বিজ্ঞাপন
default-image

একাত্তরে এ কে এম নূরুল হক ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান বেতার বিভাগের বিভাগীয় প্রকৌশলী (বেতার)। তাঁর কর্মস্থল ছিল ঢাকায়।

২৯ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল মহাখালীর ওয়্যারলেস ক্যাম্পাসে তাঁর সরকারি বাসা থেকে তাঁকে তুলে নিয়ে যায়।

এরপর তাঁর আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হয়, পাকিস্তান সেনাবাহিনী নির্যাতনের পর হত্যা করে তাঁকে অজ্ঞাত গণকবরে মাটিচাপা দিয়েছে।

অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে এ কে এম নূরুল হক পাকিস্তান সরকারের দেওয়া ‘তমঘা-ই-ইমতিয়াজ’ খেতাব পরিত্যাগ করেছিলেন।

এ ছাড়া এমন কথা প্রচলিত আছে যে ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর নামে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারে তাঁর প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল।

শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকায় অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য তিনি অধীনস্থ সহকারী প্রকৌশলীর সহযোগিতায় এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ওই রাতে সম্প্রচারিত বার্তাগুলো সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগ শনাক্ত (ইন্টারসেপ্ট) করে তাঁকে আটক করে।

সাবেক সচিব নূরুদ্দিন আহমদের আত্মজীবনী জীবনের বনে বনে-তে তাঁর সম্পর্কে তথ্য রয়েছে। নূরুদ্দিন আহমদ লিখেছেন: ‘...খোকা (এ কে এম নূরুল হক) ও তার সহকর্মী লোকমান হোসেন সাহেব মার্চ মাসের অসহযোগ আন্দোলনের সময় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখত। এদের দুজনকে বাসা থেকে সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের কোনো খবর তখন পর্যন্ত কেউ জানে না। লোকমান সাহেব সত্যি ভাগ্যবান, যুদ্ধের নয় মাস বন্দী অবস্থায় থেকেও প্রাণে বেঁচে যান। খোকা আর কোনো দিন ফিরে আসেনি।’

ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম তাঁর ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও আমাদের সংবিধান’ রচনায় লিখেছেন, ‘...২৫ মার্চ বেলা গড়িয়ে দুইটা বা আড়াইটার সময় ইঞ্জিনিয়ার নূরুল হক সাহেবের সঙ্গে আমার শেষ সাক্ষাৎ।

...পূর্বের একটি আলোচনার সূত্র ধরে তিনি বললেন বঙ্গবন্ধু আমাকে একটি ট্রান্সমিটার আনতে বলেছিলেন। সেটি খুলনা থেকে আমি আনিয়ে রেখেছি।

আমি এখন ওটা দিয়ে কী করব, সে বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে নির্দেশনা চাই।’

তাজউদ্দীন আহমদের মেয়ে শারমিন আহমদ লিখিত নেতা ও পিতা বইয়ে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহযোগী হাজি গোলাম মোর্শেদের সাক্ষাৎকারে এ সম্পর্কে কিছু তথ্য রয়েছে।

তিনি বলেন, ‘এরপর এগারোটা বেজে গেল, বারোটা বাজে বাজে এমন সময় একটি টেলিফোন আসল, বলে আমি বলধা গার্ডেন থেকে বলছি। মেসেজ পাঠানো হয়ে গিয়েছে।

মেশিনটি কী করব? আমি দৌড়ে মুজিব ভাই-এর কাছে গেলাম, বললাম মেজেস পাঠানো হয়ে গেছে। উনি (বঙ্গবন্ধু) বললেন, মেশিনটি ভেঙে ফেলে পালিয়ে যেতে বলো।’

এ কে এম নূরুল হকের জন্ম ১৯২২ সালের ১০ জুলাই। পৈতৃক নিবাস কুষ্টিয়া সদর উপজেলার যুগিয়া গ্রামে। মা নূরজাহান বেগম, বাবা শেখ ইসমাইল। ১৯৩৮ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ম্যাট্রিক পাস করেন।

এরপর কলকাতার সিগন্যালিং স্কুলে প্রশিক্ষণ শেষে ১৯৪৩ সালে ইন্ডিয়ান পোস্ট অ্যান্ড টেলিগ্রাফ ডিপার্টমেন্টে যোগ দেন।

১৯৪৬-৫১ সাল পর্যন্ত ইন্ডিয়ান সিভিল এভিয়েশন বিভাগে অ্যারোনটিক্যাল ট্রাফিক অপারেশনের জন্য রেডিও ইক্যুইপমেন্ট সংস্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজে প্রেষণে নিয়োজিত ছিলেন।

১৯৫১ থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম কোস্টাল স্টেশনে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

এ সময় অস্ট্রেলিয়ায় রেডিও টেলিকমিউনিকেশনের ওপর উচ্চতর প্রশিক্ষণ নেন। পাকিস্তানের হরিপুর স্টাফ কলেজে থাকা অবস্থায় ১০০ ওয়াট থেকে ৫ কিলোওয়াট পর্যন্ত বিভিন্ন রেডিও কমিউনিকেশন সিস্টেমের যন্ত্রপাতি ডিজাইন ও প্রযুক্তির ব্যবহার উদ্ভাবন করেন।

এ কাজের জন্যই ১৯৬১ সালে তিনি ‘তমঘা-ই-ইমতিয়াজ’ খেতাব পেয়েছিলেন। ১৯৬৩ সালের প্রথমার্ধে বিভাগীয় প্রকৌশলী হিসেবে পদোন্নতি ও বদলি হয়ে ঢাকার ইস্টার্ন ওয়্যারলেস ডিভিশনে আসেন।

এ কে এম নূরুল হকের দুই স্ত্রী হালিমা খাতুন ও নাসরিন বানু। তাঁর এক ছেলে ও পাঁচ মেয়ে।

ছেলে এ কে এম জিয়াউল হক বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে উইং কমান্ডার হিসেবে কর্মরত। মেয়ে নূর বানু, নূর আকতার, নূরুন নিহার, নূরুন নেসা ও নূর আফজার।

সূত্র: মোজাম্মেল হক (শহীদ এ কে এম নূরুল হকের জ্যেষ্ঠ জামাতা)। স্কেচ: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (নবম পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (২০০০) থেকে।

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান

সূত্র: ১০ জানুয়ারি, ২০১৫ সালে প্রথম আলোতে প্রকাশিত