বিজ্ঞাপন
default-image

একাত্তরে মোজাম্মেল হক চৌধুরী ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়ের চিফ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। কর্মস্থল ছিল চট্টগ্রামে।

বাসা পাহাড়তলীর এফ-থ্রি বাংলোতে। ৫ এপ্রিল সোমবার একদল অবাঙালি তাঁর বাংলো ঘিরে ফেলে। তারা তাঁকে আরও কয়েকজনের সঙ্গে নির্মমভাবে জবাই করে হত্যা করে। তাঁর মরদেহের কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।

নির্মম এ ঘটনার বর্ণনা আছে তাঁর স্ত্রী দূর-ই-সাহওয়ার চৌধুরীর রচনায়। তিনি লিখেছেন, ‘৫ এপ্রিল, সোমবার। আকাশ ছিল মেঘাচ্ছন্ন।...বাগান ছিল লালে লাল। থোকা থোকা সিলভিয়া-ডালিয়াগুলো যেন জমাটবাঁধা রক্তের মতোই জুড়ে ছিল সারা বাগান।

‘সকাল নয়টা। কলোনির লেবার শ্রেণির কিছু লোক গেটে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল চৌধুরী সাহাব হ্যায়?...চৌধুরী সাহেব নির্ভীকভাবে এগিয়ে গিয়ে বললেন, ‘এই তো আমি।” সঙ্গে সঙ্গে প্রায় দেড় শ অবাঙালি বিভিন্ন অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ঘিরে ফেলল বাড়ি।

২৫ মার্চ রাত থেকে সারা পাহাড়তলী হানাদার বাহিনী ঘিরে রেখেছিল। সেই সঙ্গে কেটে দেয় পানি, বিদ্যুৎ ও টেলিফোন সংযোগ। লেলিয়ে দেয় পশুদের।

‘তারপর ঘরের মধ্যে সশস্ত্র পশুরা ঘিরে ফেলল চৌধুরী সাহেবকে। আমি দাঁড়িয়ে আছি কাছাকাছি। বোধশক্তিহীন।...

‘জল্লাদরা বলল ছেলেমেয়েদের পৃথক হয়ে আলাদা ঘরে যেতে। চৌধুরী সাহেব এসে বললেন, “আল্লাহ আছেন, আল্লাহ আছেন।” এই ছিল আমাকে তাঁর বলা শেষ কথা। এক পশু সরিয়ে নিল তাঁকে। আমাদের মেয়েদের ঘরে বন্ধ করে দিল।...একে একে শেষ করল পাশের ঘরে ১১ জনকে।

ক্ষমা চাই, ক্ষমা চাই পাঠক, আপনাদের কাছে। তখনকার ঘটনার বর্ণনা দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’ (স্মৃতি: ১৯৭১, চতুর্থ খণ্ড, প্রথম প্রকাশ ১৯৯১, সম্পাদনা রশীদ হায়দার)।

২২ এপ্রিল মোজাম্মেল হক চৌধুরীর জাপান যাওয়ার কথা ছিল। এদিকে ২৬ মার্চের পর রেলওয়েতে কর্মরত কয়েকজন বাঙালি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সপরিবারে তাঁর বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন।

অবাঙালিরা তাঁদের মধ্য থেকে নারী-শিশুদের এক ঘরে বন্দী করে রেখে তাঁকেসহ ১১ জন পুরুষকে অন্য এক ঘরে নিয়ে যায়। সেখানে তারা তাঁদের জবাই করে নির্মমভাবে হত্যা করে।

মোজাম্মেল হক চৌধুরীর সখ ছিল বাগান আর পোলট্রি ফার্মিং করা। নিঃসন্তান এই দম্পতি গান শুনে পড়াশোনা করে, প্রতিবেশীদের সুখ-দুঃখের সঙ্গী হয়ে জীবন কাটাতেন। তাঁর সহকর্মীরা তাঁকে দেবতুল্য মানুষ জ্ঞান করতেন।

তাঁর জন্ম ১৯৩০ সালের ১ জুলাই দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে। বাবা মোসলেহ উদ্দিন চৌধুরী, মা বশিরুন্নেসা চৌধুরানী। তিনি ছিলেন ছয় ভাই ও চার বোনের মধ্যে কনিষ্ঠ।

১৯৫২ সালে আইএসসি পাস করে তিনি আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়) ভর্তি হন।

তিনি ছিলেন প্রথম ব্যাচের ছাত্র। পাস করার পর ১৯৫৩ সালের ৬ এপ্রিল রেলওয়েতে সহকারী ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ার পদে যোগ দেন।

তখন পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়েতে অধিকাংশ উচ্চপদে অধিষ্ঠিত ছিল অবাঙালিরা। এ পরিবেশে মোজাম্মেল হক চৌধুরী চিফ ইঞ্জিনিয়ার পদে অধিষ্ঠিত হওয়ায় তাঁকে অবাঙালি সহকর্মীদের রোষানলে পড়তে হয়।

সূত্র: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১, নারী, অংশগ্রহণকারী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ, প্রথম খণ্ড, মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র, প্রথম প্রকাশ ২০০৭। স্কেচ: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (চতুর্থ পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (১৯৯৫) থেকে।

গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান

<[email protected]>

সূত্র: ২৭ ডিসেম্বর, ২০১৪ সালে প্রথম আলোতে প্রকাশিত