বিজ্ঞাপন
default-image

বাড়ির আঙিনায় লোকজনের চড়া গলার আওয়াজে ঘুম ভাঙে রমেশ চন্দ্র দাস ও তাঁর স্ত্রী সরযূ বালা দাসের। খানিক পরেই দরজায় বুটপরা পায়ের লাথি। সরযূ দরজা খুলে দিতেই পাকিস্তানি সেনারা রমেশ চন্দ্রকে ঘর থেকে বের করে নিয়ে যায়। পরে তাঁকেসহ পরিবারের তিন সদস্যকে ব্যাপক নির্যাতন করে হত্যা করা হয়।

শহীদ রমেশ চন্দ্র দাসের জন্ম ১৯১৩ সালে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার শ্রীসূর্য্য গ্রামে। পিতা রাম শরণ দাস। তাঁদের পৈতৃক বাড়িটি গ্রামে ‘মহাজন বাড়ি’ নামে খ্যাত।

কমলগঞ্জের মুন্সিবাজার মাইনর স্কুল থেকে পরীক্ষা দিয়ে মাইনর বৃত্তি লাভ করেন তিনি। ১৯৩১ সালে মৌলভীবাজার গভর্নমেন্ট হাইস্কুল থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। এরপর সিলেট মুরারি চাঁদ কলেজে উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। অর্থ-খ্যাতির মোহ তাঁর ছিল না। গ্রামের ছেলেমেয়েদের শিক্ষিত করে তোলার তাগিদ অনুভব করেছিলেন তিনি। সরকারি চাকরি না করে গ্রামে ফিরে শিক্ষকতায় ব্রতী হন তিনি। কমলগঞ্জ হাইস্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। এই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তাঁরই কলেজজীবনের বন্ধু রতীশ চন্দ্র দত্ত। দুই বন্ধু মিলে স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেন।

রমেশ চন্দ্র সম্পর্কে এসব তথ্য জানিয়েছেন মৌলভীবাজারের লোক গবেষক ও লেখক অমলেন্দু কুমার দাশ। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের অবদান সম্পর্কে তথ্য চেয়ে প্রথম আলোর বিজ্ঞাপন ছাপা হলে তিনি রমেশ চন্দ্র দাসের ছবিসহ বিস্তারিত তথ্য পাঠিয়েছেন।

অমলেন্দু কুমার দাশ জানান, অনুপম প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত তাঁর লেখা মুক্তিযুদ্ধে মৌলভীবাজার এবং কানাডাপ্রবাসী মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক তাজুল মোহাম্মদ সম্পাদিত, সাহিত্য প্রকাশ থেকে প্রকাশিত একাত্তরের স্মৃতিগুচ্ছ বইতে শহীদ রমেশ চন্দ্র দাসের অবদান এবং শহীদ হওয়ার ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। পরে তাঁর দেওয়া তথ্য নিয়ে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে খোঁজ করা হয়।

জানা গেছে, রমেশ চন্দ্র দাস গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করতেন। এ কারণে এলাকার রাজাকাররা তাঁর ওপর ক্ষিপ্ত ছিল। একাত্তরের ১৬ মে ভোররাতে স্থানীয় রাজাকার আবদুল বারি ও খলিলুর রহমানের নেতৃত্বে পাকিস্তানি ঘাতক হানাদার বাহিনী রমেশ চন্দ্র দাসের বাড়িতে হানা দেয়। তারা রমেশ চন্দ্র দাস, তাঁর দুই ছেলে, দুই ভাই ও এক ভাতিজাকে ধরে নিয়ে যায়। আরও অনেকের সঙ্গে তাঁদের শমশেরনগর ডাকবাংলোয় এনে একটি কক্ষে আটকে রেখে অমানুষিক নির্যাতন করে। পরে রমেশ চন্দ্র দাস তাঁর চাচাতো ভাই যোগেশ চন্দ্র দাস ও কৃপেশ রঞ্জন দত্তকে হত্যা করা হয়।

অমলেন্দু কুমার জানান, রমেশ চন্দ্র শহীদ হওয়ার পর রাজাকাররা তাঁর ঘরবাড়ি লুট করে জ্বালিয়ে দেয়। প্রাণভয়ে তাঁর স্ত্রী সরযূ বালা সন্তানদের নিয়ে ভারতের শরণার্থীশিবিরে আশ্রয় নেন। স্বাধীনতার পর তাঁরা দেশে ফিরে খুবই সংকটময় অবস্থায় পড়ে যান। এ সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শহীদ শিক্ষক রমেশ চন্দ্র দাসের স্ত্রীর কাছে একটি শোকবার্তা ও নগদ দুই হাজার টাকা পাঠিয়েছিলেন (শোকবার্তাটি তাঁদের কাছে এখনো সংরক্ষিত আছে)। সরযূ বালা দাস ২০১৪ সালে মারা যান।

গ্রন্থনা : মুজিবুর রহমান, কমলগঞ্জ, মৌলভীবাজার