বিজ্ঞাপন
default-image

মাগুরার শহীদ লুৎফর রহমান ছিলেন তুখোড় ফুটবল খেলোয়াড়, সাংস্কৃতিক সংগঠক ও রাজনৈতিক প্রশিক্ষক। রাজনৈতিক পাঠচক্রের নেতৃত্ব দিতেন। মনেপ্রাণে সমাজতন্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সম্ভাবনা বুঝতে পেরে লুৎফর স্থানীয় তরুণদের সংগঠিত করে আগেই গ্রামের আমবাগানে ডামি রাইফেল নিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করেন।

একাত্তরের ১৯ জুলাই। ফজরের নামাজ আদায় করে মাগুরার পারনান্দুয়ালীর ভীতসন্ত্রস্ত মুক্তিকামী মানুষেরা মসজিদ থেকে ঘরে ফিরছেন। চারদিকে কিচিরমিচির করছে পাখপাখালি। ঠিক তখনই সশস্ত্র রাজাকারের দল তুলে নিয়ে যায় মুক্তিযোদ্ধা লুৎফর রহমানকে। পিঠমোড়া করে বেঁধে নিয়ে যাওয়ার সময় রাজাকাররা বলেছিল, কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু রাজাকাররা কথা রাখেনি।

শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে তথ্য পাঠানোর আহ্বান জানিয়ে প্রথম আলোতে বিজ্ঞাপন ছাপা হলে মাগুরার মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক জাহিদ রহমান শহীদ লুৎফর রহমানের ছবি ও তথ্য পাঠান। তাঁর লেখা মুক্তিযুদ্ধে মাগুরার শত শহীদ বইয়ে শহীদ লুৎফর রহমানের জীবনী ও তাঁর ভূমিকার কথা রয়েছে।

লুৎফর রহমানের বাবা ব্যবসায়ী মুন্সী ইয়াদ আলী, মা জোবাইদা খাতুন। বাড়ি মাগুরা সদর উপজেলার পারনান্দুয়ালী গ্রামের ব্যাপারীপাড়ায়। রাজনীতিসচেতন টগবগে তরুণ লুৎফর রহমান একসময় মাগুরা থানা পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন গ্রুপ) সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। মাগুড়া মহকুমা ফুটবল দলের নিয়মিত খেলোয়াড় ছিলেন তিনি। সাংস্কৃতিক আয়োজন ও সংগঠনের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন।

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শহীদ লুৎফর রহমানের বাবার কাছে চিঠি দিয়ে তাঁর ছেলের আত্মদানের জন্য সমবেদনা প্রকাশ করেন এবং প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে দুই হাজার টাকা অনুদান দেন। পরে স্থানীয় তরুণ সংঘের নামকরণ করা হয় লুৎফর রহমান এবং আরও দুই শহীদ তাজুল ইসলাম ও শরীফুল ইসলামের নাম মিলিয়ে ‘লুতাশ সংঘ’।

লুৎফর রহমানের পরিবার ও রাজনৈতিক সহকর্মীদের কাছ থেকে জানা গেছে, মাগুরা থানা সদরের কুখ্যাত রাজাকার রিজু ও কবীরের নেতৃত্বে একটি চক্র এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করতে তৎপর হয়ে ওঠে। নিরাপত্তার অভাব বোধ করে লুৎফর রহমান তখন বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপন করে যুদ্ধে অংশ নিতেন। এভাবেই ১৮ জুলাই রাতে তিনি তাঁর বোনের মেয়ে সুরাইয়া বেগমের বাড়িতে আশ্রয় নেন। রাজাকাররা গোপনে এই খবর জানতে পেরে ১৯ জুলাই খুব ভোরে বাড়িটি ঘিরে ফেলে।

লুৎফর রহমান ঘর থেকে বেরিয়ে এলে মুখোশধারী রাজাকাররা তাঁকে আটকে ফেলে। একজন রাজাকার পাশেই কুয়া থেকে পানি তোলার বালতির দড়ি খুলে এনে সবার সামনেই লুৎফরকে পিঠমোড়া করে বেঁধে ফেল। তারপর তার দুচোখও বাঁধা হয়।

লুৎফরকে তুলে নিয়ে যাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে তাঁর আত্মীয়রা বিভিন্ন জায়গায় খুঁজতে থাকেন। কিন্তু খোঁজ পাননি। তাঁদের ধারণা, রাজাকাররা লুৎফরকে শহরের পিটিআইয়ে অবস্থিত পাকিস্তান বাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্রে নিয়ে যায়। সেখানে তাঁকে হত্যা করে নবগঙ্গা নদীতে লাশ ফেলে দেয়। একই দিন এই নির্যাতনকেন্দ্রে শহরের তাঁতিপাড়া থেকে মুক্তিযোদ্ধা কবীর হোসেনকে তুলে এনে হত্যা করেছিল রাজাকাররা। অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে এই নির্যাতনকেন্দ্রে হত্যা করে নবগঙ্গা নদীতে লাশ ফেলে দিত বর্বর রাজাকার ও পাকিস্তান সেনারা।

গ্রন্থনা: কাজী আশিক রহমান, মাগুরা