বিজ্ঞাপন
default-image

মুক্তিযুদ্ধে যেতে তরুণদের উৎসাহিত করতেন প্রকৌশলী মো. ফজলুর রহমান। সরকারি বাসভবনের একটি কক্ষে গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের তিনি আশ্রয় দিতেন, তাঁদের নিয়ে পরামর্শ–পরিকল্পনা করতেন। বিষয়টি জানতে পেরে পাকিস্তানি হানাদার সেনারা ওই বাসায় ঢুকে ফজলুর রহমানসহ চারজনকে ধরে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করে।

শহীদ ফজলুর রহমান ছিলেন নীলফামারীর সৈয়দপুরের গণপূর্ত বিভাগের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী। সেদিন তাঁর সঙ্গে শহীদ হওয়া অন্যরা হলেন তাঁর ভাই রংপুর মেডিকেল কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র মো. রফিকুল ইসলাম, ভাগনে এসএসসি পরীক্ষার্থী মো. আনোয়ার হোসেন এবং তাঁর বাসার মালি মো. রুহুল আমিন। বাসার কাছেই একটি কূপের সামনে লাইনে দাঁড় করিয়ে তাঁদের গুলি করে হত্যার পর সেখানে গণকবর দেওয়া হয়। স্বাধীনতার ৩৮ বছর পর ২০০৮ সালে ওই গণকবরের সন্ধান পাওয়া যায়।

হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: অষ্টম খণ্ড, রশীদ হায়দার সম্পাদিত বাংলা একাডেমির স্মৃতি ১৯৭১–এর পুনর্বিন্যাসকৃত দ্বিতীয় খণ্ড, মুহম্মদ ইমাম উদ্দিন সম্পাদিত নরসিংদী জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, ইতিহাসবিদ সরকার আবুল কালামের নরসিংদীর শহীদ বুদ্ধিজীবী ও শফিকুল আসগর সম্পাদিত নরসিংদীর ইতিহাস গ্রন্থে তাঁর জীবনী, তাঁকে নিয়ে স্মৃতিকথাসহ বিস্তারিত তথ্য রয়েছে।

নরসিংদী সদর উপজেলার চরাঞ্চল আলোকবালীর কাজিরকান্দী গ্রামে ১৯৩৮ সালের ২৮ জুন ফজলুর রহমানের জন্ম। বাবা মৌলভী মো. তোরাব আলী ও মা জাহেদা খাতুনের সাত ছেলে–মেয়ের মধ্যে তিনি তৃতীয়। ফজলুর রহমান ঢাকার আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ (বর্তমান বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে মেধাবৃত্তিসহ প্রকৌশলে ডিগ্রি নেন। সংস্কৃতিমনা ফজলুর রহমান স্কুলজীবনে বিতর্ক, বক্তৃতা, উপস্থাপনা ও খেলাধুলায় ছিলেন দারুণ উৎসাহী।

১৯৬০ সালে সুরাইয়া বেগমকে বিয়ে করেন ফজলুর রহমান। বর্তমানে সুরাইয়া বেগম ঢাকার আরামবাগের বাসায় থাকেন। তাঁর ছেলে নাজমুল আহসান প্রকৌশলী, সিডনিতে বসবাস করছেন। মেয়ে শাহনাজ পারভীন গৃহবধূ, সিলেটে থাকেন।

সুরাইয়া বেগম স্মৃতিচারণা করে প্রথম আলোকে বলেন, একাত্তরের মার্চে হানাদার সেনারা দেশে গণহত্যা শুরু করলে ফজলুর রহমান সৈয়দপুরে সরকারি বাসার স্টোররুমে স্থানীয় তরুণদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার পরিকল্পনা করেন। মাঝে মাঝে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য শুকনা খাবার পাঠাতেন। অবাঙালি গাড়িচালক আবিদ হোসেন এসব তথ্য পাকিস্তানি বাহিনীকে জানিয়ে দেয়।

সুরাইয়া বলেন, ‘১ এপ্রিল বিকেলের দিকে গুলি ছুড়তে ছুড়তে এক ক্যাপ্টেনের নেতৃত্বে একদল সেনা আমাদের বাসায় আসে। আমাদের বাইরে বেরিয়ে এসে এক লাইনে দাঁড়াতে বলে। এ সময় আমাদের এক বছর বয়সী মেয়ে তাঁর বাবার বুকে মুখ চেপে ছিল। তারা ধমক দিয়ে বলে, “কেয়া তুম জয় বাংলা বলতা?”এরপর তারা আমার স্বামী, তাঁর ছোট ভাই, ভাগনে ও বাসার মালিকে ধরে নিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরই অনেক গুলির শব্দ শুনতে পাই।’

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৯৯ সালে ফজলুর রহমানকে নিয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করে ডাক বিভাগ। গণকবরটি আবিষ্কৃত হওয়ার পর সৈয়দপুর সেনানিবাস ও তাঁদের পরিবারের উদ্যোগে সেটি সংরক্ষণ করা হয়। ২০১০ সালে সৈয়দপুরে তাঁর নামে একটি সড়কের নামকরণ হয়। এ ছাড়া পরিবারের উদ্যোগে তাঁর জন্মস্থান কাজিরকান্দী গ্রামে মো. ফজলুর রহমান স্মৃতি পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

গ্রন্থনা: প্রণব কুমার দেবনাথ, নরসিংদী।