কুষ্টিয়া জেলার দর্শনা কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন লতাফত হোসেন জোয়ার্দার। একাত্তরের ফেব্রুয়ারি মাসে এই কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন। অল্প দিনেই শিক্ষার্থী, সহকর্মী ও স্থানীয় মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সেখানে তাঁর উপস্থিতি এক নতুন মাত্রা লাভ করে।
দর্শনা বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকা। মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে তাঁর ছাত্র ও স্থানীয় তরুণ-যুবকদের সীমান্তের ওপারে পাঠাতে তিনি সচেষ্ট ছিলেন।
সীমান্তবর্তী হওয়ায় সেখানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তৎপরতাও ছিল বেশি। এ রকম বিপৎসংকুল অবস্থায়ও তাঁর কাজ থেমে থাকেনি। মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করতে বিভিন্ন স্থানে ছুটে বেড়িয়েছেন। মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে ইচ্ছুক ছেলেদের খাবার ও টাকাপয়সা দিয়ে সাহায্য করেছেন।
৩১ জুলাই দর্শনার কয়েকজন স্থানীয় রাজাকার লতাফত হোসেন জোয়ার্দারকে তাঁর অস্থায়ী আবাস থেকে ডেকে নিয়ে যায়। এ সময় দুই সহকর্মীসহ তিনি খেতে বসেছিলেন। এরপর তিনি ও তাঁর দুই সহকর্মী আর ফিরে আসেননি।
এ ঘটনা সম্পর্কে জানা যায় তাঁর স্ত্রী হোসনে আরার কাছ থেকে। তিনি জানান, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় সন্তানদের নিয়ে আমি ছিলাম শ্বশুরবাড়ি ঝিনাইদহের কাষ্টসাগরে। আর আমার স্বামী ছিলেন দর্শনায়। তিনি অধ্যক্ষের বাসায় না থেকে কয়েকজন সহকর্মীসহ দর্শনারই অন্যত্র থাকতেন। জুলাই মাসের ২১/২২ তারিখের দিকে তিনি কাষ্টসাগরে আসেন আমাদের দেখতে। কয়েকদিন পর তাঁর ডাক আসে দর্শনা থেকে। আমি তাঁকে বারণ করলাম। তিনি বললেন, “দর্শনায় আমার অনেক কাজ। আমাকে যেতেই হবে।” ৩১ জুলাই সকাল দশটার দিকে ছেলেমেয়েকে আদর ও বাবা-মাকে সালাম করে আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যান দর্শনাতে।
‘ওই দিনই তিনি দর্শনায় পৌঁছে হাতমুখ ধুয়ে ভাত সামনে নিয়ে খেতে বসেছিলেন। এমন সময় কয়েকজন রাজাকার তাঁর অস্থায়ী আবাসে আসে। তারা জানায় নিকটস্থ সেনাক্যাম্পের মেজর তাঁকে ডেকেছেন কিছু কথা বলার জন্য। আমার স্বামী ও তাঁর দুই সহকর্মী খাবার খেয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রাজাকাররা জানায়, ‘‘জরুরি সমন। এখনই যেতে হবে। ফিরে এসে খাবেন।’’ সুস্থ সবল তিনজন মানুষ সেই যে গেলেন আর ফিরলেন না। তারপর আর তাঁদের খোঁজই পাওয়া গেল না। না জীবিত, না মৃত।
‘আমার স্বামী সরাসরি যুদ্ধ করেননি। কিন্তু প্রত্যক্ষভাবে অবদান রেখেছেন। আমি তাঁকে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে চলে যেতে বলেছি। কিন্তু তিনি যাননি। জবাব দিয়েছেন, ‘‘আমি এখানে না থাকলে ওদের সাহায্য করবে কে? অনেক সময় ওদের আমার প্রয়োজন হয়। ওদের এখানে রেখে আমি নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে পারি না।’’ শেষ পর্যন্ত দর্শনাই তাঁর চিরকালের ঠিকানা হয়ে গেল।’ (সাক্ষাৎকার ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫)।
লতাফত হোসেন জোয়ার্দারের জন্ম ১৯৪০ সালের ১ মার্চ, কুষ্টিয়া জেলার কাষ্টসাগরে। বাবা খিলাফত হোসেন জোয়ার্দার, মা আয়েশা খাতুন। তাঁর বাবা একটানা ২৬ বছর স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। পড়াশোনা শুরু হয় গ্রামের স্কুলে। ১৯৫৮ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করে ভর্তি হন ঝিনাইদহের কে সি কলেজে। এখান থেকে প্রথম বিভাগে ইন্টারমিডিয়েট (১৯৬০) ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে বিএ (ইংরেজি, ১৯৬৩) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে দ্বিতীয় শ্রেণিতে এমএ (১৯৬৪) পাস করেন।
এমএ পরীক্ষার পর তিনি কিছুদিন গাজীপুরের কাপাসিয়া কলেজে শিক্ষকতা করেন। পরে সেন্ট্রাল সুপিরিয়র সার্ভিস পরীক্ষা দিয়ে তৎকালীন অস্ট্রেলেশিয়া ব্যাংকে (বর্তমানে রূপালী ব্যাংক) যোগ দেন। পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোরে প্রশিক্ষণ নেওয়ার সময় তিনি উপলব্ধি করেন, পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি চরম অবিচার, বৈষম্য ও শোষণ করা হচ্ছে। এই উপলব্ধিই তাঁকে আবার শিক্ষকতায় ফিরিয়ে আনে।
১৯৭০ সালের আগস্টে বরিশালের কলসকাঠি কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন। একাত্তরের ফেব্রুয়ারিতে যোগ দেন দর্শনা কলেজে। তাঁকে দর্শনার লোকজন এখনো শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। তিনি দুই ছেলে ও এক মেয়ের জনক। ছেলে জোয়ার্দার মো. জিয়া হাসান ও জোয়ার্দার মো. হাসানুর রহমান। মেয়ে শার্মিন জোয়ার্দার। তাঁরা সবাই প্রবাসী।
স্কেচ: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (অষ্টম পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (১৯৯৯) থেকে।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
[email protected]