বিজ্ঞাপন
default-image

চিকিৎসক মমতাজ হোসেনের বাড়ির সবাইকে একটি ঘরের মধ্যে আটকে রাখে হানাদার পাকিস্তানি সেনারা। তারপর সেই বাড়িতে আগুন দেয়। তারপর গুলির বৃষ্টি। নারকীয় এ হত্যাকাণ্ডে শহীদ হন চাঁপাইনবাবগঞ্জের মমতাজ হোসেন, তাঁর দুই মেয়ে ও আশ্রয় নিতে আসা এক বালক।

অর্ধশত বছর পেরিয়ে গেলেও সেই বিভীষিকাময় দিনের স্মৃতি এখনো আতঙ্কিত করে তোলে শহীদ চিকিৎসক মমতাজ হোসেনের স্ত্রী জাহানারা বেগমকে। তাঁর বয়স এখন ৭৮ বছর। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, একাত্তরের ২০ এপ্রিল বেলা ১১টার দিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের ইসলামপুরে তাঁদের বাড়ির সদর দরজায় ঠকঠক শব্দ হয়। দরজা খুলতে দেরি হওয়ায় নয়জন হানাদার সেনার একটি দল পেছনের দরজা ভেঙে বাড়িতে ঢোকে। তারা এই পরিবারের ও বাইরে থেকে এসে আশ্রয় নেওয়া ১১ জনকে বড় ঘরটিতে আটকে রাখে। এরপর পেট্রল ঢেলে বিভিন্ন ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুন জ্বলে ওঠার পর তারা এলোপাতাড়ি গুলি চালাতে থাকে।

এ পৈশাচিক ঘটনায় মমতাজ হোসেনের বড় মেয়ে অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী মাহবুবা খাতুন ও আশ্রিত বালক ঘটনাস্থলেই মারা যায়। মমতাজ হোসেন, মেজ মেয়ে মাহমুদা খাতুন ও ছোট মেয়ে মাসকুরা খাতুন গুরুতর আহত হন। সেদিন বিকেলেই মমতাজ হোসেন মারা যান। পরদিন বাবা ও মেয়ে মাহবুবার লাশ একসঙ্গে নামোশংকরবাটী মহল্লায় দাফন করা হয়।

জাহানারা বেগম জানান, স্বামী ও বড় মেয়ের লাশ দাফন করে আহত দুই মেয়ে ও তিন ছেলেকে নিয়ে তিনি তাঁর বাবার বাড়ি গোদাগাড়ীর ডোমকুলি গ্রামে চলে যান। পরদিন ছোট মেয়ে পাঁচ বছরের মাসকুরা খাতুন মারা যায়। শুরু হয় তাঁর কঠিন জীবনসংগ্রাম। বহু কষ্ট করে মেয়ে মাহমুদা খাতুন ও তিন ছেলে জাফর আহমেদ ওসমানী, জাকি আহমেদ ওসমানী ও জামিল আহমেদ ওসমানীকে লেখাপড়া শিখিয়ে বড় করেছেন। তাঁরা সবাই এখন প্রতিষ্ঠিত।

মমতাজ হোসেন রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার বাসুদেবপুর ইউনিয়নের ডোমকুলি গ্রামের ওসমান আলী ও মরিয়ম বেগমের ছেলে। তাঁর জন্ম ১৯২৭ সালে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিশিষ্ট নাট্যকার ও লেখক গোলাম রাব্বানী সম্পাদিত যুদ্ধে যুদ্ধে স্বাধীনতা বইয়ে মমতাজ হোসেনকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের প্রথম শহীদ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আগামী প্রকাশনীর শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থেও মমতাজ হোসেনের জীবনী ও এ নারকীয় হত্যার বিবরণ রয়েছে। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ২০২১ সালের প্রকাশিত প্রজ্ঞাপনে শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকায় চিকিৎসক মমতাজ হোসেনের নাম রয়েছে।

শহীদ মমতাজ হোসেনের ছেলে ভিয়েনাপ্রবাসী জাকি আহমেদ ওসমানী প্রথম আলোকে বলেন, সেদিন নিতান্তই ভাগ্যের কারণে তিনি বেঁচে গিয়েছিলেন। তাঁর বাবা কোনো রাজনীতি করতেন না। তবে স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন।

জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ও ভোলাহাট উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আইনজীবী আবদুস সামাদ বলেন, পাকিস্তানি সেনারা চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরে প্রথম হামলা চালিয়েছিল চিকিৎসক মমতাজ হোসেনের বাড়িতে। তিনি দুই মেয়ে ও আশ্রয় দেওয়া এক বালকসহ শহীদ হন।

গ্রন্থনা: আনোয়ার হোসেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ