পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের ক্যাপ্টেন ছিলেন শহীদ প্রকৌশলী নূরুল আবসার। অমানুষিক নির্যাতনের পর তাঁকে গুলি করে হত্যা করেছিল বর্বর অবাঙালি সেনারা।
নূরুল আবসারের জন্ম কুমিল্লা জেলার মজিদপুর গ্রামে। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট। ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে ঢাকা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরে যোগ দেন ১৯৬৮ সালে।
কবি শামসুর রাহমানের আত্মীয় ছিলেন নূরুল আবসার। ‘আমার আপনজন’ নামে নূরুল আবসারকে নিয়ে কবির একটি লেখা সংকলিত হয়েছে রশীদ হায়দার সম্পাদিত বাংলা একাডেমির স্মৃতি: ১৯৭১-এর পুনর্বিন্যাসকৃত দ্বিতীয় খণ্ডে। সেখানে কবি জানিয়েছেন, নূরুল আবসার ছিলেন তাঁর বোনের দেবর। প্রকৌশলী হলেও নূরুল আবসারের কবিতা ও বাংলা ভাষার প্রতি অনুরাগ ছিল অসামান্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জীবনানন্দ দাশের কবিতার অনুরাগী ছিলেন। কবিতা নিয়ে আলোচনা করতেন। নিজেও কবিতা লিখতেন, তবে প্রকাশ করতেন না।
স্বাধিকারের আন্দোলনে বাংলাদেশ যখন অগ্নিগর্ভ, তরুণ নূরুল আবসারকেও সেটি স্পর্শ করেছিল। তবে সেনাবাহিনীতে কাজ করায় সরাসরি সে আন্দোলনে যুক্ত হওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। তাঁকে প্রশিক্ষণের জন্য ১৯৭০ সালে লাহোরে বদলি করা হয়। একাত্তরে তিনি আবার ঢাকায় ফিরে আসেন। পাকিস্তানি সেনারা একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে গণহত্যা শুরু করলে তাঁর মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। তিনি কয়েকজন বাঙালি কর্মকর্তার সঙ্গে মিলে বেশ কয়েকটি ট্যাংক বিকল করে ফেলেন। এরপর তাঁদের আটকে রাখা হয়।
নূরুল আবসারকে নিরস্ত্র করে কঠোর পাহারায় রংপুরে পাঠানো হয়। তার আগে মেজ ভাই গোলাম রব্বানীর বাসায় আনা হয় কিছু সময়ের জন্য। সেখানেই তিনি ট্যাংক বিকল করে দেওয়ার কথাটি জানাতে পেরেছিলেন।
নূরুল আবসার বুঝতে পেরেছিলেন, এই নরপিশাচদের হাত থেকে মুক্তি নেই। ভাইকে তাঁর শেষ কথা ছিল, ‘আর হয়তো দেখা হবে না। আব্বা-আম্মাকে কাঁদতে মানা করবেন।’ তাঁর আশঙ্কা ঠিক হয়েছিল। তিনি আর ফেরেননি। পরিবারের লোকেরা জেনেছিলেন নূরুল আবসার শহীদ হয়েছেন।
ঘাতকেরা নূরুল আবসারসহ আরও কয়েকজন বাঙালি সেনা কর্মকর্তা ও সৈনিককে আটক করে রংপুরে এনেছিল। তাঁদের মধ্যে বেঁচে ফিরেছিলেন মেজর (অব.) নাসিরউদ্দিন। তাঁর যুদ্ধে যুদ্ধে স্বাধীনতা বইটিতে তিনি সেই ভয়াবহ নির্যাতন ও হত্যার বর্ণনা করেছিলেন। তাঁর লেখার সূত্র ধরে কবি শামসুর রাহমান ও নূরুল আবসারের পরিবার পুরো বিষয়টি জানতে পারেন।
ঢাকা থেকে তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল রংপুর-বগুড়া সড়কের পাশে একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে। বাড়িটি ছিল পাকিস্তানিদের নির্যাতনকেন্দ্র। সেখানে তাঁদের বিদ্যুতের তার দিয়ে বেদম পেটানো হয়। কাঠের হাতল লাগানো তরবারির মতো লম্বা বিশেষ এক ধরনের ছুরি দিয়ে শরীর খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করে ফেলা হয়। এরপর গাড়িতে তুলে পলাশবাড়িতে নামিয়ে গুলি করে তাঁদের হত্যা করা হয়।
গ্রন্থনা: আশীষ-উর-রহমান।