রাজনীতি–সচেতন ও সংস্কৃতিমান মানুষ ছিলেন হেম চন্দ্র সেন। পেশায় আইনজীবী, নেত্রকোনার নামকরা মোক্তার ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিবার নিয়ে শহরের বাসা ছেড়ে অবস্থান করছিলেন এক আত্মীয়ের বাড়িতে। একাত্তরের ৭ আগস্ট রাত ১১টার দিকে শহরের মোক্তারপাড়া এলাকার বাসা থেকে তাঁকে ধরে নিয়ে যায় অতিপরিচিত মুসলিম লীগের কয়েকজন নেতা। তারা তাঁকে তুলে দেয় পাকিস্তানি সেনাদের হাতে। গভীর রাতে তাঁকে মোক্তারপাড়া সেতুর ওপর নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়।
হেম চন্দ্র সেনের জন্ম ১৯০৫ সালে নেত্রকোনা সদর উপজেলার কাইলাটি গ্রামে। তাঁর বাবা আনন্দ কুমার সেন ছিলেন জোতদার। তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। হেম সেন নেত্রকোনা দত্ত উচ্চবিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন ও ময়মনসিংহ আনন্দ মোহন কলেজ থেকে আইএ পাস করে মোক্তারি সনদ নিয়ে আইন পেশায় নিয়োজিত হন। পাশাপাশি তিনি ‘বিজয়া টকিজ’ নামে একটি সিনেমা হলের অংশীদার ছিলেন। তাঁর অপর অংশীদার ছিলেন প্রকৃত মিত্র নামের এক ব্যক্তি। নেত্রকোনায় বিজয়া টকিজই প্রথম সিনেমা হল।
হেম চন্দ্র সেনের স্ত্রী সাধনা সেন এবং তিন মেয়ে মায়া সেন, ছায়া সেন, উমা সেন; দুই ছেলে মিহির কুমার সেন ও কাজল কুমার—তাঁরা কেউই এখন বেঁচে নেই। মিহির কুমার ছিলেন সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক। একাত্তরের ২৯ এপ্রিল স্বাধীনতাবিরোধীদের ইন্ধনে পাকিস্তানি সেনারা মিহির সেনকে ধরে নিয়ে পূর্বধলার ত্রিমোহনী সেতুতে গুলি করে হত্যা করে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় হেম চন্দ্র সেনরা তাঁদের নেত্রকোনা শহরের মোক্তারপাড়া এলাকার বাসা ছেড়ে পরিবার নিয়ে সদর উপজেলার মনকান্দিয়া গ্রামে আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু স্থানীয় পাকিস্তানপন্থী চিহ্নিত কুচক্রীরা হেম সেন ও তাঁর বড় ভাই আইনজীবী অখিল চন্দ্র সেনকে হত্যার নীলনকশা করে।
হেম চন্দ্র সেনের প্রতিবেশী ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা ইতিহাসবিদ হায়দার জাহান চৌধুরী প্রথম আলোকে জানান, সেদিন হেম সেনদের শত আর্তচিৎকারেও এগিয়ে আসেনি মুসলিম লীগের সেই ‘বন্ধুরা’। মূলত সেনদের গোটা পরিবারটি নিশ্চিহ্ন করে দেওয়াই ছিল দালাল-রাজাকারদের লক্ষ্য। এর পেছনে অবশ্য অন্য একটি উদ্দেশ্যও ছিল। অখিল সেন ও হেম সেনকে হত্যার পর তাঁদের সব স্থাবর সম্পত্তি লিখে দিতে চাপ দেওয়া হয়েছিল শহীদ পরিবারটিকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অবশ্য সে সুযোগ কাজে লাগাতে পারেনি ওই রাজাকাররা।
গতিধারা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ইতিহাসবিদ আলী আহাম্মদ খান আইয়োব তাঁর নেত্রকোনা জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গ্রন্থে শহীদ আইনজীবী হেম চন্দ্র সেনের জীবনী লেখা আছে। হেম সেনের ছেলে শহীদ মিহির কুমার সেনের স্ত্রী কৃষ্ণা সেন জানান, পরিবারের কাজের লোকসহ চারজনকে হত্যার পর তাঁরা বাসা ছেড়ে ভারতের বাগমারা শরণার্থীশিবিরে আশ্রয় নেন। দেশ স্বাধীন হলে বাসায় ফেরেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হেম সেনের স্ত্রী সাধনা সেনের কাছে সমবেদনা জানিয়ে চিঠি এবং প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল থেকে মহকুমা প্রশাসকের মাধ্যমে দুই হাজার টাকা পাঠিয়েছিলেন। এই টাকা পেয়ে তখন তাঁদের খুবই উপকার হয়েছিল।
গ্রন্থনা: পল্লব চক্রবর্তী, নেত্রকোনা।