বিজ্ঞাপন
default-image

প্রদীপ কুমার দাস ছিলেন নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলার হিরণপুর উচ্চবিদ্যালয়ের গণিতের শিক্ষক। লেখাপড়া আর সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড নিয়েই মেতে থাকতেন। একাত্তরের ১৬ আগস্ট দুপুরে স্কুল থেকে বের হয়ে পাশেই হিরণপুর রেলস্টেশনে অবস্থান করছিলেন। তখন রাজাকার-আলবদররা তাঁকে ধরে পাকিস্তানি হানাদার সেনাদের হাতে তুলে দেয়। এরপর তাঁর আর সন্ধান পাওয়া যায়নি।

প্রদীপ কুমার দাসের জন্ম ১৯৪৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নেত্রকোনা পৌর শহরের পুকুরিয়া মহল্লায়। বাবা হরেন্দ্র কুমার দাস ছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মচারী। মা সুচিত্রা বালা গৃহিণী। তিন ভাই ও চার বোনের মধ্যে বড় ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা দিলীপ কুমার দাস ছিলেন সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা। ১৯৯৭ সালে তিনি মারা গেছেন। ছোট ভাই দীপক কুমার দাস ব্যবসায়ী। প্রদীপ কুমার দাস নেত্রকোনা সরকারি কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন ১৯৭০ সালে। একই সালে মদন উপজেলার নোয়াগাঁও উচ্চবিদ্যালয়ে বিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। কয়েক মাস পর সেখান থেকে নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলার হিরণপুর উচ্চবিদ্যালয়ে যোগ দেন। ছাত্রদের প্রিয় ‘প্রদীপ স্যার’ ছিলেন সদালাপী ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ।

একাত্তরের ১৬ আগস্ট দুপুরে প্রদীপ কুমার দাস বিদ্যালয় থেকে বের হয়ে পাশেই হিরণপুর রেলস্টেশনে আসেন। সেখানে তাঁর কয়েকজন ছাত্র ও অভিভাবকের সঙ্গে কথা বলছিলেন। এ সময় ময়মনসিংহ থেকে মোহনগঞ্জের উদ্দেশে ছেড়ে আসা ট্রেনটি হিরণপুর থামে। প্রায় যাত্রীশূন্য ট্রেনটি থেকে মুসলিম লীগের চিহ্নিত কয়েকজন নেতা, রাজাকার-আলবদর, আলসামস ও পাকিস্তানি সেনা অস্ত্র হাতে দ্রুত নেমে পড়ে। তারা স্টেশনে থাকা লোকদের জিজ্ঞাসাবাদ ও ধরপাকড় শুরু করে। রাজাকাররা শিক্ষক প্রদীপ কুমারকে ধরে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে তুলে দেয়। বর্বর সেনারা তাঁকে মারধর করে ট্রেনে তোলে। এ সময় তাঁর ছাত্ররা ও উপস্থিত লোকজন ‘বিএসসি স্যারকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে, ধরে নিয়ে যাচ্ছে’ বলে চিৎকার করতে থাকেন। কিন্তু ট্রেন চলতে শুরু করায় শিক্ষক প্রদীপ কুমার দাসকে তাঁরা রক্ষা করতে পারেননি।

মদনের নোয়াগাঁও উচ্চবিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক ও প্রদীপ কুমার দাসের ভগ্নিপতি সুধীর চন্দ্র দাস জানান, অবিবাহিত প্রদীপ কুমার দাস ছাত্রদের জন্য নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। একাত্তরের মার্চে পাকিস্তানি হানাদাররা গণহত্যা শুরু করলে তিনি ছাত্র ও তরুণদের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে অনুপ্রাণিত করাসহ মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন। গতিধারা প্রকাশনী থেকে ইতিহাসবিদ আলী আহাম্মদ খান আইয়োব নেত্রকোনা জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গ্রন্থে প্রদীপ কুমার দাসের কথা উল্লেখ রয়েছে।

প্রদীপ কুমারের ছোট ভাই দীপক কুমার দাস প্রথম আলোকে জানান, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাঁর বাবা হরেন্দ্র কুমার দাসের কাছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সমবেদনা জানিয়ে একটি চিঠি ও এক হাজার টাকা পাঠান। তিনি বলেন, ‘ভাই দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন, আমরা গর্বিত।’ শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে প্রদীপ কুমারের নাম সরকারিভাবে গেজেটে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানান তিনি।

গ্রন্থনা: পল্লব চক্রবর্তী, নেত্রকোনা