বিজ্ঞাপন
default-image

অবাঙালি-অধ্যুষিত নীলফামারীর সৈয়দপুরে হাতে গোনা কয়েকটি বাংলা সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল ব্রিটিশ আমলে। নূর মোহাম্মদ ছিলেন একজন তুখোড় নাট্যাভিনেতা। দেশ, ইতিহাস, ঐতিহ্যনির্ভর নাটকে অভিনয় করতেন। সৈয়দপুর এলাকায় বাঙালি সংস্কৃতি চর্চা ও বিকাশে অগ্রণী ভূমিকায় ছিলেন তিনি। এ জন্য অবাঙালিরা ক্ষিপ্ত ছিল তাঁর ওপর।

সেদিন ছিল একাত্তরের ১৫ এপ্রিল, পয়লা বৈশাখ। সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানা গেটে একদল অবাঙালি পথরোধ করে নূর মোহাম্মদের। তারপর চাপাতি, রামদা দিয়ে এলোপাতাড়ি নির্মমভাবে কুপিয়ে ঘটনাস্থলেই হত্যা করে তাঁকে। রেলওয়ে কারখানার অসংখ্য শ্রমিকের সামনেই এই পৈশাচিক ঘটনা ঘটে। তাঁকে বাঁচাতে কেউ এগিয়ে আসেনি।

শহীদ নূর মোহাম্মদের বড় ছেলে ইউনুস আলী সৈয়দপুর শহরের নতুন বাবুপাড়ার বাড়িতে প্রথম আলোর কাছে মুক্তিযুদ্ধ ও তাঁর বাবাকে হত্যার স্মৃতিচারণা করছিলেন। তিনি বলেন, অবাঙালিরা তাঁর বাবাকে হত্যা করে লাশ সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার জ্বলন্ত ফার্নেসে (উনুন) নিক্ষেপ করে। তাঁর বাবা ছিলেন সৈয়দপুরের ঐতিহ্যবাহী বাঙালি সংস্কৃতির শতবর্ষী প্রতিষ্ঠান শিল্প সাহিত্য সংসদের সদস্য। অবাঙালিদের সঙ্গে বরাবরই স্থানীয় বাঙালিদের সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব ছিল। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর প্রশ্রয়ে অবাঙালিরা হিংস্র হয়ে ওঠে। এলাকার বাঙালিদের হত্যা, নির্যাতন করতে থাকে।

নূর মোহাম্মদ সম্পর্কে বলতে গিয়ে তাঁর প্রাণের সংগঠন শিল্প সাহিত্য সংসদের বর্তমান সভাপতি ম আ শামীম বলেন, একজন জনপ্রিয় অভিনয়শিল্পী ছিলেন শহীদ নূর মোহাম্মদ। মঞ্চে উল্কা, নবাব সিরাজউদ্দৌলা, মায়ামৃগ, সম্রাট শাহজাহান, টিপু সুলতান, পথের শেষে, মোহনলাল, মুচি, নলিনী, কাঙ্গালিসহ অসংখ্য নাটকে অভিনয় করেন তিনি। তাঁর অভিনয় দেখে বাঙালিরা উজ্জীবিত হতেন।

শামীম বলেন, ‘একাত্তরের ১৫ এপ্রিল আমরা এই গুণী নাট্যশিল্পীকে হারিয়েছি। কেবল বাংলা সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতার জন্য নূর মোহাম্মদসহ শিল্প সাহিত্য সংসদের ১১ জন সদস্যকে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা নির্মমভাবে হত্যা করে। আমরা এই শহীদদের স্মরণে প্রতিবছর এপ্রিলে স্থানীয়ভাবে শহীদ দিবস পালন করে থাকি।’

মুক্তিযুদ্ধ গবেষক অশোক কুমার সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধে রংপুর ও গণহত্যার ভয়াল স্মৃতি গ্রন্থে বলা হয়েছে, শহীদ নূর মোহাম্মদ ১৯২৮ সালের ২ জুন অবিভক্ত ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কাঁচড়াপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম ছিল শেখ ইউসুফ মোহাম্মদ। মা সিধু বেওয়া। তিনি ১৯৪০ সালে ব্রিটিশ-ভারত রেলওয়েতে যোগ দেন করেন। দেশবিভাগের পর তিনি সপরিবার সৈয়দপুরে চলে আসেন।

সৈয়দপুর শহরে শহীদ নূর মোহাম্মদের নামে একটি সড়কের নামকরণ হয়েছে। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শহীদ নূর মোহাম্মদের স্ত্রী সখিনা বেগমের কাছে চিঠি পাঠিয়ে সমবেদনা প্রকাশ করেছিলেন। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে দুই হাজার টাকার অনুদান দেওয়া হয়েছিল। সখিনা বেগম ২০১৩ সালের ২৪ জানুয়ারি মারা যান। তাঁর দিন ছেলে ও দুই মেয়ে।

গ্রন্থনা: এম আর আলম, সৈয়দপুর, নীলফামারী