বিজ্ঞাপন
default-image

রামচন্দ্র তালুকদার ছিলেন পল্লিচিকিৎসক। রাজনীতি-সচেতন ও সহজ প্রাণের এই চিকিৎসক নেত্রকোনা সদর উপজেলার লক্ষ্মীগঞ্জ ইউনিয়নের বিরামপুর বাজারে একটি ওষুধের দোকানে বসে এলাকাবাসীকে চিকিৎসা দিতেন। এ ছাড়া অসুস্থতার খবর পেলে রোগীদের বাড়ি বাড়ি গিয়েও চিকিৎসা করতেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি যুদ্ধে অংশ নিতে লোকজনকে উদ্বুদ্ধ করা, আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা, তথ্য আদান-প্রদানসহ নানাভাবে সহযোগিতা করতেন।

একাত্তরের ১৪ নভেম্বর দুপুরে বিরামপুর বাজার থেকে এলাকার রাজাকার ও আলবদরের দল তাঁকে বেঁধে অস্ত্রের মুখে লক্ষ্মীগঞ্জ বাজারসংলগ্ন খেয়াঘাটে নিয়ে আসে। তুলে দেয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে। তাঁর পরিচয় জেনেই ঘাতকেরা সেখানেই গুলিতে ঝাঁঝরা করে তাঁর লাশ ভাসিয়ে দেয় সাইডুলি নদে। স্বজনেরা আর লাশের সন্ধান পাননি।

রামচন্দ্র তালুকদার ১৯১১ সালে ময়মনসিংহে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন ঈশান চন্দ্র তালুকদার ও মলিনা তালুকদারের একমাত্র সন্তান। তিনি ময়মনসিংহের একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে পল্লিচিকিৎসক হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি নেন। এরপর ১৯৩০ সালে নেত্রকোনা সদর উপজেলার বাইশধার গ্রামের পরান দেবরায়ের বড় মেয়ে বকুলবালা দেবরায়ের সঙ্গে পরিণয়ে আবদ্ধ হন। পরান দেবরায়ের ছেলেসন্তান না থাকায় রামচন্দ্র তালুকদারকে নিজ বাড়িতে রেখে দেন। রামচন্দ্র তালুকদার চিকিৎসক হিসেবে ওই এলাকায় খুবই খ্যাতি লাভ করেন। তাঁর ডাকনাম ছিল লেবু। তিনি ‘লেবু ডাক্তার’ নামের এই অঞ্চলে পরিচিত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি যুদ্ধে অংশ নিতে লোকজনকে উদ্বুদ্ধ করা, আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা, তথ্য আদান-প্রদানসহ নানাভাবে সহযোগিতা করতেন।

একাত্তরের ১৪ নভেম্বর দুপুরে বিরামপুর বাজারে আবদুল মালেকের ওষুধের দোকানে পেছনে যে কক্ষে বসে রামচন্দ্র তালুকদার চিকিৎসা করতেন, সেখানে বদিউজ্জামানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা গোপন সভা করছিলেন। স্থানীয় রাজাকার ও আলবদররা এই খবর পেয়ে যায়। তারা সেখানে অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে হামলা করে। রামচন্দ্রসহ মোট ছয়জনকে খুনির দল তুলে নিয়ে যায়। অন্য পাঁচজন হলেন নরেন্দ্রনগর গ্রামের বদিউজ্জামান, বিরামপুরের আবদুল মালেক, একই গ্রামের বাসিন্দা ব্যাংক কর্মচারী মিজানুর রহমান, কামারগাতির ইসলাম উদ্দিন ও সিদ্দিকুর রহমান। তাঁদের মধ্যে মিজানুর রহমান ছাড়া অন্য পাঁচজনকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করে।

ইতিহাসবিদ আলী আহাম্মদ খান আইয়োবের নেত্রকোনা জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গ্রন্থে পল্লিচিকিৎসক শহীদ রামচন্দ্র তালুকদারের জীবনী রয়েছে। এ ছাড়া মুক্তিযোদ্ধা বদিউজ্জামান হত্যার ঘটনায় তাঁর ভাতিজা মো. আলী রেজা কাঞ্চন বাদী হয়ে ২০১০ সালের ১২ আগস্ট নেত্রকোনা জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালত-১-এ হত্যা মামলা করেন। মামলায় বদিউজ্জামান, রামচন্দ্রসহ অন্যদের কথা উল্লেখ আছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ২০১৬ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ওই মামলার রায় ঘোষণা করেন। এতে ১২ জন আসামির মধ্যে দুজন আসামিকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত। আসামিরা উচ্চ আদালতে আপিল করেছেন।

রামচন্দ্র তালুকদার নিঃসন্তান ছিলেন। তাঁর স্ত্রী বকুলবালা ২০০১ সালে পরলোকগমন করেন। তাঁর বোন মালতীবালা দেবরায়ের ছেলে সুবোধ চন্দ্র দেবরায় প্রথম আলোকে বলেন, রামচন্দ্র তালুকদারকে হত্যার পর তাঁর মাসি বকুলবালা আমৃত্যু তাঁদের বাড়িই ছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বকুলবালাকে সমবেদনা জানিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি চিঠি পাঠান। এর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল থেকে তাঁদের পরিবারের জন্য মহকুমা প্রশাসকের মাধ্যমে দুই হাজার টাকা পাঠানো হয়েছিল। তাঁর মাসির আশা ছিল, তাঁর স্বামী শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে সরকারি স্বীকৃতি পাবেন এবং হত্যাকারীদের সাজা দেখে যাবেন, কিন্তু তাঁর সেই আশা পূরণ হয়নি।

গ্রন্থনা: পল্লব চক্রবর্তী, নেত্রকোনা