বিজ্ঞাপন
default-image

গল্পপ্রিয় মানুষ ছিলেন অঙ্কের শিক্ষক সুমতি রঞ্জন বড়ুয়া। ভালো গান করতেন। এলাকায় পরিচিত ছিলেন ‘মাস্টারমশাই’ নামে। মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করতে মাস্টারমশাই হাতে অস্ত্র তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন যুদ্ধের ময়দানে। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়ের মাত্র ছয় দিন আগে ১০ ডিসেম্বর দুপুরে পাকিস্তানি বর্বর হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হন তিনি।

সুমতি রঞ্জন বড়ুয়ার জন্ম ১৯২৭ সালে বোয়ালখালী উপজেলার মধ্য শাকপুরা গ্রামে। তাঁর বাবার নাম ত্রিপুরা চরণ বড়ুয়া, মা প্রেমদা বালা বড়ুয়া। তিনি পড়াশোনা করেছিলেন শাকপুরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, শাকপুরা আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়ে। স্যার আশুতোষ মহাবিদ্যালয় থেকে তিনি উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছিলেন।

সুমতি রঞ্জন বড়ুয়া তৎকালীন পটিয়া উপজেলার চরকানাই বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের গণিতের শিক্ষক ছিলেন। ১৯৫৬ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত দীর্ঘ ১৬ বছর তিনি শিক্ষকতা করেছেন। শিক্ষাজীবনে ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। পরে যুক্ত হন কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতিতে। বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনেও সক্রিয় ছিলেন তিনি। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর শোষণের বিরুদ্ধে প্রথম থেকেই সোচ্চার ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে একাত্তরের জুলাই মাসে তিনি ভারতে চলে যান যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে। ভারতের ত্রিপুরার হাফলং থেকে অক্টোবরে প্রশিক্ষণ নিয়ে ফিরে এসে বোয়ালখালী ও পটিয়ায় তাঁর প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও পরিবারের কয়েকজন সদস্যকে প্রশিক্ষণ দেন। নিজেও ১ নম্বর সেক্টরে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশ নেন।

ওই সময় ১ নম্বর সেক্টরের ৩২ নম্বর গ্রুপের মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার ছিলেন বোয়ালখালী উপজেলার বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেন। তিনি সুমিত রঞ্জন বড়ুয়ার বীরত্ব সম্পর্কে তাঁর পরিবারকে একটি লিখিত হলফনামা দিয়েছিলেন। এতে তিনি জানান, ডিসেম্বরে পটিয়ার পাচুরিয়া, গৈরলার টেক, বোয়ালখালী থানার রাজাকার ক্যাম্পসহ আরও কয়েকটি এলাকায় তাঁরা সম্মুখযুদ্ধ করেন। একপর্যায়ে তাঁরা খবর পান, স্থানীয় রায়খালী সেতু পার হয়ে পাকিস্তানি বাহিনী এলাকায় প্রবেশ করবে। এ খবর পেয়ে ৯ ডিসেম্বর রাত একটায় সেতুটি বিস্ফোরক দিয়ে ধ্বংস করে দেন। হানাদারদের প্রতিরোধ করতে প্রায় ৪০ জন মুক্তিযোদ্ধা সেতুর পাশে অবস্থান নেন। পরদিন ১০ ডিসেম্বর বেলা একটার দিকে হানাদার বাহিনী সেতুর কাছে চলে এলে তাদের সঙ্গে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান সুমতি রঞ্জন বড়ুয়া।

সুমতি রঞ্জন বড়ুয়ার এক ছেলে, তিন মেয়ে। ছেলে সুমেধ তাপস বড়ুয়া বর্তমানে সরাইপাড়া সিটি করপোরেশন উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর বয়স ছিল সাত বছর। বাবার স্মৃতি খুব বেশি মনে নেই। তিনি বলেন, যুদ্ধে বাবার মাথায় গুলি লাগে। সন্ধ্যা পর্যন্ত তাঁর লাশ সেখানে পড়ে ছিল। পরে স্থানীয় লোকজন একটি পুকুরের পাড়ে লাশ মাটিচাপা দেন। নিয়ম মেনে সৎকারও করা যায়নি।

তাপস বড়ুয়া বলেন, ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর মাকে একটি চিঠি দিয়ে সমবেদনা জানান। সঙ্গে ছিল দুই হাজার টাকা। চিঠিতে বঙ্গবন্ধু লিখেছিলেন, ‘আপনার পরিবারের সদস্যের আত্মত্যাগের বিনিময়ে এ দেশে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। এটিকে জাতি আজীবন স্মরণ রাখবে।’

গ্রন্থনা: সুজয় চৌধুরী, চট্টগ্রাম