বিজ্ঞাপন
default-image

শহীদ কামিনী কুমার চক্রবর্তী ছিলেন নির্লোভ, সদালাপী এক সহজ মানুষ। নেত্রকোনা শহরের চন্দ্রনাথ উচ্চবিদ্যালয়ে ইংরেজি ও গণিত পড়াতেন। শিক্ষার্থীদের নিয়ে লেখাপড়ায় মেতে থাকাই ছিল তাঁর প্রধান কাজ। ছাত্রদের কাছে খুব প্রিয় ছিলেন এই ‘কামিনী স্যার’। পড়ানোর ফাঁকে নিজে লেখালেখির চর্চা করতেন, অংশ নিতেন সামাজিক-সাংস্কৃতিক কাজে। স্বদেশি আন্দোলনের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন তিনি।

পাকিস্তানি হানাদাররা কামিনী চক্রবর্তীকে অমানুষিক নির্যাতন করেছিল। একাত্তরের ২৭ আগস্ট রাতে তাঁকেসহ আরও ২৫ জনকে পূর্বধলার ত্রিমোহনী সেতুতে নিয়ে যায় ঘাতকেরা। সেখানে হাত-পা, চোখ বেঁধে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে জখম করে। তারপর গুলি করে হত্যা করে মগড়া নদীতে লাশ ভাসিয়ে দেয়। কামিনী চক্রবর্তীর পরিবার তখন প্রাণভয়ে এলাকা ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছে ভারতের শরণার্থীশিবিরে। স্থানীয় স্বজনেরা তাঁর মরদেহ খুঁজে পাননি।

কামিনী চক্রবর্তীর বাড়ি নেত্রকোনার আটপাড়া উপজেলার পাহাড়পুর এলাকায়। জন্ম ১৯০৫ সালের ১ ডিসেম্বর। বাবা গৌরচন্দ্র চক্রবর্তী। কামিনী ১৯২২ সালে নেত্রকোনা দত্ত উচ্চবিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে এন্ট্রান্স পাস করেন। কলকাতা রিপন কলেজ থেকে ১৯২৪ সালে প্রথম বিভাগে আইএসসি, ১৯২৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও ১৯৩৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে স্নাতক ডিগ্রি নেন। কিন্তু আইন পেশায় বা সরকারি চাকরিতে না গিয়ে তিনি গ্রামে ফিরে শিক্ষকতায় আত্মনিয়োগ করেন। গ্রামের মানুষদের শিক্ষার আওতায় আনা আপন কর্তব্য মনে করতেন তিনি। তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনী রয়েছে বাংলা একাডেমির শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থে।

কামিনী চক্রবর্তীর স্ত্রী পূর্ণশশী চক্রবর্তী ১৯৮৬ সালে পরলোক গমন করেন। তাঁদের পাঁচ ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে বড় দুই ছেলে ও এক মেয়েও মারা গেছেন। ছেলেদের মধ্যে নিরঞ্জন চক্রবর্তী ভারতে দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। আর চিত্তরঞ্জন চক্রবর্তী সম্প্রতি ময়মনসিংহের মুমিনুন্নিসা সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে অবসর নিয়েছেন। ছোট ছেলে প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সচিব হিসেবে কর্মরত।

ছেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁরা প্রাথমিক স্কুলে পড়তেন। তাঁর বাবা ও বড় ভাই মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহায়তা করতেন। স্থানীয় দুই বিহারি রাজাকার বড়বাজার এলাকার বাড়ি থেকে একাত্তরের ২২ এপ্রিল তাঁর বাবা কামিনী কুমার ও কাকার ছেলে দুর্গাসুন্দর চক্রবর্তীকে ধরে নিয়ে যায়। দীর্ঘদিন কারাগারে রেখে তাঁর ওপর নির্যাতন চালানো হয়। ২৭ আগস্ট রাতে নেত্রকোনা পূর্বধলা সড়কের ত্রিমোহনী সেতুতে আরও ২৫ জনের সঙ্গে তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী জানান, দেশ স্বাধীন হলে নিজ বাড়িতে ফিরে আসেন তাঁরা। খুবই অভাবে পড়েছিলেন। এ সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাক্ষরিত একটি চিঠি পান। ওই চিঠিতে সমবেদনা জানিয়ে বঙ্গবন্ধু উল্লেখ করেন, প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল থেকে মহকুমা প্রশাসকের কাছে তাঁদের পরিবারের জন্য এক হাজার টাকা পাঠানো হয়েছে। সেই টাকা পেয়ে তাঁদের খুবই উপকার হয়েছিল। মা অনেক কষ্টে তাঁদের পড়ালেখা শিখিয়ে বড় করে তুলেছেন।

গ্রন্থনা: পল্লব চক্রবর্তী, প্রতিনিধি, নেত্রকোনা