একাত্তরের ১৪ অক্টোবর। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল পায়ে হেঁটে নওগাঁর বদলগাছি উপজেলার গয়েশপুর গ্রামে ঢুকে পড়ে। তখন আনুমানিক ভোর পাঁচটা। হানাদার সেনারা শিক্ষক মখলেছার রহমান চৌধুরীর বাড়ির দরজায় বারবার ধাক্কা দিতে থাকলে তাঁর মা আকলিমা খাতুন দরজা খুলে দেন। অস্ত্র নিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ে বর্বরের দল।
মায়ের সামনে বড় ছেলে আফজাল হোসেন চৌধুরীকে গুলি করে হত্যা করে। মেজ ছেলে মখলেছার রহমান চৌধুরীকে নিয়ে যায় বাড়ি থেকে ১০০ গজ পশ্চিমে একটি পাটের গুদামের সামনে। সেখানে তাঁকেও গুলি করে হত্যা করা হয়। এরপর নরঘাতকের দল গ্রামের আরও অনেক বাড়িতে হানা দিয়ে মোট ১১ জন নিরস্ত্র মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে তথ্য চেয়ে প্রথম আলোতে বিজ্ঞাপন ছাপা হওয়ার পর শহীদ মখলেছার রহমান চৌধুরীর বিষয়ে তথ্য ও ছবি পাঠান নওগাঁর একুশে পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা-আল-মেহমুদ রাসেল। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে তরুণ এই গবেষকের মাঠপর্যায়ের গবেষণাগ্রন্থে (রক্তঋণ ১৯৭১: নওগাঁ) মখলেছার রহমান চৌধুরী সম্পর্কে তথ্য রয়েছে। তাঁর দেওয়া তথ্যসূত্র ধরে প্রথম আলো অনুসন্ধান করে।
শহীদ মখলেছার রহমান চৌধুরী গয়েশপুর উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। তিনি অঙ্ক ও ভূগোল বিষয়ে পড়াতেন।
মখলেছার রহমান চৌধুরীর জন্ম ১৯৩০ সালে। ছোট যমুনা নদীর তীরঘেঁষা নওগাঁর বদলগাছি উপজেলার গয়েশপুর গ্রামে। বাবা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী, মা আকলিমা খাতুন। তিনি কর্মজীবন শুরু করেন পোস্টমাস্টার হিসেবে। পরে তিনি গয়েশপুর উচ্চবিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। তাঁর দুই মেয়ে ও এক ছেলে। ২০১৯ সালে তাঁর স্ত্রী হোসনে আরা মারা যান।
মখলেছার রহমান চৌধুরীকে হত্যার ঘটনার বিবরণ জানা যায় তাঁর ছোট ভাই ও ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী গয়েশপুর উচ্চবিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক আবদুল ওয়াদুদ চৌধুরীর কাছ থেকে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘একাত্তরের ১৪ আগস্ট ভোরে ৬০-৭০ জন হানাদার সেনা আমাদের গ্রামে প্রবেশ করে। তারা বাড়িতে ঢুকেই মেজ ভাই মখলেছার রহমানকে খুঁজতে শুরু করে। খুব অসুস্থ থাকায় তিনি ঘরেই শুয়ে ছিলেন। বড় ভাই আফজাল হোসেন আমাকে, আমার বোন ও ভাবিদের তখন বাড়ির টিনের ছাউনির নিচে লুকিয়ে থাকতে বলেন। সেনারা মেজ ভাইকে ঘর থেকে টেনেহিঁচড়ে বাইরে বের করে। মা ও মেজ ভাইয়ের সামনেই বড় ভাইকে গুলি করে হত্যা করে। মেজ ভাইকে বাড়ির ১০০ গজ পশ্চিমে নিয়ে দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা পাটের গুদামের সামনে দাঁড় করায়। সেখানে চাচাতো ভাই এনামুল হক চৌধুরী ও তাঁর ছেলে আমিনুল হক চৌধুরীকে নিয়ে এসে একসঙ্গে তিনজনকে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে। ওই দিন গ্রামের অন্য বাড়িতে হামলা দিয়ে পাকিস্তানি সেনারা গ্রামের আরও নয়জনকে হত্যা করে।’ ভাইকে নিয়ে তাঁর একটি লেখা রশীদ হায়দার সম্পাদিত বাংলা একাডেমির স্মৃতি-১৯৭১-এর পুনর্বিন্যাসকৃত চতুর্থ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে।
গয়েশপুর উচ্চবিদ্যালয়ে শহীদ শিক্ষক মখলেছার রহমান চৌধুরীর স্মৃতি রক্ষার্থে ফলক নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া গয়েশপুর থিয়েটার হলের সামনে একাত্তরের ১৪ অক্টোবর মখলেছার রহমান চৌধুরীসহ ১১ জন শহীদের নামে স্মৃতিফলক রয়েছে।
গ্রন্থনা: ওমর ফারুক, প্রতিনিধি, নওগাঁ।