বিজ্ঞাপন
default-image

শৈশব থেকেই অভিনয় করতেন মৃণাল কান্তি দাস। একসময় মঞ্চমাতানো অভিনয় এলাকায় তাঁকে জনপ্রিয় করে তোলে। এর পাশাপাশি খেলাধুলাতেও তিনি ছিলেন পটু। সব মিলিয়ে সংস্কৃতিসেবী হিসেবে ময়মনসিংহে খ্যাত ছিলেন তিনি।

রাজনৈতিকভাবেও সচেতন ছিলেন শহীদ মৃণাল কান্তি। কাকা কমিউনিস্ট নেতা মোক্ষদা চরণ দাসের কাছেই রাজনৈতিক দীক্ষা পেয়েছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রসদ নিয়ে যাওয়ার সময় তাঁকে আটক করে পাকিস্তানি হানাদার সেনারা। এরপর তাঁকে হত্যা করে এই নরপশুরা।

মৃণাল কান্তি দাসের ছেলে প্রদ্যোত কুমার দাস এখন নেত্রকোনায় আবু আব্বাছ কলেজে অধ্যাপনা করেন। প্রথম আলোতে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের অবদান নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন দেখে তিনি তাঁর বাবার সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য লিখে পাঠান। পরে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি জানান, মৃণাল কান্তি দাসের জন্ম ১৯৩৮ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার তাতকুড়া গ্রামে। গৌরীপুরের আর কে সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে তিনি ১৯৫৬ সালে মাধ্যমিক পাস করেন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে ছয় দফা ও ১১ দফা আন্দোলনে সরাসরি অংশ নেন তিনি।

মৃণাল কান্তি দাসের কাকা কমরেড মোক্ষদা চরণ দাসের তাতকুড়ার বাড়িটি ওই সময় ছিল বামপন্থী রাজনৈতিক নেতাদের গোপন মিলনকেন্দ্র। কমরেড মণি সিংহ, অজয় রায়, খোকা রায়, বারীন দত্ত থেকে শুরু করে কাজী আবদুল বারী, সুকুমার ভাওয়াল, আজিজুল ইসলাম খান ও মৃণাল বিশ্বাসরা এ বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন বিভিন্ন সময়। মুক্তিযোদ্ধারা ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনা অঞ্চলের মধ্যে গোলাবারুদসহ অন্যান্য রসদপত্র আনা–নেওয়ার কেন্দ্র হিসেবেও বাড়িটি ব্যবহার করতেন। মৃণাল কান্তি নিজেও মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে গোপনে গোলাবারুদ ও রসদ পৌঁছে দেওয়ার কাজ করতেন। একাত্তরের ২৯ আগস্ট মৃণাল কান্তি লেপ-তোশকের ভেতরে মুড়িয়ে গোপনে কিছু রসদপত্র নিয়ে যাচ্ছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে। গৌরীপুর পোস্ট অফিসের কাছে রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে ধরে ফেলে। ঘাতক সেনারা ঘটনাস্থলেই তাঁকে গুলি করে হত্যা করে।

প্রদ্যোত কুমার জানান, তাঁর বাবার মৃত্যুর পর মা হাসি রানী দাস দুই সন্তান নিয়ে কঠিন সংকটে পড়ে যান। তখন তাঁর বয়স ছিল তিন বছর আর বোন পূরবী দাস ছিলেন মাত্র ছয় মাসের। তাঁর মা অনেক সংগ্রাম করে তাঁদের বড় করেছেন। ২০১৮ সালে তিনি মারা গেছেন। আর বোন পূরবী চিকিৎসক, ভারতে থাকেন।

১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ব্যক্তিগত প্যাডে মৃণাল কান্তির স্ত্রীকে সহানুভূতি জানিয়ে চিঠি লেখেন এবং সঙ্গে দুই হাজার টাকার একটি চেক পাঠান। এরপর প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধুর স্বাক্ষরিত আরও একটি চিঠি আসে। তাতে মহকুমা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল থেকে এক হাজার টাকার চেক পাঠানো হয়। বঙ্গবন্ধুর স্বাক্ষরিত এসব চিঠি এখনো তাঁদের কাছে সংরক্ষিত আছে। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর তাঁরা আর কোনো সরকারি সহায়তা পাননি।

মৃণাল কান্তিকে যেখানে হত্যা করা হয়েছিল, সেখানে তাঁর স্মৃতিরক্ষায় একটা নামফলক নির্মাণের দাবি জানিয়েছে এই শহীদ পরিবার।

গ্রন্থনা: কামরান পারভেজ, প্রতিনিধি, ময়মনসিংহ