বিজ্ঞাপন
default-image

লালমনিরহাট মিশন স্কুলের (বর্তমান চার্চ অব গড উচ্চবিদ্যালয়) প্রধান শিক্ষক বীরেন্দ্র নাথ বাড়ৈকে একাত্তরের ৬ এপ্রিল শহরের মিশনপাড়ার আবাসিক এলাকা থেকে কয়েকজন অবাঙালি কিশোর আটক করে। তাঁর কাছ থেকে টাকাপয়সা কেড়ে নেয়। ওরা তাঁকে মিশন স্কুলের দক্ষিণ দিকের পুকুরপাড়ে নিয়ে যায়। সেখানে খ্রিষ্টান কবরস্থানের বাঁশঝাড়ের আড়ালে লোহার রড দিয়ে মাথায় আঘাত ও পেটে ছুরিকাঘাত করে। গুরুতর আহত বীরেন্দ্র নাথ বাড়ৈকে তারা একটি গর্তে মাটিচাপা দিয়ে চলে যায়।

সেখানকার কয়েকজন নারী বাসিন্দা লুকিয়ে থেকে ঘটনাটি দেখেছেন। আহত বীরেন্দ্র নাথ মাটির তলা থেকে উঠে আসার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু ভয়ে কেউ তাঁকে সাহায্য করতে যাননি। একসময় তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। মুক্তিযুদ্ধের সময় হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর মদদে লালমনিরহাটের অবাঙালিরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল। বাঙালিদের হত্যা করা ছাড়াও লুটতরাজ-অগ্নিসংযোগ করতে থাকে।

শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে তথ্য চেয়ে প্রথম আলোতে বিজ্ঞাপন ছাপা হলে লালমনিরহাটের কবি ও গবেষক মানিক মোহাম্মদ রাজ্জাক বীরেন্দ্র নাথ বাড়ৈ সম্পর্কে তথ্য পাঠান। লালমনিরহাটের মুক্তিযুদ্ধ এবং শহীদদের নিয়ে ৭১-এর অল্পকথা নামে তাঁর একটি মাঠপর্যায়ে তথ্যানুসন্ধানের বই রয়েছে। তাতে বীরেন্দ্র নাথ বাড়ৈ সম্পর্কে এসব তথ্য রয়েছে। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সময় লালমনিরহাট চার্চ অব গডের (মিশনের) শহীদ সদস্যদের তালিকায় ৪ নম্বরে রয়েছে শহীদ ধীরেন্দ্র নাথ বাড়ৈয়ের নাম। এসব তথ্যসূত্র ধরে অনুসন্ধান করেছে প্রথম আলো

বীরেন্দ্র নাথ বাড়ৈয়ের ১০ সন্তানের মধ্যে দুই ছেলে এখন লালমনিরহাট শহরের হাড়িভাঙ্গা এলাকায় থাকেন। তাঁদের একজন মার্টিন মিহির বাড়ৈ প্রথম আলোকে জানান, তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের সময় শহরের মিশনপাড়া আবাসিক এলাকায় থাকতেন। তিনি তখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। তাঁর বাবা একাত্তরের ৪ এপ্রিল তাঁদের দৈলজোর গ্রামে পরিচিত একজনের বাড়িতে নিয়ে আসেন। চাল-ডাল আনতে ৬ এপ্রিল তিনি শহরে যান। সেখানে কয়েকজন অবাঙালি কিশোর তাঁকে আটক করে মেরে ফেলে।

শহীদ বীরেন্দ্র নাথ বাড়ৈ ১৯২৩ সালে বরিশালের উজিরপুর উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের শীতপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম সত্য নাথ বাড়ৈ। বীরেন্দ্র নাথ ১৯৪১ সালে বরিশাল একাডেমি থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। এরপর ১৯৪২ সালে বাকেরগঞ্জ থেকে প্রাইমারি টিচার্স ট্রেনিং সার্টিফিকেট পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন। ১৯৪৮ সালে লালমনিরহাট মিশন স্কুলের সহকারী শিক্ষক হিসেবে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৬৩ সালে এই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নিযুক্ত হন। আমৃত্যু তিনি এই পদে কর্মরত ছিলেন। তাঁর স্ত্রী জ্যোতি কনা বাড়ৈ ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মারা যান।

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির জেলা সভাপতি ও জেলা সিপিবির সভাপতি আইনজীবী ময়জুল ইসলাম বলেন, বীরেন্দ্র নাথ বাড়ৈ ছিলেন একজন নীতিমান আদর্শ শিক্ষক। তিনি অসাম্প্রদায়িক চেতনা ধারণ করতেন। স্বাধীনতার আগে একমাত্র মিশন স্কুলেই হরিজন সম্প্রদায়ের শিশুরা লেখাপড়া করার সুযোগ পেত। তিনিই এ ব্যবস্থা করেছিলেন। অনেক অবাঙালি শিশুকেও তিনি মিশন স্কুলে ভর্তি করিয়েছিলেন। অথচ অবাঙালি কিশোরেরা তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল।

গ্রন্থনা: আবদুর রব, লালমনিরহাট