বিজ্ঞাপন
default-image

পাকিস্তানি শাসনামলে সামাজিক কুসংস্কারের বৃত্ত ভেঙে নারী অধিকার, শিক্ষা, মর্যাদা ও রাজনৈতিক নেতৃত্বে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার ব্রত নিয়ে এগিয়ে আসেন মানিকগঞ্জের যোগমায়া চৌধুরী। তাঁর ডাকনাম ছিল ‘কালী’। মানিকগঞ্জবাসীর কাছে তিনি ছিলেন প্রিয় ‘কালীদি’। নারীদের খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক চর্চা ও সামাজিক কর্মকাণ্ডসহ নারী জাগরণের সংগ্রামী কর্মতৎপরতায় তিনি ছিলেন অগ্রণী ভূমিকায়। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে তিন ছেলেকে পাঠিয়েছিলেন রণাঙ্গনে।

এসব কারণে একাত্তরে হানাদার পাকিস্তানি সেনারা মানিকগঞ্জ শহরে ঢুকে প্রথমেই যোগমায়া চৌধুরীর বাড়িতে হামলা চালায়। লুটপাট করে পুড়িয়ে দেয়। তিনি অবশ্য বাড়িতে ছিলেন না। ধামরাইয়ে আত্মগোপন করেছিলেন। রাজাকারদের সহায়তায় সেখান থেকে পাকিস্তানি সেনারা যোগমায়া চৌধুরীকে তুলে আনে। এরপর ব্যাপক নির্যাতন করে ধামরাইয়ের বারবাড়িয়া এলাকায় একটি সেতুর ওপর বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে ও গুলি করে তাঁকে হত্যা করে।

প্রথম আলোতে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে তথ্য পাঠানোর আহ্বান জানিয়ে বিজ্ঞাপন ছাপা হলে শহীদ যোগমায়া চৌধুরীর ছবি ও তাঁর সম্পর্কে তথ্য পাঠিয়েছেন মানিকগঞ্জের খাবাশপুর ডিগ্রি কলেজের বাংলা বিভাগের প্রভাষক মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর। তিনি মানিকগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধ ও শহীদদের নিয়ে দীর্ঘদিন থেকে গবেষণা করছেন। স্মৃতি ও শ্রুতিতে মানিকগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধ নামে তাঁর একটি বইও প্রকাশিত হয়েছে।

যোগমায়া চৌধুরীর জন্ম ১৯১৪ সালে। মানিকগঞ্জ শহরের গঙ্গাধরপট্টির প্রাসাদোপম বাড়িতে তাঁর শৈশব ও কৈশোরের দিনগুলো কেটেছে। ধামরাইয়ের ঐতিহ্যবাহী চৌধুরী পরিবারের সন্তান প্রথিতযশা আইনজীবী যশোদা চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়।

মানিকগঞ্জের সাবেক পৌর মেয়র ও প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধা গাজী কামরুল হুদা প্রথম আলোকে বলেন, গঙ্গাধরপট্টির এই ‘চৌধুরী বাড়ি’ সেই সময় ছিল মানিকগঞ্জের রাজনীতি, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক চর্চার প্রাণকেন্দ্র। অনেক বিখ্যাত বিপ্লবী ও বরেণ্য রাজনীতিক এই বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করেছেন। মানিকগঞ্জ জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার তোবারক হোসেন জানান, যোগমায়া চৌধুরীকে হানাদার সেনারা আত্মগোপন করা অবস্থা থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করে।

যোগমায়া চৌধুরীদের গঙ্গাধরপট্টির বাড়িটি এখন মানিকগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজের ছাত্রীনিবাস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এখানেই একটি ভাড়া বাড়িতে থাকেন যোগমায়া চৌধুরীর ছোট ছেলে খ্যাতিমান সাবেক ফুটবলার মুক্তিযোদ্ধা বিকাশ চৌধুরী। তিনি বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেওয়াসহ নানাভাবে সহায়তা করেছেন তাঁর মা। তিন ছেলের হাতে নিজে অস্ত্র তুলে দিয়ে যুদ্ধে পাঠিয়েছেন। তাঁর মায়ের মুক্তিযোদ্ধা স্মারক লাল মুক্তিবার্তা নম্বর ০১০৭০১০২৭৬। এখানে তাঁকে শহীদ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় যোগমায়া চৌধুরী মানিকগঞ্জ ছেড়ে ঘিওরে গৃহশিক্ষক ভানুলাল গোস্বামীর বাড়িতে আত্মগোপন করেছিলেন। সেখান থেকে রাজাকারদের সহায়তায় পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে ও ভানুলালকে তুলে নিয়ে যায়। প্রথমে তাঁদের মানিকগঞ্জ প্রাইমারি টিচার্স ইনস্টিটিউটে (পিটিআই) পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতন কক্ষে নিয়ে নির্যাতন করে। এরপর দুজনের চোখ বেঁধে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের বারবাড়িয়া সেতুর ওপর বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে। যোগমায়া চৌধুরীর লাশের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। বড় ছেলে ক্রীড়াবিদ তপন চৌধুরীও যুদ্ধে শহীদ হন।

গ্রন্থনা: আবদুল মোমিন, প্রতিনিধি, মানিকগঞ্জ