বিজ্ঞাপন
default-image

শহীদ সতীশ চন্দ্র দেব ছিলেন ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার মুশুলি উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক। ওই গ্রামেই তাঁর বাড়ি। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়ের আগে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা তাঁকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়। নান্দাইলের বারুইগ্রামের একটি ইটভাটায় তাঁর লাশ পাওয়া যায়। সেখান থেকে লাশ মুশুলি গ্রামে এনে মুক্তিযোদ্ধারা শ্রদ্ধা জানান। এরপর শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয়।

নান্দাইল মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা বীর প্রতীক গাজী আবদুস সালাম ভূঁইয়া বলেন, মুশুলি গ্রামের সতীশ চন্দ্র দেবকে আলবদররা তাঁর বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করেছিল। তিনি এখানে সর্বজনপরিচিত শহীদ বুদ্ধিজীবী। শহীদ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ে তাঁর নাম পাঠানো হয়েছে।

সতীশ চন্দ্র দেবের বড় ছেলে সুজয় চন্দ্র দেবও বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ১৯৭১ সালে তিনি কলেজে পড়তেন। হানাদার পাকিস্তানি সেনারা একাত্তরে গণহত্যা শুরু করলে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। তাঁর বাবা সতীশ চন্দ্র দেব মুশুলি স্কুলে (এখন মুশুলি স্কুল অ্যান্ড কলেজ) শিক্ষকতার পাশাপাশি দেশের স্বাধিকার আন্দোলনের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর তিনি এলাকায় সংগ্রাম কমিটি গঠন করেছিলেন। এ ছাড়া রাজারবাগ থেকে পালিয়ে আসা একজন ইপিআর সদস্যের সহায়তায় মুশুলি বিদ্যালয়ের মাঠে তরুণদের নিয়ে বাঁশের লাঠি দিয়ে আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণে ব্যবস্থা করেন। এখানে প্রশিক্ষণ গ্রহণকারীদের মধ্য থেকে প্রায় ২৫ জনকে সশস্ত্র প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন সতীশ চন্দ্র দেব। তাঁর আরও অনেক ছাত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তা ছাড়া তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহায়তা করতেন। এসব কারণে রাজাকার-আলবদররা তাঁর বাবার ওপর ক্ষিপ্ত ছিল।

সুজয় চন্দ্র দেব বলেন, আলবদরের একটি দল একাত্তরের ৫ ডিসেম্বর রাতে মুশুলি গ্রাম ঘেরাও করে। তাঁর বাবা সতীশ চন্দ্র দেব তখন রাতের খাবার খাচ্ছিলেন। এ সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন মুশুলি উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক পবিত্র রঞ্জন রায় ও দশম শ্রেণির ছাত্র দ্বিগেন্দ্র চন্দ্র দাশ। আলবদরের কয়েকজন সদস্য বাড়িতে প্রবেশ করে তাঁদের তিনজনকে তুলে নিয়ে যায়। আলবদররা তাঁর মা জ্যোতি রানী দেবকে বলেন, ‘চিন্তা করবেন না, স্যারকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দেওয়া হবে।’

সুজয় চন্দ্র দেব আরও জানান, তাঁর বাবাকে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয় বারুইগ্রাম মাদ্রাসার আলবদরদের ক্যাম্পে। তাঁদের চোখ বেঁধে রাখা হয়েছিল। সেখান থেকে পবিত্র রঞ্জন কৌশলে পালিয়ে যান। সতীশ রঞ্জন এবং দ্বিগেন্দ্র চন্দ দাশকে ঘাতকেরা বারুইপাড়ায় ইটভাটায় নিয়ে হত্যা করে।

নান্দাইল শত্রুমুক্ত হয় ১১ ডিসেম্বর। সুজয় জানান, তাঁরা ক্যাম্পে গিয়ে বাবাকে খোঁজ করেন। সেখানে তাঁকে পাওয়া যায়নি। লোকমুখে শুনতে পান বারুইগ্রামের ইটভাটায় অনেক লাশ পড়ে আছে। সেখানে এক নারী সতীশ চন্দ্র দেবের মৃতদেহ চিনতে পেরেছেন। এই কথা শুনে তাঁরা ইটভাটায় গিয়ে বাবার মরদেহ পান। পরে মরদেহ মুশুলি গ্রামে আনা হয়। পরদিন ১২ ডিসেম্বর সতীশ চন্দ্র দেবকে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা শ্রদ্ধা জানান। মুশুলি উচ্চবিদ্যালয়ের সামনের পুকুরের পাড়ে তাঁকে দাহ করা হয়। তবে বধ্যভূমি বা বিদ্যালয়ে কোনো স্থানে সতীশ চন্দ্র দেবের কোনো স্মৃতিফলক নেই।

গ্রন্থনা: রমেশ কুমার, নান্দাইল, ময়মনসিংহ