বিজ্ঞাপন
default-image

‘আমার বমি বমি ভাব হচ্ছিল। ও এক গ্লাস লেবুর শরবত তৈরি করে আমার হাতে দিয়ে বলল, “এটা খাও, ভালো লাগবে।” গ্লাসটা নিয়ে ভাবলাম, নামাজ পড়ে খাব। ওর হাতের সেই শরবত আর আমার খাওয়া হয়নি। নামাজে বসেছি, এমন সময় আর্মির জিপ এসে থামল। আমি যেন পাথরের মতো জায়নামাজে বসে আছি। কী যে পড়লাম, কী যে ভাবলাম, জানি না। স্যান্ডেল পরে ওর দোতলা থেকে নেমে যাওয়ার শব্দ পাচ্ছি। সালাম ফিরিয়ে দেখি ঘরে নেই। দূরে চলে যাচ্ছে। চোখের জলে সব ঝাপসা হয়ে গেছে। আমার স্বামী আর ফিরে আসেননি।’

একাত্তরের ১৫ এপ্রিল বিকেলে পাকিস্তানি হানাদার সেনারা অধ্যাপক মোহাম্মদ হবিবুর রহমানকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায়। তিনি আর ফিরে আসেননি। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শিশিরকুমার ভট্টাচার্য্য সম্পাদিত একটি স্মরণিকা প্রকাশিত হয়। সেখানে স্ত্রী ওয়াহিদা রহমানের লেখা দীর্ঘ স্মৃতিচারণায় তাঁকে বাড়ি থেকে তুলে নেওয়ার এই বর্ণনা রয়েছে।

শহীদ মোহাম্মদ হবিবুর রহমানকে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করেছে সরকার। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁর নামে একটি হলের নামকরণ করেছে। বাংলা একাডেমির শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারকগ্রন্থেও তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনী রয়েছে। হবিবুর রহমানের জন্ম ১৯২৩ সালের ১ জুলাই নোয়াখালীর রামগঞ্জ উপজেলার বালিয়াধর গ্রামে। তাঁর বাবা মৌলভি কলিমউদ্দিন আহমদ ভূঁইয়া, মা মোসাম্মৎ সিদ্দীকা খাতুন। হবিবুর রহমান ১৯৪৬ সালের আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রেকর্ড নম্বর পেয়ে প্রথম শ্রেণিতে গণিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। এ বছরই তিনি বিয়ে করেন। তাঁদের দুই ছেলে ও চার মেয়ে। এক ছেলে খায়রুল আনাম বুয়েটের অধ্যাপক হিসেবে অবসর নিয়েছেন। পরিবারের অন্য সদস্যরা দেশের বাইরে থাকেন।

হবিবুর রহমান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার আগে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ, ইসলামিয়া কলেজ এবং ঢাকা কলেজে
অধ্যাপনা করেন। তিনি ১৯৫৪ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে ট্রাইপজ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬২ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফলিত
গণিত বিষয়ে অধ্যয়ন করেন। তিনি যোগাশ্রয়ী বীজগণিত, কলেজ বীজগণিত ও নূতন বীজগণিতবিষয়ক গ্রন্থ রচনা করেন। উনসত্তরের গণ-আন্দোলন ও একাত্তরের মার্চের অসহযোগ আন্দোলনের সময়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন।

ওয়াহিদা রহমান তাঁর স্মৃতিচারণায় লিখেছেন, ‘...যদি আমি বলেছি, ছেলেমেয়েদের মুখ চেয়ে তোমার একটু সাবধান হওয়া উচিত। ও বলেছে, “দেশের জন্য আমার বুকে আমি সাতটা গুলি নিতে পারব। আমার ছেলেমেয়েরা তখন দেশ দেখবে।”’ স্বামীকে তুলে নেওয়ার পরের ঘটনা সম্পর্কে ওয়াহিদা রহমান লিখেছেন, ‘স্বামীর খোঁজে তখন ক্যাম্পাসে বাঙালি-অবাঙালি সবার কাছে গেছি। ছুটে গেছি উপাচার্য সাজ্জাদ হোসেনের কাছে। তিনি বলেছেন তাঁকে যেন বিরক্ত না করি।’

গ্রন্থনা: আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ, রাজশাহী