বিজ্ঞাপন
default-image

একাত্তরের ১ এপ্রিল। ঝিনাইদহের বিষয়খালীতে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে শুরু হয় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম সম্মুখযুদ্ধ। যশোর সেনানিবাস থেকে আসা হানাদারদের প্রতিরোধ করে এলাকার মুক্তিপাগল বীর জনতা। বাজারের সঙ্গে থাকা সেতু ভেঙে সেখানে পরিখা তৈরি করা হয়। সেই পরিখায় পড়ে অক্কা পেয়েছে বেশ কয়েকজন হানাদার পাকিস্তানি। স্থানীয় কে বি বি এল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মায়াময় ব্যানার্জী তাঁর ছাত্র ও এলাকার যুবকদের সংগঠিত করে প্রচেষ্টা চালাচ্ছিলেন প্রতিরোধ গড়ে তোলার। তাঁদের প্রচেষ্টায় পাকিস্তানি ঘাতকেরা একপর্যায়ে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। তবে ফিরে যাওয়ার আগে তারা এ দেশের ২৬ জন বীর সন্তানকে হত্যা করে। মায়াময় ব্যানার্জী তাঁদের একজন।

শহীদ মায়াময় ব্যানার্জীর জন্ম ১৯১৮ সালে ঝিনাইদহ সদর উপজেলার খড়িখালী গ্রামে। বাবা দীনেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী। এন্ট্রাস
পাস মায়াময় ব্যানার্জী ‘ব্যাকরণ কাব্যতীর্থ’ উপাধি লাভ করেছিলেন। এলাকার রামনগর কে বি বি এল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বাংলার শিক্ষক ছিলেন তিনি। তাঁর আট সন্তানের মধ্যে এখন ছয়জন জীবিত রয়েছেন। বাংলা একাডেমি ও আগামী প্রকাশনীর শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থ–এ মায়াময় ব্যানার্জীর সংক্ষিপ্ত জীবনী রয়েছে।

মায়াময় ব্যানার্জীর ছেলে প্রণব ব্যানার্জী প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর বাবা এলাকায় শিক্ষক হিসেবে খ্যাতিমান ও সম্মানী মানুষ ছিলেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি অনেক সমাজকল্যাণমূলক কাজে যুক্ত ছিলেন। সাহিত্যচর্চা করতেন। গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ লিখতেন। প্রণব জানান, মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি দশম শ্রেণিতে পড়তেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ১ এপ্রিল যশোর সেনানিবাস থেকে একদল পাকিস্তানি সেনা ঝিনাইদহের বিষয়খালী এলাকায় আসে। তারা ঝিনাইদহ শহর দখল করবে, এমন খবর পেয়ে মুক্তিপাগল জনতা তাদের প্রতিরোধ করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাঁর বাবাও হানাদারদের প্রতিরোধ করতে এগিয়ে যান। মুক্তিপাগল বীরদের তিনি সংগঠিত ও উৎসাহিত করেছিলেন। প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়েছিল। সবার প্রতিরোধের মুখে পাকিস্তানিরা একটা সময় ফিরে যেতে বাধ্য হয়। তবে সেই সম্মুখযুদ্ধে ২৬ জন শহীদ হন। তাঁর বাবাকে হানাদাররা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে।

ঝিনাইদহ–যশোর সড়কের খড়িখালী এলাকায় শহীদের লাশগুলো পড়ে ছিল। পরদিন স্থানীয় লোকজন সেখানেই তাঁদের গণকবর দেন। ফিরে যাওয়ার সময় হানাদাররা অনেক বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। সেদিন যাঁরা শহীদ হয়েছিলেন তাঁদের স্মরণে বিষয়খালী বাজারে একটি স্মারক ভাস্কর্য তৈরি করা হয়েছে। সেখানে ওই ২৬ শহীদের মধ্যে তাঁর বাবার নামও রয়েছে।

শহীদ মায়াময় ব্যানার্জীর নামে ১৯৮৪ সালে একটি বালিকা বিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠা করা হয় তাঁর সমাধিস্থলের পাশেই। ‘শহীদ মায়াময় মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়’ নামের এই বিদ্যালয়ে অফিস সহকারী হিসেবে কাজ করছেন মায়াময় ব্যানার্জীর আরেক ছেলে প্রদীপ কুমার ব্যানার্জী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এলাকায় নারীশিক্ষার প্রসারের জন্য এই বিদ্যালয়টি তৎকালীন সরকারের উদ্যোগে ও সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এখন ছয় শতাধিক শিক্ষার্থী পড়ালেখা করছে। শহীদ পরিবার হিসেবে তাঁদের বিশেষ কিছু চাওয়ার নেই। তাঁরা চান স্কুলটি জাতীয়করণ হোক।

গ্রন্থনা: আজাদ রহমান, ঝিনাইদহ