বিজ্ঞাপন
default-image

একাত্তরের এপ্রিল। ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ শহরের নলডাঙ্গা ভূষণ পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পেছনে একটি জঙ্গলের মধ্যে তিনটি লাশ পড়ে ছিল। তাঁদের শরীরের অনেকটাই শিয়াল-কুকুরে খেয়েছে। দেখে চেনার উপায় নেই। স্থানীয় বাসিন্দা আবদুল কাদের লাশগুলো দেখে পাশে পড়ে থাকা স্যান্ডেলগুলো নিয়ে আসেন। সেই স্যান্ডেলগুলো দেখেই শহীদ শেখ মো. সামছুজোহার পরিবারের লোকেরা তাঁদের চিনতে পারেন।

লাশ তিনটি ছিল শহীদ শিক্ষক শেখ মো. সামছুজোহা, তাঁর বড় ভাই কৃষি কর্মকর্তা শেখ মো. রোস্তম আলী ও তাঁদের এক খালু নূর ইসলামের। সামছুজোহা ও নূর ইসলামকে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ শহরের নিশ্চিন্তপুর এলাকার বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় পাকিস্তানি সেনারা। আর যশোর-ঝিনাইদহ মহাসড়কের দুলালমুন্দিয়ায় প্রতিরোধযুদ্ধ চলাকালে আটক করা হয়েছিল রোস্তম আলীকে। রোস্তম আলীর ছেলে আমিরুল ইসলামও ছিলেন সেই যুদ্ধে।

শেখ মো. সামছুজোহা ছিলেন আট ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট। ১৯৪৪ সালে তাঁর জন্ম। বাবা মো. ওমর আলী। তিনি যশোর এম এম কলেজ থেকে বিএসসি পাস করেন। এরপর নলডাঙ্গা ভূষণ পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে (এখন সরকারি) শিক্ষকতা শুরু করেন। পরে কোটচাঁদপুর মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের বিএসসি শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। দরিদ্র ছাত্রছাত্রীদের বিনা অর্থে পড়াতেন। একাত্তরের ১৭ জানুয়ারি ঝিনাইদহ সদর উপজেলার গান্না গ্রামের মোড়ল বাড়ির মরহুম ছবেদ আলীর মেয়ে সখিনা খাতুনের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। দেশ স্বাধীনের পর তাঁদের মেয়ে ‘স্মৃতি’র জন্ম। আগামী প্রকাশনীর শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থে শেখ মো. সামছুজোহার জীবনী ও তাঁদের তিনজনের হত্যার বিবরণ রয়েছে।

রোস্তম আলীর ছেলে আমিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে জানান, মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর বয়স ছিল ১৫ বছর। বাবা রোস্তম আলী ছিলেন থানা কৃষি কর্মকর্তা। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তাঁর বাবা ও চাচা যুদ্ধের জন্য সবাইকে প্রস্তুত করতে থাকেন। হানাদার পাকিস্তানি সেনাদের হত্যা-নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে গেলে পরিবারের নারী ও শিশুদের ১১ এপ্রিল সামছুজোহার শ্বশুরবাড়ি গান্না গ্রামে রেখে আসা হয়। রোস্তম আলী ও সামছুজোহা শহরে এসে এলাকার যুবকদের সংগঠিত করতে শুরু করেন। যশোর সেনানিবাস থেকে ২০ এপ্রিল হানাদার সেনাদের একটি দল ঝিনাইদহ শহরে আক্রমণ করতে আসে। খবর পেয়ে স্থানীয় বীর জনতা যশোর-ঝিনাইদহ মহাসড়কের দুলালমুন্দিয়ায় হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে থাকেন। রোস্তম আলী তাঁর লাইসেন্স করা বন্দুক নিয়ে ছুটে যান সেখানে। আমিরুল ইসলামও বাবার সঙ্গে যান। সামছুজোহা ও নূর ইসলাম বাড়িতেই ছিলেন। প্রতিরোধযুদ্ধের একপর্যায়ে রোস্তম আলীকে হানাদাররা আটক করে। তবে আমিরুল পালিয়ে বেঁচে যান। পাকিস্তানি বাহিনী কালীগঞ্জ শহরে এসে তাঁদের বাড়ি থেকে সামছুজোহা ও নূর ইসলামকে তুলে নেয়।

আমিরুল জানান, অনেক খোঁজাখুঁজি করেও বাবা-চাচা-খালুকে তাঁরা খুঁজে পাননি। ঘটনার পাঁচ দিন পর নিশ্চিতপুর গ্রামের বাসিন্দা আবদুল কাদের নলডাঙ্গা ভূষণ পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পেছনে তিনটি লাশ পড়ে থাকার খবর শুনে দেখতে যান। লাশ চিনতে না পেরে স্যান্ডেলগুলো নিয়ে আসেন। সেগুলো দেখেই তাঁরা চিনতে পারেন। পরে ঘটনাস্থলে গিয়ে তিনজনের লাশ বস্তায় ভরে গান্নায় নিয়ে এসে দাফনের ব্যবস্থা করা হয়।

গ্রন্থনা: আজাদ রহমান, ঝিনাইদহ