসার কোনো সুযোগ ছিল না। ঘাতকের দল মৃত্যু নিশ্চিত করে চলে গেলে নারায়ণক্ষেত্র গ্রামের বাসিন্দারা সেই গ্রামেই তাঁকে দাফন করেন।

শহীদ চিকিৎসক হোসেন আহমেদের স্ত্রী রাবেয়া আহমেদ ও বড় মেয়ে হোসনে আরা আহমেদ ইন্তেকাল করেছেন। তাঁর একমাত্র ছেলে এ এইচ তোফায়েল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর বাবা হোসেন আহমেদের আত্মদানে সমবেদনা প্রকাশ করে দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁদের পরিবারের কাছে চিঠি ও আর্থিক অনুদান দিয়েছিলেন। তাঁর মা বঙ্গবন্ধুর স্বাক্ষরিত সেই স্বীকৃতিপত্র ও ২ হাজার টাকার চেক গ্রহণ করেছিলেন। এ ছাড়া মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধে বাবা ডা. হোসেন আহমেদের নামও খোদাই করে লেখা রয়েছে। ২০০৪ সালে তাঁর বাবার কবর সংরক্ষণের জন্য সমাজসেবা অধিদপ্তর উদ্যোগ নিয়েছিল। এ জন্য তাঁর সঙ্গে আলোচনাও হয়েছিল। কিন্তু পরে তা আর বাস্তবায়িত হয়নি। কবরটি সংরক্ষণ করা হোক, এটাই তাঁদের পরিবারের চাওয়া।

গ্রন্থনা: মুজিবুর রহমান, কমলগঞ্জ, মৌলভীবাজার