বিজ্ঞাপন
default-image

রংপুর কারমাইকেল কলেজের প্রভাষক শহীদ সুনীলবরণ চক্রবর্তী ছিলেন রাজনীতিসচেতন মানুষ। ছাত্রজীবনেই তিনি আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বরিশাল ব্রজমোহন কলেজের ছাত্র থাকা অবস্থায় ১৯৬২ সালে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়ায় তিনি গ্রেপ্তার হন। তখন দুই মাস তাঁকে কারাবরণ করতে হয়েছে।

খেলাধুলায়ও সুনীলবরণ চক্রবর্তীর গভীর আগ্রহ ছিল। চমৎকার লনটেনিস খেলতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে থাকার সময় ক্রিকেটার হিসেবেও বেশ খ্যাতি ছিল তাঁর।

১৯৭১ সালের ৩০ এপ্রিল। প্রভাষক সুনীলবরণ চক্রবর্তীকে রাতের আঁধারে রংপুরের কারমাইকেল কলেজের ক্যাম্পাস থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। কলেজ থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের পাশে দমদমা সেতুর কাছে তাঁর মরদেহ পাওয়া যায়।

কারমাইকেল কলেজ থেকে প্রকাশিত চেতনায় দ্রোহ নামের গ্রন্থে ওই কলেজের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মতিয়ার রহমান শহীদ সুনীলবরণ চক্রবর্তীকে নিয়ে লিখেছেন। সেখান থেকে এসব তথ্য পাওয়া যায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় কলেজের শিক্ষকদের হত্যার বিষয়ে গবেষণা করেছেন মতিয়ার রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সুনীলবরণ চক্রবর্তী ছিলেন অবিবাহিত। তিনি কলেজ ক্যাম্পাসের জি এল (গোপাল লাল) ছাত্রাবাসের উত্তর–দক্ষিণ প্রান্তের টিনশেডের একটি কক্ষে থাকতেন। বাংলা একাডেমির শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ গ্রন্থেও সুনীলবরণ চক্রবর্তীর সংক্ষিপ্ত জীবনী রয়েছে।

১৯৭১ সালের মার্চের শুরুতে বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পর সরকারি অফিস–আদালতের পাশাপাশি কারমাইকেল কলেজেরও ক্লাস বন্ধ হয়ে যায়। বেশির ভাগ অধ্যাপক ও কর্মচারী ক্যাম্পাস ত্যাগ করে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান।

১ মে শিক্ষকদের বেতন দেওয়া হবে জেনে সুনীলবরণ ৩০ এপ্রিল ক্যাম্পাসে ফিরে আসেন। ক্যাম্পাসে ফিরে সেদিন রাতে তিনি অধ্যাপক কালাচাঁদ রায়ের ক্যাম্পাসে অবস্থিত পূর্ব দিকের ৬ নম্বর বাসায় উঠেছিলেন। কিন্তু সেই রাতেই খবর পেয়ে হানাদার বাহিনী সেখানে হানা দেয়। তারা সুনীলবরণ চক্রবর্তী এবং অধ্যাপক কালাচাঁদ ও তাঁর স্ত্রী মঞ্জুশ্রী রায়কেও ধরে নিয়ে যায়। কলেজ থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে দমদমা সেতুর পাশে তাঁদের গুলি করে হত্যা করা হয়।

শহীদ সুনীলবরণ চক্রবর্তীর বাড়ি বরিশাল জেলা শহরের কাউনিয়া এলাকায়। জন্ম ১৯৪০ সালে। তাঁর বাবা ক্ষিতীশ চন্দ্র চক্রবর্তী ছিলেন সে সময় বরিশাল শহরের নামকরা আইনজীবী, মা কমলা চক্রবর্তী ছিলেন গৃহিণী। সুনীলবরণ ১০ ভাইবোনের মধ্যে চতুর্থ ছিলেন। বর্তমানে তাঁর দুই ভাই এবং পাঁচ বোন জীবিত আছেন। তাঁরা সবাই ভারতের কলকাতায় বসবাস করছেন।

সুনীলবরণ স্থানীয় প্রাথমিক স্কুলে পড়ালেখা শেষ করে ভর্তি হন বরিশাল জিলা স্কুলে। সেখান থেকে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন ১৯৫৬ সালে। বরিশাল ব্রজমোহন (বিএম) কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক ডিগ্রি নেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগে ভর্তি হন, ১৯৬৩ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে পরের বছর ১৯৬৪ সালে বরিশাল ব্রজমোহন কলেজের দর্শন বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। তাঁকে ১৯৬৭ সালে বদলি করা হয় রংপুরের কারমাইকেল কলেজে।

স্বাধীনতার পর কারমাইকেল কলেজের প্রশাসনিক ভবনের সামনে কলেজের পক্ষ থেকে শহীদ শিক্ষক-কর্মচারীদের স্মরণে একটি নামফলক তৈরি করা হয়েছে। সেখানে সুনীলবরণ চক্রবর্তীর নামও রয়েছে।

গ্রন্থনা: আরিফুল হক, রংপুর