বিজ্ঞাপন
default-image

চিকিৎসাসেবার কথা বলে রাজাকাররা বাড়ি থেকে ডেকে নিয়েছিল চিকিৎসক হেমন্ত কুণ্ডুকে। পরে পাকিস্তানি হানাদার সেনারা তাঁকে নির্মম নির্যাতন করে আরও অনেকের সঙ্গে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে।

শহীদ হেমন্ত কুণ্ডু ছিলেন এলএমএফ চিকিৎসক। নীলফামারী শহরের বড় বাজারে ছিল তাঁর বাড়ি ও ওষুধের দোকান। এখানে বসেই তিনি রোগী দেখতেন। চিকিৎসার পাশাপাশি তিনি নীলফামারীর সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। ভালো গান গাইতে পারতেন। বাড়িতে গানের আসর করতেন। সরাসরি রাজনীতি না করলেও দেশের স্বাধীনতার পক্ষে সোচ্চার ছিলেন সব সময়। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহায়তা করেছেন।

নীলফামারী শহরের ডাকবাংলোতে ছিল হানাদার সেনাদের ক্যাম্প। একাত্তরের ১২ এপ্রিল সকালে রাজাকাররা হেমন্ত কুণ্ডুর বাড়িতে এসে জানায়, সেনাক্যাম্পে একজন মেজর অসুস্থ হয়ে পড়েছে, তাকে চিকিৎসা করতে যেতে হবে। হেমন্ত কুণ্ডুর এতে সন্দেহ হয়। তিনি নিজেই অসুস্থ—এ কথা বলে সেনাক্যাম্পে যেতে অসম্মতি জানান। বিকেলে স্থানীয় রাজাকার প্রধান অবাঙালি আবদুল্লাহর নেতৃত্বে একদল রাজাকার আবার হেমন্ত কুণ্ডুর বাড়িতে এসে তাঁকে সেনাক্যাম্পে যেতে চাপ দিতে থাকে। তারা বাড়ির লোকদের প্রতিশ্রুতি দেয় হেমন্ত কুণ্ডুর কোনো ক্ষতি হবে না। কিছুক্ষণ পরই তাঁকে ফেরত দিয়ে যাবে। একরকম জোর করেই তারা হেমন্ত কুণ্ডুকে বাড়ি থেকে নিয়ে যায়। এটাই ছিল তাঁর শেষ যাওয়া।

হেমন্ত কুণ্ডুর চার ছেলে ও ছয় মেয়ে। এখন শুধু এক মেয়ে আল্পনা কুণ্ডু (বর্তমান নাম আনোয়ারা বেগম) নীলফামারীতে থাকেন। মা-সহ অন্যরা সবাই ভারতে। আনোয়ারা বেগম প্রথম আলোকে তাঁর বাবা সম্পর্কে এসব তথ্য জানান। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি অষ্টম শ্রেণিতে পড়তেন। রাজাকাররা তাঁর বাবাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর সেনাক্যাম্পে প্রচণ্ড নির্যাতন করে আরও অনেকের সঙ্গে শহরের পাশেই দারোয়ানী জঙ্গলে নিয়ে হত্যা করে। বাবাকে হত্যার পর তাঁরা সবাই ভারতে পালিয়ে যান। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ফিরে আসেন। ১৯৭৩ সালে তিনি প্রতিবেশী আনোয়ার হোসেনকে বিয়ে করেন। মা উৎপলা কুণ্ডু জীবিত নেই। ভাইবোনদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ নেই।

হেমন্ত কুণ্ডুর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি রয়েছে আগামী প্রকাশনীর শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থে। আনোয়ারা বেগম দুঃখ করে বলেন, তাঁর বাবা সম্পর্কে এই এলাকায় সবাই জানেন। কিন্তু শহীদ হিসেবে তাঁর কোনো সরকারি স্বীকৃতি নেই।

নীলফামারী জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার শাহজাহান আলী বলেন, হেমন্ত কুণ্ডু এলাকার পরিচিত শহীদ। সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ না নিলেও মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহায়তা করেছেন। দারোয়ানী টেক্সটাইল মিলের পাশের বাঁশঝাড়ে অন্যদের সঙ্গে হেমন্ত কুণ্ডুকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এই গণকবর সংরক্ষণ করে তাঁরা এখানে শহীদদের নামের তালিকাসহ স্মৃতিফলক নির্মাণের দাবি করে আসছেন বহুদিন ধরে।

গ্রন্থনা: মীর মাহমুদুল হাসান, নীলফামারী