বিজ্ঞাপন
default-image

প্রগতিশীল ধ্যানধারণার অনুসারী একজন মানবতাবাদী হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন মো. আবদুল হাফিজ। লালমনিরহাট শহরের রেলওয়ের সাহেবপাড়ায় ছিল তাঁর বাসা। একাত্তরের ১৮ এপ্রিল রাতে শহরের উর্দুভাষী অবাঙালিরা বাসায় হামলা করে। আবদুল হাফিজ ও তাঁর ছেলে দশম শ্রেণির ছাত্র বেলাল সুজাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে মারাত্মক আহত করে। স্ত্রী হালিমা বেগম ও আরেক ছেলে জেলাল শফিকে প্রচণ্ড মারধর করে। অর্ধমৃত অবস্থায় তারা আবদুল হাফিজ ও বেলাল সুজাকে তুলে নিয়ে যায়। সাহেবপাড়ার কাছেই খ্রিষ্টান গির্জার পাশের কবরস্থানে তাঁদের একটি গর্তে ফেলে মাটিচাপা দেয়।

এ পৈশাচিক ঘটনা সেদিন দূর থেকে কিছু স্থানীয় বাসিন্দা দেখলেও ভয়ে তাঁরা এগিয়ে যেতে পারেননি। লালমনিরহাট শহরে তখন অনেক অবাঙালি বসবাস করত। পাকিস্তানি বাহিনী বাঙালিদের গণ্যহত্যা শুরু করলে এসব অবাঙালি হানাদার সেনাদের মদদে বাঙালিদের হত্যা–নির্যাতন, বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে লুটপাট করতে থাকে।

আদুল হাফিজ ছিলেন লালমনিরহাট রেল বিভাগীয় কার্যালয়ের ডিএমই দপ্তরের বড় বাবু (উচ্চমান ক্লার্ক)। তাঁর এ পরিচয়ের বাইরে ‘হাফিজ ডাক্তার’ বলেই তিনি এলাকায় খ্যাত ছিলেন। দাপ্তরিক কাজের বাইরে হোমিও চিকিৎসাই ছিল তাঁর ধ্যানজ্ঞান। রেজিস্টার্ড হোমিও চিকিৎসক ছিলেন তিনি। এলাকার দরিদ্র মানুষকে বিনা মূল্যে চিকিৎসা দিতেন। দেশের স্বাধীনতা ও স্বাধিকারের প্রতি তিনি ছিলেন উচ্চকণ্ঠ। একাত্তরের ৭ মার্চ রেডিওতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ শোনার পর থেকে তিনি আর অফিসে যাননি। ২৭ মার্চ তিনি রেলওয়ে আপ ইয়ার্ড কলোনির অবাঙালিদের হামলায় আহত বাঙালি ছাত্র–যুবকদের অনেককে চিকিৎসা দিয়েছিলেন।

তাঁর মেজ ছেলে বেলাল সুজা তখন লালমনিরহাট মডেল স্কুলে দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় ছাত্র ইউনিয়নের সক্রিয় সদস্য ছিল। স্বাধীনতার পক্ষে ছাত্রদের সংগঠিত করত। তারা পাকিস্তানি পতাকা পুড়িয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেছিল। এ কারণে অবাঙালিরা তাদের ওপর ক্ষিপ্ত ছিল। রশীদ হায়দার সম্পাদিত বাংলা একাডেমির স্মৃতি–১৯৭১ গ্রন্থের পুনর্বিন্যাসকৃত তৃতীয় খণ্ডে বিভীষিকাময় সেই রাতের স্মৃতিচারণা করেছেন সেজ ছেলে জেলাল শফি। তা ছাড়া আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্টের গণহত্যা-বধ্যভূমি ও গণকবর জরিপ এবং কবি ও গবেষক মানিক মোহাম্মদ রাজ্জাকের উত্তরের গণহত্যা-১৯৭১ গ্রন্থে শহীদ আবদুল হাফিজ ও শহীদ বেলাল সুজার পরিচিতি ও হত্যার বিবরণ রয়েছে। লালমনিরহাট রেলস্টেশন–সংলগ্ন রেলের বিভাগীয় শহীদ স্মৃতিসৌধে শহীদের তালিকাতেও আবদুল হাফিজের নাম উল্লেখ রয়েছে।

আবদুল হাফিজের গ্রামের বাড়ি বগুড়া জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার বিহারহাট গ্রামে। বাবা অছিম উদ্দিন আহমেদ ও মা হাওয়াতুন। চাকরিসূত্রে তিনি ১৯৪৭ সাল থেকে লালমনিরহাট শহরেই বসবাস করছিলেন। স্ত্রী হালিমা বেগমের বয়স এখন ৯৪ বছর। তিনি ঢাকায় ছেলে জেলাল শফির সঙ্গে থাকেন। জেলাল পুলিশের চাকরি থেকে অবসরে গেছেন। হালিমা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখনো প্রায়ই সেই ভয়াল রাতের কথা মনে হয়। দুচোখের পাতা এক করতে পারি না।’

গ্রন্থনা: আবদুর রব, প্রতিনিধি, লালমনিরহাট